২০১৩ তে মাগুরার গণজাগরণ মঞ্চ শুরু হল , প্রতিদিন দুপুর ৩টা গড়ালেই ইউশাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম । প্রথম কয়েকদিন অংশগ্রহণকারীদের আয়োজনে চলল। পরে উপস্থিতির সংখ্যা বাড়তে থাকায় চৌরঙ্গীতে বসার কার্পেট , চট, খাবার জল, মোমবাতি যোগাড়ের সংকট দেখা দিলে সিপিবির কর্মী , ছাত্রলীগের ছেলেরা, জাসদকর্মী – সবাই অর্থ সংগ্রহে নামলাম। আবু নাসের বাবলু ভাই থেকে শুরু করে, দোকান মালিক, সংসদ সদস্য এমএস আকবর- সবার কাছেই দল বেঁধে আমি , আহমেদ,রূপক সহ কয়েকজন অর্থ সংগ্রহে যেতাম। এমনি একদিন ফেরার সময় একজন বলল – আপনাকে কমান্ডার ডাকে। এগিয়ে গেলাম। তিনি বললেন – আপনে কে ? বললাম গণজাগরণ মঞ্চের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছি । তবুও প্রশ্ন আপনে কে ?এবার বললাম – আমি জোছনা , কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী। আমরা সবাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে আন্দোলন করছি। আচ্ছা পরে আপনার সাথে কথা বলব । ওহ! মনি সিং এর পার্টির লোক, আমার থেকে টাকা নিবেন না ? বললাম দেন যদি ইচ্ছা হয় । পরে জেনেছি – তিনি মুক্তিযোদ্ধা নবুয়ত মোল্লা । এরপর তাঁর সাথে অনেকবার কথা হয়েছে । তিনি আমাকে তার অফিসে যেতে বলেছেন গল্প করার জন্য । বলেছিলাম – আপনি যদি তুমি করে বলেন তাহলে যাব। তিনি রাজী হলেন – তাইলে কিন্তু মা বলব- এই শর্তে।
কত কথা চাচার সাথে দেশ নিয়ে , রাজনীতি নিয়ে। সহজ সরল চাচা রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝতে চাইতেন না। তিনি আওয়ামীলীগের সমর্থক ছিলেন। এক ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে নবুয়ত চাচা স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা যারা শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিল স্মৃতিসৌধে , সেখান থেকে ছেলেদের ডেকে শপথ পড়ালেন মাদক গ্রহণ না করার জন্য। শপথ শেষে চাচাকে বললাম – কি করলেন ? চাচা বললেন – জান না মা , কি অবস্থা ! এইটুকু ছেলেরা নেশা করে মাগুরা নেশায় তলায় যাচ্ছে । তাই শপথ পড়ালাম। জিজ্ঞেস করলাম –চাচা কাজ হবে বলে মনে করেন? চাচা-কেন হবে না মা ? বললাম রাষ্ট্র যদি মাদক ঢুকতে দেয় দেশের ভেতরে, তাহলে এদের ঠেকাবেন কি করে ? মাগুরা তো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ না যে চাচা এদের আলাদা করে রাখবেন ? তাইলে কি হবে মা ? বললাম আপনার দল সহ যেসব দল দেশ পরিচালনা করে – তাদের রাজনীতি যদি মাদকের বিপক্ষে থাকে , তাহলে দেশে মাদক আসতে পারবে না । আপনাকেও মিথ্যে শপথ পড়াতে হবে না ।
আরেকদিন কথা হচ্ছে । চাচা আপনি তো যুদ্ধ করছেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে , স্বাধীন হওয়ার জন্য , বৈষম্য না থাকার জন্য , স্বাধীনভাবে কথা বলার জন্য ।পেয়েছেন এসব? চাচার যথারীতি উত্তর – হ্যাঁ। কিভাবে পেলেন ? এদেশে এখন গৃহহীনের সংখ্যা কত? দরিদ্রের সংখ্যা কত? কিছু মানুষ বিত্তবান , কিছু একেবারেই হত-দরিদ্র , বস্তিতে থাকে। স্বাধীন দেশে ডাস্টবিন থেকে খাবার খুটে খায়- এই দেশ চেয়েছিলেন? মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভক্তি চেয়েছিলেন? ভাতার জন্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হবে –ভেবেছিলেন? চাচা- না, মা, এইটা চাই নাই, ভাবিও নাই । কিন্তু কিছু করবার নাই । বললাম ভুল তো আপনারা মুক্তিযোদ্ধারাই করেছেন । চাচা – কেমনে? আমি-চাচা, জানবাজি রেখে যুদ্ধ করে আপনারা স্বাধীনতা ছিনায় আনলেন অথচ স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের অংশীদারিত্ব থাকল না । চাচা এই অংশীদারিত্ব বুঝলেন না । তাঁকে বুঝালাম- স্বাধীন রাষ্ট্রের কোন বিভাগে আপনাদের কর্মসংস্থান হল না, পরিচালনায় আপনারা থাকলেন না। রাষ্ট্রের সর্বস্তরে যারা ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্র চালাচ্ছিল তারাই ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কর্মচারী হয়ে গেল- পরিবর্তন হল না ।রাষ্ট্রে মুক্তিযোদ্ধাদের জায়গা হল না । কেবল হাতবদল হল। স্বাধীন রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা পর্যন্ত পাকিস্তানী ধারায় রয়ে গেল । কেবল ভূখণ্ড আর পতাকা পেলেন চাচা , বৈষম্য দূর হল না। দেশটাকে সঠিক পথে না এনে এই যে অস্ত্র জমা দিয়ে বাড়ি চলে গেলেন, এইটা কাজটা কি ঠিক হয়েছিল আপনাদের মানে মুক্তিযোদ্ধাদের ? নিজেদেরকে কি ব্যর্থ মনে হয় না ? নবুয়ত চাচা এক্কেবারে চুপ হয়ে গেলেন । এ কথাগুলো মনে হয় ২০১৪/ ২৬শে মার্চ হয়েছিল । এরপর চাচার সাথে দেখা হলেই বলতেন – মা, আমি ব্যর্থ মুক্তিযোদ্ধা , মাটি স্বাধীন করলেও মানুষ স্বাধীন করবার পারি নাই । আমার দেশে ধনী- গরীব ,দুর্নীতি থাইকেই গেল।
তারপর চাচার সাথে বহুবার কথা হয়েছে , আমাকে যেতে বলেছেন তাঁর বাড়ি । বলছিলাম – আমি গেলে আশেপাশের সবাই ভাববে – কোন স্বার্থের জন্য এসেছি । আমরা কেউ কারো বাড়ি যাব না চাচা । রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও মনের টানে দেখা হবে।
আজ সেই নবুয়ত চাচা চলে গেলেন চিরদিনের জন্য । চাচা আপনি থাকবেন গণমানুষের হৃদয়ে।
জয় বাংলা , জয় হোক মেহনতি মানুষের ।