এই ঢাকা শহরটাকে এতটুকু ভালো লাগে না আমার। শুধু ধোঁয়া, শুধু ধুলো, শুধু আবর্জনা । তার সঙ্গে চিটচিটে ভিড়, প্রায় স্থবির যানবাহন, ভাঙাচোরা রাস্তা ঘাট, দিনরাত লোডশেডিং, মিটিং মিছিল আন্দোলন, রাস্তার ভিখিরি, নাছোড়বান্দা হকার, ফুটপাতের ঝুপড়ি! এই নরকে যে কী করে থাকে মানুষ। পালাতে হবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালাতে হবে এই শহর ছেড়ে।
একটা জাহাজে আমার সংসার হবে। সামনে থাকবে অপার সমুদ্র। আকাশের রঙ মেখে যার বর্ণ গাঢ় নীল। নীল জল কেটে তরতর করে এগিয়ে যাবে আমার জলে ভাসা সংসার। দুরে, বহু দুরে। চর্তুদিকে কোথাও কোন পাড় নেই, লোকালয় নেই, এমনকী দিগন্ত ও হারিয়ে গেছে সমুদ্রে। জলে জলেই দিন যাবে, রাত আসবে। রাত আসবে দিন যাবে।
বিশ্রী একটা পাতলা পাতলা অন্ধকারে ডুবে আছে চারদিক। বাসায় ফিরেছি খানিক আগে। মাঝে মাঝে এক আধটা জানালা ঠিকরে আলো আসছে। চর্তুদিকের কালোর মাঝে ওই ছোপ ছোপ আলো কী যে অশালীন লাগে! চাপা কোলাহল বিজ বিজ করছে বাতাসে। ব্যালকনির ওপারে মহাকায় মেহগনি আলো ছায়ায় কেমন ভৌতিক লাগছে।
গত এক বছর কত ঝড়ঝাপটা, কত গঞ্জনা সহ্য করে দিনগুলো কাটিয়ে দিচ্ছে অহনা। অথচ একটি বারও অভাব অপমানের কথা তুলে খেদ জানায়নি। আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ ও নেই তাঁর।
আচ্ছা অহনাও কি আমার মতো ভাবে নাকি? দুঃখ কষ্টের দিন মানুষ যদি লড়াই করে পার করে দিতে পারে, তবে সেটাই হয়ে ওঠে মানুষের কাছে সব থেকে সুখের স্মৃতি। লড়াই করে বেঁচে থাকতেই তো জীবনের সুখ। যে জীবনে কোনও ওঠাপড়া নেই, উদ্বেগ দুশ্চিন্তা নেই, সে জীবন হল চেনে বাঁধা কুকুরের জীবন। ও তো পানসে।
আমার বেড রুমের চার দেয়ালে শুধু আমার ছবি। অন্ধকার ঘরে নিদ্রামগ্ন অহনা, দেয়ালের চারপাশ থেকে অশরীরী আত্মার মতো কেবল আমিই ওকে দেখছি। শুধু আমার ছবি গুলো লাগানোর এটাই কারন। অহনা এখনো ব্যাপারটা বুঝতে পারে নি। আমিও কখনো বলিনি। সকালের ঘুমটি আমার বড় প্রিয়। রাতের ঘুম আমার ন্যায্য পাওনা, সকালের টা উপরি। সকালের এই ঘুম হল স্টেশনের টিকিট চেকারদের পকেটে জমে ওঠা খুচরো পয়সা। একে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার কী যে সুখ! এই সুখটুকুর জন্যই এ জীবনে কোন বাঁধা ধরা চাকরি করিনি আমি।
আমার জীবনে নির্দিষ্ট জায়গার প্রতি কোন টান নেই। থাকার কথা ও না। আমার মুক্তোদানার মতো শৈশব কেটেছে কুমিল্লায় ও ফটিকছড়িতে।পান্নারঙ কৈশোর কেটেছে পাহাড়ের হাতছানিতে। প্রথম যৌবনের হীরকদ্যুতি স্বপ্নের শহর মুম্বাইয়ে। তাই ভাগ হয়ে ভালোবাসায় নির্দিষ্ট কোন শহর নেই। ঢাকা শহর ও না।
অহনা অফিসের জন্য তৈরী হচ্ছে। হিজাব পড়তে পড়তে আয়নায় নিজেকে দেখছে অহনা। এলইডি লাইটের এক টুকরো আলো এসে পড়ছে অহনার পাশ – ফেরা মুখে। ওইটুকু রশ্মিতেই অহনার মুখখানি যেন আধফোটা রজনীগন্ধার মতো অমলিন। অহনার মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগে থাকে। যত না কারনে হাসি, তার বেশি অকারণে। অহনা হাসি চাপতে পারে না। অফিসে বেরুনোর আগে রুটিন মতো একটা জাদুকী ঝাপ্পী আর ইচ্ছে করেই কপালে চুমু, ব্যস আমার ঘুম সারা। বাইরে এক কুৎসিত সকাল গোমড়া মুখে প্রতীক্ষায়। সূর্য দেব এরই মধ্যে পূর্ণ মহিমায় ভাস্বর, তবে তাকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। পথচারীদের বিরক্ত দৃষ্টি বার বার আকাশে, দুর থেকে ভেসে আসা ভোটের প্রচার কেমন এক অপ্রসন্ন ভাব গুলে দিচ্ছে বাতাসে। ছেঁড়া খোঁড়া মেঘে ভরে আছে আকাশ। সূর্যতেও কেমন ভেজা ভেজা ভাব। কুয়াশায় সিক্ত গাছপালা একটা গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে বাতাসে।
ইদানীং আর একটা চিন্তা ও হঠাৎ হঠাৎ আমাকে চিমটি কেটে উঠছে। চিন্তাটা গোপন, অতি গোপন। বলতে গেলে চিন্তাটা প্রায় অবচেতনার স্তরে লুকিয়ে থাকে। এই চিন্তার উত্তর খুঁজতে গেলেই মস্তিষ্ক কেমন যেন বাগী হয়ে ওঠে, এক সুপ্ত বিষাদের চোরা স্রোতে ডুবে যেতে থাকি আমি। এই শহর, এই পরিবেশ আরও দুঃসহ হয়ে ওঠে।
মাথার অবশ ভাব যাচ্ছে না কিছুতেই। বুকের ভেতর গভীরে চক্রাকারে ঘুরন্ত চিন্তারা অবশ করছে মগজকে। মুক্তির রাস্তাটা রুদ্ধ।
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছি, চোখ বন্ধ করে ভাবছি সোনালি দ্যুতিমাখা একটা নাক মুখ চোখ, মুখ থেকে আলোর বিচ্ছুরণ, পৃথিবীর বাইরের এক নারী প্রতিমার রুপ। যেন দেবী দূর্গার প্রতিমায় জান দিয়ে দিয়েছে কেউ। পলকের জন্য কেঁপে উঠলাম আমি। ঘরে ঢুকে খাটে বসলাম। রহস্যময় আবছায়া ছড়িয়ে আছে ঘরে। পথঘাটের কোলাহলে এক ধরনের নির্জীব আলস্য। মোটা মোটা বইয়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে ছুটছে বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়ে গুলো, সাথে বাবা মাও। এই ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন যেন ধন্দ লাগে। কোন বাপ মা ই আজকাল একটু খানি আকাশের দিকে তাকানোর ফুরসত দেয় না। সব্বাইকে বড় বড় চাকরী করতে হবে, লাখ লাখ টাকা কামাতে হবে, সব্বাইকে এক নম্বর হতে হবে। আচ্ছা সবাই যদি এক নম্বর হয় তাহলে দু নম্বর, তিন নম্বর হবে কারা? ভাবতেই আমার ধন্দ লাগে পন্ডিত আর বিজ্ঞানীতে গিজ গিজ করছে চারদিক!
রাতে চেম্বার শেষে আমি প্রায়ই চলে যাই নদী পাড়ে। নির্জন নিশুত নদীর সরসর জল কাটে রাতের হাওয়া। একটানা ঝিঁঝির ডাক, টিপটিপ জোনাকির জ্বলা-নেবা, জলের নির্জন শব্দ – তখন মনটা যেন কেমন কেমন করতে থাকে। আকাশ তখন এক অদ্ভুত আলো আধারী হয়ে ছাদ হয়ে ঝুলে থাকে। আধো তন্দ্রা মেখে আমি দাঁড়িয়ে শুনি জলের গান। নদীর কূল ঘেসে ধানের জমি। ধানচারা লকলকিয়ে উঠছে। সতেজ।সবুজ। আমি শস্যের বেড়ে ওঠা দেখি, শস্যের বেড়ে ওঠা নাকি দেখি জীবনের স্তর।বিকাশ। আমার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। সুখের জন্য আমি কখনও লালায়িত ছিলাম না, তাই পূর্ণতায় ও কোনও ঘাটতি নেই। কুয়াশার আস্তরণে দাঁড়িয়ে থাকা নিজেকে বড্ড রহস্যময় লাগে, সম্পূর্ণ অচেনা মনে হয় নিজেকে। আমার এই যে বর্তমান তার জন্য দায়ী কে? ইশ্বর? প্রকৃতি? মানুষ? কে? নাকি আমি নিজে? কিন্তু কেন?
জগৎ সংসারে সব ‘কেন’র উত্তর মেলা ভার। কিছু কিছু ‘কেন ‘নিজেই হাত পা ধড় মুন্ডু গজিয়ে বিকট আকার ধারণ করে। কিছু ‘কেন’র জন্ম হয় সমাজ সংসার মানুষের নিত্যনতুন চাহিদায়। আবার অজস্র ‘কেন’ শুরু থেকেই মোড়া থাকে কুয়াশার আবরণে, শেষেও তাই।
প্রশ্নরা ভাবনার আসতে থাকে। আসতেই থাকে। অবিরল ঢেউয়ের মতো। সামুদ্রিক ফেনা হয়ে প্রশ্নেরা বুকে ছড়িয়ে থাকে।
ইদানিং রাতে ঘুম আসার আগে আমার কেমন যেন একটা হয়। বালিশে মাথা রাখলেই আমার চেতনা বধির হয়ে আসতে থাকে। মনে হয় চর্তুদিক এক গাঢ় কুয়াশায় ছেয়ে যায়, এক পাল মৌমাছি চাক ভেঙে বেরিয়ে এসে মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে, ঘুরতে থাকে, ঘুরতেই থাকে অবিরল।আবছা আবছা দেখতে পাই অহনার মুখ। আশেপাশের শব্দ গুলো নদীতে ডুব দিলে কলরোল যেমন দুরাগত ধ্বনি মনে হয়, ঠিক তেমনিই শুনি আমি। অস্পষ্ট। জড়ানো। বুদবুদের মতো, মনে হয় কোন কিছুই যেন সত্যি নয়, এক্ষুনি বুঝি মিলিয়ে যাবে। তারপর আর হুশই থাকে না। কখনো কখনো মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমি নিঃশব্দে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। বাইরের পৃথিবী এক মলিন জোস্নায় ভরে থাকে। প্রচুর হিম করে, নিঃশব্দে দরজা লাগিয়ে বাথরুমে যাই। প্যাসেজের বাতিটা জ্বালি। প্যাসেজের আলো টেরচাভাবে গড়িয়ে পড়ে অহনার মুখে। সেই আলোতে পরিষ্কার দেখা যায় একটা প্রতিমার শুয়ে থাকা রুপ। পাতলা ঠোঁট দুটো অল্প অল্প কাঁপে অহনার। কোন স্বপ্ন দেখছে কী? সুখস্বপ্ন?
শীতের দুপুর শেষ হতে না হতেই ঝুপ করে বিকেল হয়ে যায়। চেম্বারে যাবো রিকশায় উঠেছি। অল্প দূর গেছি ভোটের প্রচারের জন্য নাকি রাস্তা বন্ধ। ভোট বলে কি পৃথিবীসুদ্ধ সব কাজ বন্ধ হয়ে থাকবে? কে জানে বাবা, এর পর হয়তো কোনওদিন শুনব ভোটের জন্য সূর্যের আলো দেয়া বন্ধ, নদীতে জল বইতে বারণ কিংবা গাছেদের ফুল ফল দেয়া বন্ধ। বিরক্তির একশেষ।
কমলা রঙ সূর্য ক্রমশ সরতে সরতে টুক করে হারিয়ে যায় বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ির পিছনে, অট্টালিকার ছায়া লম্বা হতে হতে একসময় গ্রাস করে নেয় গোটা ঢাকা শহর। সন্ধ্যা নামে। কালচে, বিষন্ন সন্ধ্যা। বাতাস আরো হিম হয়ে আসে। কুয়াশায় ভিজতে থাকে আশপাশ। সোঁদাটে একটা গন্ধ ছড়ায় বাতাস।
হাসপাতালের সিঁড়ি ভেঙে নামার সময়ে বুকে একটা ভার অনুভব করছিলাম। ভার, না শূন্যতা? আমার হৃদয়ে কোন বিদ্বেষ নেই, কারো প্রতি ঈর্ষাও জাগে না, তবু যে কেন এক কুশবনে ছেয়ে যায় বুক? ধারালো কুশের ডগা ছুঁয়ে যায় পাঁজর, রক্ত ঝরে টপটপ। শীতল রক্ত। মাঝখানে কয়েকদিন ঝাঁকিয়ে শীত পড়ল। গাছগাছালি কমে যাওয়া এ শহরে শীত আজকাল এক বিরল ঋতু। ডিসেম্বরে সাইবেরিয়ান হাঁসেদের ডানায় চেপে দুদণ্ড জিরোয় এই কংক্রিটের জঙ্গলে, তারপর জানুয়ারী আসতে না আসতেই কখন চুপিসারে উধাও হয়ে যায়। থার্মোমিটারের পারা নামুক ছাই না নামুক, হিমের গন্ধ পেয়েই শহরের বাবু বিবিরা মহাখুশি। স্বল্প কালীন শৈত্য তারিয়ে তারিয়ে চাখতে ট্রাঙ্ক স্যুটকেস আলমারি খুলে গরম জামা কাপড়ের পাহাড় বের করে, বছর ভর রেখে দেওয়া শাল, পুলওভার কার্ডিগানরাও সূর্যের আলোর মুখ দেখতে পায়।রঙিন শীত পোশাকের বাহারে শহরটাই এখন এক মৌসুমি ফুলের বাগান।
শীত পা টিপে টিপে এগোচ্ছে। চতুর বেড়ালের মতো। চেম্বারের দরজা দিয়ে চোরা বাতাস আসছে একটানা। হিমঋতু দখল করে নিয়েছে ঘরটাতে। দরজা ভেদ করে বুঝি ছুটে এসেছে হিমালয়। ঝনঝন কেঁপে উঠলো হাড় পাঁজড়া। দুর্বল হয়ে যাচ্ছে শরীরের গ্রন্থি। খানিক আগে সোনালী খড়গের মতো চাঁদ উঠেছে আকাশে। নীচে তারই নীলাভ কিরণ। এসব মুহুর্তে মনটা কেমন বিবশ হয়ে যায়। মায়া জাগে। বড় মায়া।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট