ভারতের কর্নাটকে কি আইন পাশ হয়েছে মুসলিম মেয়েরা হিজাব পরে কলেজে যেতে পারবে না? যতদূর জানি বিষয়টির মূল আরো গভীরে, ২০২২ সালের জানুয়ারী মাসে ভারতের উদুপিরের পি ইউ গভর্ণমেন্ট গার্লস কলেজে ছাত্রীদের হিজাব পরে
কলেজে প্রবেশ করতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয় অন্যান্য কলেজে। সুবিধা নেয় উদুপির ও হিকাম্মাগুলির ডানপন্হী ছাত্র সংগঠনগুলো। তারা এর বিপরীতে অবস্হান নেয় এবং হিজাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে থাকে। বিভিন্ন জায়গায় এ দু গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক মারামারি হয়। বিষয়টি নিয়ে মামলা হয় কর্ণাটক আদালতে যা এখনো বিচারাধীন।
তবে জয়শ্রীরাম স্লোগান দেয়া গেরুয়া উত্তরীয় পরা যুবকদের ঐ তরুণীকে কলেজে ঢুকতে না দেয়া কতখানি যৌক্তিক? কেন তারা কর্ণাটকের ঐ কলেজের সামনে বাণিজ্য বিভাগের ছাত্রী মুসকান খানকে হিজাব পরায় কলেজে ঢুকতে দেননি? কে তাদের মুসকানকে কলেজে ঢোকার পথে মুসকানের পথ রোধ করার সাহস দিল? আইন কি তারাও ভঙ্গ করেননি?
একদিকে জয়শ্রীরাম ধ্বনি এবং তার বিপরীতে তরুণীর আল্লাহু আকবর ধ্বনি ব্যবহার দুটোই ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তৈরীর উপলক্ষ হিসেবে কাজ করতে পারে।
যেমনঃ এ তরুণীর পক্ষ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আল্লাহু আকবর পোস্ট দেখলাম অনেক। ভারতের সমস্যা ভারতের আদালত দেখছে, তাদের রায় এখনও আসেনি। তার আগেই আমরা জয়শ্রীরাম বনাম আল্লাহু আকবর দাঙ্গায় মেতে গেলাম।
আগুনে ঘি ঢালা বোধ হয় একেই বলে। সে আগুনের তাপ এসে লাগছে বাংলাদেশেও।
ইন্টারনেটে মুসকান খানেরও রাজনৈতিক উগ্রবাদীতার সাথে সম্পর্ক আছে বলে অনেক পোস্ট দেখা যাচ্ছে। তাই তিনি ব্যক্তিগতভাবে কতটা ধর্মীয় অনুভূতি সম্পন্ন ও শান্তিপ্রিয় মানুষ সেটাও বিবেচনার দাবী রাখে অবশ্যই।
খুশী হতাম বাঙ্গালী মুসলমানদের আল্লাহু আকবর যদি হিজাব বাঁচানোর জন্য না হয়ে মানুষ বাঁচানোর জন্য হতো। হিজাব পরিহিতা নুসরাতকে আগুন দিয়ে পুড়ানো হলে কোন আল্লাহু আকবর পার্টি এসে তার জন্য দুকলম লেখার বা সামান্য প্রতিবাদ করার সময় পান না। সৌদি আরবে গৃহপরিচারিকা তের বছরের নদীর লাশ দেখে আমাদের মন কাঁদে না। কাঁদে কেবল
হিজাবের জন্য তাও যখন আবার বিধর্মী কারো দেশে কোন ঘটনা ঘটে। হায়রে – এতো কেবল সেই সুদূর অতীত থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তৈরীর উসিলা খোঁজা এবং সেই পালে হাওয়া লাগানো হিন্দু ও মুসলমানদের দল- এদের মধ্যে মানুষ কোথায়?
যেমনঃ কাজী নজরুল ইসলামের “মন্দির ও মসজিদ” প্রবন্ধের মতো, তার ভাষায়”‘মারো শালা যবনদের, মারো শালা কাফেরদের’ – আবার হিন্দু মুসলমানী কাণ্ড বাধিয়া গিয়াছে৷ প্রথমে কথা কাটাকাটি, তারপর মাথা ফাটাফাটি আরম্ভ হইয়া গেল৷ আল্লার এবং মা কালীর ‘প্রেস্টিজ’ রক্ষার জন্য যাহারা এতক্ষণ মাতাল হইয়া চীৎকার করিতেছিল তাহারাই যখন মার খাইয়া পড়িয়া যাইতে লাগিল, দেখিলাম– তখন আর তাহারা আল্লা মিয়া বা কালী ঠাকুরানির নাম লইতেছে না৷ হিন্দু–মুসলমান পাশাপাশি পড়িয়া থাকিয়া একই ভাষায় আর্তনাদ করিতেছে, –‘বাবা গো, মা গো’ – মাতৃপরিত্যক্ত দু’টি ভিন্ন ধর্মের শিশু যেমন করিয়া এক স্বরে কাঁদিয়া তাহাদের মাকে ডাকে৷”
বাংলাদেশেও যখন হিন্দুদের মূর্তি ভাঙ্গা হয় তখনও আমরা তাদের দেখিনা। তখন আমাদের মতো সাধারণদের লেখনীতে ঝলসে উঠে হিন্দু মুসলিম সংঘর্ষের বিভৎস চিত্র।
এ গেল এ আলোচনার একটি দিক। দ্বিতীয় দিক, হিজাব কিভাবে এবং কখন থেকে ইসলামের অঙ্গ হয়ে গেলো? ইতিহাস কি বলে? ভারতীয় উপমহাদেশেই কিভাবে ধর্মের রথ ধরে হিজাবের কওমী চেতনা আমাদের মাথায় আল্লাহর প্রিয় ইউনিফর্ম হিসেবে ঢুকে গেল এবং আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে গেলো? কিভাবে আমাদের মনুষত্বের আগে ধর্মকে চিন্তা করার বিষাক্ত শিক্ষা একটু একটু করে গত কয়েক দশক ধরে চোখ অন্ধ, কান বধির এবং চিন্তাবর্জিত বিবেক তৈরী করে হিজাবের সৈনিক বানানো হলো? এর পেছনে কারা? কি তাদের উদ্দেশ্য?
তার মানে কি এর আগে যারা শাড়ী বা সেলোয়ার কামিজ পরে ধর্ম পালন করেছে তাদের ধর্মপালন বৃথা গেছে?
সাম্প্রদায়িকতা একটি ব্যাধি। জেনেশুনে এ পালে হাওয়া দিয়ে
অসংখ্য মানুষের জীবনকে সংকটাপন্ন করার মতো সমস্যা তৈরী করা ধর্মের নামে, সাম্প্রদায়িকতার নামে উগ্রবাদিতা হতে পারে তবে আল্লাহর পছন্দ অবশ্যই নয়। তাই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তৈরী হতে বিরত থাকুন, নিজেকে প্রশ্ন করুন – কাউকে বিপদগ্রস্ত করে কি আপনি শান্তি পাবেন? যাতে আপনার শান্তি নেই তাতে পরম করুণাময় যিনি রহমানুর রাহীম তিনি কিভাবে খুশী হবেন।
মানুষকে মেরে তাকে খুশী করা যাবে না, মানুষকে ভালবেসে, শান্তির বার্তা দিয়ে উনার সন্তুষ্ট পাওয়া যাবে – চলুন সে পথে হাঁটি, সাম্যের পথে হাঁটি, সাম্প্রদায়িকতার পথে নয়।
পথ আপনার সামনে অনেক খোলা, আমিও করলাম এক পথের আহবান, সিদ্ধান্ত আপনার- কোন পথে হাঁটবেন? সাম্প্রদায়িকতার মারামরি আর কাটাকাটির না ঐক্যের,সাম্যের ও শান্তির পথে? কোন পথে আপনি খুঁজবেন আল্লাহকে? ধন্যবাদ।