প্রথম পর্বঃ
শহর থেকে বের হয়ে পাঁচ সাত মাইল দূরে এক কোলাহলমুক্ত পরিবেশ, নয়নাভিরাম সবুজের সমারোহ, নদীর উপরের ছোট্ট ব্রীজ পেরিয়ে গেলে দেখা যায় ধুপছায়া গ্রামের চা বিস্কুট সরবরাহকারী ছোট্ট একটা মুদি দোকান, সামনে পুরোনো
কালো রঙের দুটি কাঠের টেবিল, বৃষ্টির পানি পরে রং নষ্ট হয়ে গেছে এমন তবুত্ত দুপাশে দুটো বসার
টুল লাগানো, দোকানের মালিক হারাধন দাস নিজেই দোকান চালায়, সে দোকানে বসে চা খেলেন এক শহুরে ভদ্রলোক, বয়স পঁয়তাল্লিশ
ছেচল্লিশ হবে। হারাধনের কাছে জানতে চাইলেন, আরজ আলী মাতব্বর বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয় কোন দিকে? ওখানে ফারিয়া জামান নামে কোন শিক্ষক আছেন কিনা?
হারাধন প্রশ্ন শুনে লোকটিকে খুব ভাল করে দেখলেন, লম্বা, উজ্জ্বল শ্যামল গায়ের রং, মুখের গড়ন সুন্দর, ক্লীন শেভ করা গভীর মায়াভরা চাহনি, মজবুত পরিশ্রমী মেদহীন সুঠাম শরীর, পরনে কলার অলা হালকা নীলের স্ট্রাইপ টি শার্ট, হালকা নীল জিন্স, পায়ে সাদা কেড্স,তার দাঁড়ানো তাকানোর ভদ্র স্টাইল বলে দেয়,একজন সুরুচিপূর্ণ শিক্ষিত মানুষ তিনি। কিন্তু ফারিয়া ম্যামকে কেন খোঁজে? আর স্কুলেই বা উনার কি কাম? নাহ্ খোঁজখবর ছাড়া অপরিচিত কারোর কাছে কারোর কথা বলা ঠিক না, রাতের স্কুলে ম্যাম শেখায়।তাই হারাধন শক্তভাবে জানতে চায়,
আমনে কেডা?
উত্তর আসে, আমি সক্রেপ্লেটোটল রবীরুল সিনাহ। ছোটনাম সরসিনাহ।আপনার নাম কি? বলে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।
বাড়ানো হাত দুহাতে জড়িয়ে ধরে হারাধন, বেশ সম্মানিত বোধ করে হারাধন, চোখের কোণে একটু পানিও আসে, প্রতিদিন কত মানুষকে চা খাওয়ায় সে, মসজিদের আসাদ ইমাম আর ফারিয়া ম্যাম আর কয়েকজন মানুষ তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলে, তাদের সে হাতে গুণতে পারবে।
হারাধনঃ আমি হারাধন।
পরিচয় দিতে বেশ সম্মানিত বোধ করলো সে, এক সেকেন্ডে লোকটা তার মনের দরজা নিজের জন্য খুলে নিলো।তারপর হারাধন মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো, তা সকিপটি সিনহা সাব, আমাগো ম্যাম কি আমনের আত্মীয়?
সরসিনাহঃ অনেকটা তাই। তিনি কি আরজ আলী মাতব্বর স্কুলে আছেন এখন?
হারাধনঃ জি স্কুলেই আছে।
সরসিনাহঃ কোন দিকে যাবো এখান থেকে?
হারাধনঃ চলেন আমি লইয়া যাই। সে দোকানে তার সহযোগী ছেলেকে ডেকে বললো, অ বিজয় তুই দেখিস, তারপর দোকানে লাগানো সব ঠাকুরকে প্রণাম করে বের হলো।আসেন আমার লগে।
তারপর বিজয়কে চায়ের দাম দিয়ে হারাধনকে অনুসরণ করলো সরসিনহা।
আঁকাবাঁকা মেঠোপথ, দুপাশে ধানক্ষেতের কচি সবুজ ধান গাছের বাতাসে হেলেদুলে একের গায়ের উপর অপরের লুটোপটি খেলা দেখতে দেখতে চোখ যখন পথের শেষে তাকায় দেখা যায় স্কুল।
স্কুলের সামনে রাইমা জাহান ম্যামের বাড়ী। সে বাড়িটি ক্রিম কালারের সামনে সোজা আঁকাবাঁকা ডিজাইনের গ্রীল দেয়া বারান্দা দোতলায়, বাড়ীর সৌন্দর্য বাড়ায় এ বারান্দা। বাড়ীটি পরিপাটি করে গুছানো, বাড়ীটির দেয়াল সাজানো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছবি, প্রাকৃতিক দৃশ্য, বিখ্যাত কিছু লোকের ছবি, হাতের তৈরী মাটির ও নকশী করা
বাঁশ, বেত ও ধানের শোপিস, বারান্দায় টবে বাহারি ফুলের ও সব্জির গাছ, বেড রুমের বিছানা, পর্দা, সর্বত্র মার্জিত রুচিবোধের ছাপ।বাড়ীর নীচের ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে জাহাঙ্গীর হোসেনের
জলজ্যোৎস্নার স্বয়ম্বরা বইটি পড়ছিলেন রাইমা।চা নিয়ে এলো করিমন বেওয়া।করিমন এ বাড়ীতে কাজ করে। বই থেকে চোখ সরিয়ে রাইমা করিমনকে প্রশ্ন করে – করিমন তোমার ভবিষ্যত চিন্তা কি?
করিমনঃম্যাডাম, আমার আইজ দুই বেলা খাইতে পারলে, বাচ্চা দুইডারে খাওয়াইয়া রাতে একটু শান্তিতে ঘুমাইতে ফারলেই, আলহামদুলিল্লাহ।আর ভবিষ্যত চিন্তা কি গরীবের হাতে আছে গো ম্যাডাম? হে তো বলে আল্লায় করে ইমাম সাবে কয় আর সরকার করে চেয়ারম্যান সাবে কয়। আমরার ভাত, কাফড়, মাতার উফরে চাল যদি আইজকা থাকে হেইডাই আমগো হারা জীবনের চিন্তা। যান ম্যাডাম,আমি চা লইয়া আইতাছি, ম্যালা কাম।
রাইমা ম্যাম হুমমম বলে কি যেন ভাবতে ভাবতে তার পড়ার ঘরে চলে গেলেন।সেখান থেকে ব্যাগ নিয়ে স্কুলের জন্য বের হলেন।রাইমা ম্যামের সাথে
তার পালিত দুই ছেলে মেয়ে এবং তার এক ফুফু।
রাইমা ম্যামের বাড়ীর কাজ শেষ করে জরীর মার সাথে করিমন ইউনিয়ন পরিষদের অফিসে চাল আনতে যায়।সেখানে চেয়ারম্যান গফুর আলীকে সালাম দেয় সে।
চেয়ারম্যান: মেম্বর সাব দেখেন একটু করিমন বেওয়া কি সায়?
মেম্বর সাব: আর কইয়েন না, তাই খানকী?
করিমন বেওয়া হেসে বললো মেম্বর সাব, এইডা কি বাংলা কইলেন না হিন্দি? যদি হিন্দি কন, তয় আমি না খান কী নেহী অউর কিসি কি? হাম স্রেফ হাম কি । ( রাইমা ম্যাডামের ঘরে কাজ করতে করতে করিমন টিভির শব্দ শুনে একটু হিন্দি শিখে ফেলেছে, আজ সে বিদ্যে লাগিয়ে দিলো কাজে। নইলে সে কি বুঝে না এই মেম্বর চেয়ারম্যান রাতের আঁধারে তার বাড়ীর পাশে কেন ঘুরঘুর করে?)
আর যদি বাংলা কন খান কি ? কি আর খামু কন? ঘরে চাইল নাই,তাইলে চাইল দেন ঘরে যামু রানমু তবে না বাইচ্চা দুইডারে লইয়া খামু।
পাশে ছিল জরীর মা, কইলো, ঐ করিমন মেম্বর সাব খানকী গাইল পারচে, তুই বুজস না৷
করিমন: খালা অতো বুইজা কাম নাই, গরীবরা যদি গাইল খাইলে পেট ভরতো হেইডা আমি এই বস্তা ভইরা নিতাম কিন্তু ঐ গালিতে তো আমরার পেট ভরবো না খালা।
মেম্বর সাব চাইল দেন।
মেম্বরঃ কোন কামে তোমরারে ফাওন যায় না কেবল চাউল আইলেই কাউয়ার আগে হাজির। ঐ ছলিম করিমনরে আর জরীর মারে চাইল দিয়া দে পাঁচ কেজি কইরা, চেয়ারম্যান সাবের মায়ার শরীর।
জরীর মা করিমনকে বলেঃ অ করিমন তুই না কইলি
সরকার আমরারে দশ কেজি কইরা চাইল দিবার কইছে, তয় এহানে পাঁছ কেজি দিলো যে?
করিমন জরীর মাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে চলে, যেতে যেতে বলে – আইজ কি নতুন কম চাইল ফাইছো? এতো আমরার মত মাইনসের আজীবন ঠগনের
সিলসিলা। যা পাইছ শোকর করো, চলো।তুমি না
কও,গরীবের মুখের থাইক্যা কতা বাইর অইতে নাই।
২রা ফেব্রুয়ারি,২০২২ সকালবেলা, মসজিদের পাশের পুকুর ঘাটলা, ইমাম সাহেব, স্কুলের প্রধান শিক্ষক আলোচনা করছেন আজকের খবর- নায়ক রিয়াজের শ্বশুর কলেমা পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। ওখানে ছিলেন সহকারী ইমাম শাহাদত মোল্লা।
খবর শুনে ইমাম সাহেব বললেনঃ ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্নাইলাইহে রাজিউন। আল্লাহ উনাকে জান্নাতবাসী করুন।
সহকারী ইমাম বড় বিরক্তি নিয়ে বললেনঃ ডাইরেক্ট জাহান্নাম! আত্মহত্যা মহাপাপ।
ইমাম সাহেব বললেনঃ এমন বলতে হয় না শাহাদত সাহেব। আল্লাহ ন্যায় বিচারক। কিতাবের ভেতর যা লেখা তা আমরা জানি আর যা মহাবিশ্ব ঘিরে হচ্ছে, প্রতিটি মানুষের গোপন কথা, তার সমস্যা জানেন কেবল আল্লাহ পাক, সেই মহান স্বত্ত্বা। আমরা দোয়া করতে পারি, ন্যায় বিচারের মালিক তিনি, আমরা সীমানা তো লঙ্ঘন করতে পারি না। তাই কিতাবের ঊর্ধ্বে যার মাহাত্ম্য সেই মহান স্বত্ত্বার কাছে মঙ্গলই চাই চলুন, হিংসা নয়, বিদ্বেষ নয়, ঘৃণা নয়।
প্রধান শিক্ষকঃ ঠিক বলেছেন ইমাম সাহেব। আমাদের কাজ
মঙ্গল কামনা করা আমরা সেটা করি। আপনি কষ্টের মাঝেও মনে মলম লাগাতে পারেন ইমাম সাহেব। আল্লাহ ভাল করুন আপনার।
শাহাদৎ মোল্লার মেজাজ গরম হয় ইমাম সাহেবের কথাবার্তা শুনে, বলে আপনি কি কিতাব মানেন না ইমাম সাহেব, যত্তসব উল্টাপাল্টা কথাবার্তা।
ইমাম সাহেবঃ আহ্হা কিতাবের ব্যাপক ইতিহাস, সে তোমাকে পরে বলবো।তুমি কম্পিউটার চালিয়ে দেখো জেমস টেলিস্কোপের নতুন আপডেট কি? যাও।
রাগে গজগজ করতে করতে শাহাদৎ মোল্লা স্হান ত্যাগ করে।
জরীর মা পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, ইমাম সাহেব সালাম দিলেন,
কেমন আছেন জরীর মা, জরী কলেজে যায় তো নিয়মিত?
জরীর মাঃ ছেলাম ইমাম সাব! জরী যায় ইমাম সাব, মেলা ফড়ন লাগে, আমনে মাস্টাররারে না কইলে, সাহাইয্য না করলে তাই কেমতে ফড়তো।সেই ছুডুবেলা তাইর বাফ মরলো আর এই স্যার আর আমনে আমার মাইয়ার লেহাফড়ির দায়িত্ব নিলেন।
ইমাম সাহেবঃ পুরনো কথা ঘাটতে যেও না। তোমার মেয়ে আমাদের এলাকার গর্ব। ওকে আমরা ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখি। তুমি ওর খাবার, লেখাপড়ার জন্য কিছু প্রয়োজন হলে মাস্টার সাহেবকে জানাও। আমরা ব্যবস্হা করবো। যাও এখন।
তুমি ওর সাথে সাথে থাকবে।আর রাতের স্কুলে তুমি আসো না কেনো? ফারিয়া ম্যাম কত কষ্ট করছেন তোমাদের শেখানোর জন্য।
জরীর মাঃ হ ( জিহবায় কামড় দিয়ে লজ্জা পেয়ে) গুম ফায় ইমাম সাব! যামু আইজ। ছেলাম যাই তাইলে।
জরীর মা বাড়ীতে ঢুকে দেখেন করিমন বেওয়া বাচ্চাদের স্কুলের জন্য তৈরী করছে।
জরীর মাঃ স্কুল যাইবা, তৈয়ার অইছ, বালা করছো,যাও দাদুরা।
স্কুলের জন্য বাচ্চারা বেরিয়ে যেতেই জরীর মা করিমনকে বললোঃ করিমন হুনছস, নায়ক রিয়াজ আছে না, হের হউড় বলে কলমা ফইরা তার কফালে গুল্লি মাইরা আত্মহত্যা করছে।
করিমন বেওয়াঃ কও কি খালা! ইন্নালিল্লাহ ওয়া ইন্নাইলাইহে রাজিউন।আহারে!
জরীর মাঃ ইমাম সাব দোয়া করছে আর শাহাদাত মোল্লা কয়
ডাইরেক্ট জাহান্নাম, মসজিদের সামনে পুকুর ঘাটলায় মাস্টার সাব সহ কতা কইতাছিল।শাহাদৎ মোল্লায় কয়, আত্মহত্যা মহাপাপ।
করিমন বেওয়াঃ আল্লাহর হুকুমে না বলে আজরাইল মালাকুল মউত ফেরেশ্তা জান কবচ করে তয় আল্লাহ পাপ কাজে তার জান কবচ করতে হুকুম দিলো ক্যান? আল্লাহর হুকুম ছাড়া বলে কিসসু অয় না তাইলে এই পাপ অইলো কেমনে?
বর ফ্যাঁচগোচ খালা,চিন্তা করলে মাতা আউলাইয়া যায়। ইমাম চাচায় জানি কেমনে মাতা ঠান্ডা রাহে বুজি না।
জরীর মাঃ অত বুইজ্জা কাম নাই, তোর সব উল্ডাপাল্ডা কতা,
আমারো মাতা আউলাছ খালি। যা কামে যা, ম্যাডাম স্কুল যাইবো। আমার সক্কালবেলার কাম শেষ, তুই আইলে বৈকালে
আবার কামে যামু।
করিমন বেওয়াঃ হ খালা যাইতাছি।জরী আমরার লগে খাইছে,
বাত তরকারী আছে, তুমিও খাও।
আইচছা মা খামু, একটু দম লই।অ জরী কই তুই? কি করস, ফরসনি বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন জরীর মা।
করিমন বেওয়া তার মাথায় কাপড় টেনে হাঁটা দিলো ফারিয়া ম্যামের বাড়ীর দিকে। ফারিয়া ম্যাম আরজ আলী মাতব্বর স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা।
এই তাদের প্রতিদিনের জীবন যুদ্ধ, বেঁচে থাকার লড়াই।
তারপরও ফারিয়া ম্যাম রাতের দুই ঘন্টার স্কুলে তাদের পড়ান, বলেছেন আর কিছুদিন পড়লে স্কুলে আয়ার কাজ দেবেন। সেই স্বপ্ন আর বাচ্চাদের বড় করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে করিমন বেওয়া
এ সমাজের কত অন্ধ বন্ধ চোরাগলির হাতছানি পাশ কাটিয়ে
কঠিন ব্যক্তিত্বের খোলসের আড়ালে নিজের আত্মসম্মান ধরে রেখে দারিদ্র্যের সাথে সাহসী যোদ্ধার মতো লড়ে যায়। (চলবে)
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট