পর্ব – ১২
মানুষ যা চায় তাই কি ঘটে সবসময়? যদি ও বা ঘটে তাতে কি আশা মেটে পুরোপুরি? কত সময়ে তো কত আপাত তুচ্ছ ছোটোখাটো ঝাপটাও প্রাপ্তি সুখে কাঁটা বিঁধিয়ে দেয়। তখন মনে হয় সব আকাঙ্ক্ষাই বেকার, হয়তো বা চাওয়াটাই শূন্যগর্ভ। দুপুর থেকেই নিজের মনের কুঠরীগুলো আতিপাতি খুঁজছে আমার। গত সন্ধ্যা কেটেছে প্রচুর আনন্দে, অহনার কলিগদের সংস্পর্শে। আজ বেশ বেলা করেই ঘুম ভাঙলো। সাইড র্যাকে মোবাইলটা চার্জে ছিল। ঘরটা গুমোট হয়ে আছে। কাল রাতে কম্বলের তলায় ঘেমে নেয়ে একাকার মাঘ আসতেই শীত কি গায়েব হলো?? ঋতুর গতি প্রকৃতি ঠাহর করতে পারা যাচ্ছে না। বিছানা ছেড়ে খানিকটা স্বচ্ছন্দ বোধ করছি। ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। খোলা হাওয়ায় যেন একটু বাড়তি অক্সিজেন।
নিজের ভেতর থেকে মন আনচান করছিল। স্নায়ু অবশ হয়েছিল খানিকক্ষণ, ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই ফের তন্ত্রী টান টান। লাল ইটের দাঁত দেখানো ভাঙাচোরা দেয়াল। ওপারে লোকের জটলা। সিটি ইলেকশন চলছে, জোরে সোরে মাইকে প্রার্থীদের প্রচারণা। কত কী মার্কার ছড়াছড়ি। প্রচারণা তো হচ্ছে লোক ভোট দিতে পারবে কী??
বন্ধুরা ফোন করে খোঁজ খবর নেয়, কারো কারো নাকি আমার জন্য মন খুব আনচান করে। কোনটা যে আসল সত্যি, কোনটা যে মনকে চোখ ঠারা, হৃদয় কি তার খবর রাখে পুরোপুরি? কেইবা জানে, বুকের গোপন কুয়োয় কত রঙের মাছ কিলবিল করে দিনরাত!
মোবাইলটা হাতে নিয়ে সেতুকে ছোট্ট করে একটা বার্তা পাঠালাম, কেমন আছ গিন্নী? ও যা উত্তর দিলো দৃষ্টিটা নিমগ্ন হয়ে গেল আমার। অহনার এই ছোট বোনটার সাথে আমার সম্পর্ক টা একটু অদ্ভুত রকমের ভালোবাসায় মোড়ানো।
সেতুর বিয়েটা অহনার ল’আব্বা কিছুতেই মেনে নিতে চায় নি । কেনই বা নেবেন? মেয়েকে পক্ষিনীর মতো ডানার ছায়ায় বড় করেছেন, দিয়েছেন সেরা সব জিনিস। বাবা মা তো অন্তর থেকেই চান মেয়ের একটা নিজস্ব ঘর হবে, আশা আকাঙ্খার সাথে সংগতি রেখেই একটা রুচিশীল পরিবারে মেয়ের বিয়ে দেবেন। পরিশেষে তার কোনটাই হয়নি। তবু ল’আব্বা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নিলেন।
কিন্তু সেতু সুখী হতে পারে নি, আমার সাথে দেখা হওয়ার প্রথম দিনেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। সেতুর মুখে আমি চিন্তার ওঠা পড়া টের পেয়েছিলাম। একটা সুখে থাকার অভিনয় করে যাচ্ছিল সেতু। সবটাই অভিনয়, ভিতরের রক্তক্ষরণ হাসির মোড়কে ঢেকে দম দেয়া পুতুলের মতো একটা অসম সম্পর্ক টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল কেবল। আমি মাঝে মাঝে অহনার কাছে জানতে চাইতাম, কিন্তু অহনা কখনো আমাকে বলেনি। কেন বলেনি? লজ্জা? সংকোচ? কুন্ঠা?
সেতুর কথা ভাবতে গিয়ে হৃদপিণ্ড ছলাৎ। খানিক অসহিষ্ণু পায়ে আবার এসে ব্যালকনিতে দাঁড়ালাম। মাঘের দুপুর গড়াচ্ছে বিকেলের দিকে। উঁচু বাড়ীর মাথায় সূর্যমুখী হলুদ। একটা বাড়ীর বারান্দায় একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। কানে মোবাইল।
আমার মতে সেতুর এবার নিশ্চিন্ত জীবনে ফেরা উচিত, শান্তিময়, নিরুদ্বেগ। ওর উচিত ডুবে থাকা বইয়ের পাতায়। কানে তুলো গুঁজে লোকের হা হুতাশ এড়িয়ে চলতে হবে। নিজের ক্যারিয়ার গড়তে হবে আগে। আমি জানি তবু একটা নীরব যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খাবে। ভূল তো সেতুর নিজেরই। চোখকান বুজে পাহাড় চূড়া থেকে ঝাঁপ দিয়েছে সে। নীচে জল না পাথর, কিছুই সে দেখেনি। তার দায় ও সেতুকেই বইতে হবে। জাহান্নামে যাক সামাজিক লাজলজ্জা। সিদ্ধান্ত টা সেতু নিয়েছে। কাছে থাকলে ওকে বলতাম কিছুক্ষণ আমার হাতটা ধরে বসে থাকো। আমি জানি অমার্জিত বাচনভঙ্গি, শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে যাবে সেতুর এক্স হাজবেন্ডের। হয়তো সেসব শুনে গা রি রি করবে সেতুর। তবে এটার একটা পজেটিভ দিক আছে, সেতুর রিয়েলাইজেশন এর জন্য এটা সহায়ক হবে, এই পুরুষ তার জীবনসঙ্গী ছিল?
আমার ভয় হচ্ছে সেতুর জন্য। ওর ছোট্ট জীবনে এমন ঝড়ের আকস্মিকতায় ক্ষনিকের জন্য দিশেহারা হয়ে যাবে না তো?? শুকনো পাতার মতো এলোমেলো ছুটোছুটি করবে না তো? সেতুর কথা গুলো গলন্ত সিসের মতো আঘাত হানছিল আমার পাঁজরে। ওর মুখটা ভাবলেই এখনও বুকটা ব্যথিয়ে উঠছে। যে মহাপাপিষ্ঠ, সেতুর বিশ্বাস ভেঙেছে তার অপরাধের ক্ষমা নেই।
দীর্ঘ ম্যারাথন দৌড়ের পর ঠিক যেমন একটা বিরানভূমিতে পৌঁছাতে সাধ যায় মানুষের আমি জানি তেমন একটা জায়গায় যেতে চাইছে সেতুর মন। পুরনো স্মৃতি গুলো ঝেড়ে ফেলতে একটু তো সময় লাগবেই বেচারীর। আমার সেতুকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। ভালোই করেছে এই হৃদয়হীন, বোধবুদ্ধিহীন, অনুভূতিশূন্য মানুষটার সঙে একটা গোটা জীবন পাড়ি দেয়ার পথ ইতি টেনেছে। সেতুর আশে পাশের কেউ হয়তো ওর দুঃখগুলোকে সেরকম ভাবে বুঝবে না। কোনও একটা বিশ্বাস, কিংবা কোন একটা আদর্শ যদি ভেঙে যায়, সেটা মানুষ কে দুঃখ দেয় কিন্তু সেই দুঃখটাকে যদি একান্ত আপনজন ফিল করতে না পারে সেটা তো আরো বেশী দুঃখের, আরো বেশী কষ্টের। চিরকালের মতো একটা সম্পর্ককে চিরকালের মতো কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলে অন্য সম্পর্ক গুলোকে সম্মান করতে পারবে তো? শুধু ভালোবাসাই যথেষ্ট নয়, সংসার গড়ার জন্য আরও কিছু লাগে। মিথ্যে যুক্তির প্রয়োজন নেই একটা গোটা জীবন ভুল ভাবে কাটানোর চেয়ে ভুল সম্পর্ক গুলো চিরকালের মতো কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলাই উচিত।
হঠাৎই আমার মধ্যে সেতুকে অনুভব করছি আমি। আমি ও তো তার মতো ভূল সম্পর্ক কুটিকুটি করে অহনার বিশ্বস্ত হাত ধরেছি।
নিঃশব্দে বারান্দায় এলাম। অন্যমনস্ক ভাবে সিগারেট ধরিয়েছি, গতকাল অহনা একটা লাইটার গিফট করেছে।মধ্যরাতের জ্যোস্না। রাত বাড়ার সাথে সাথে আরও যেন প্রকট হয়েছে চাঁদ। অশালীন জ্যোস্না ছিঁড়ে খুঁড়ে দিচ্ছে অন্ধকারের সমস্ত মুখোশ। সমুদ্র, আকাশ, মাঠ কারুর আজ রেহাই নেই চাঁদের হাত থেকে। আমারও না। অহনার ও না। সেতুরও না।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট