জেলহত্যা মামলার খালাস পাওয়া সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও কূটনীতিক এম খায়রুজ্জামানকে গত বুধবার গ্রেপ্তার করেছে মালয়েশিয়ার অভিবাসন কর্তৃপক্ষ। গ্রেপ্তারের বিষয়টি গতকাল বৃহস্পতিবার মালয়েশিয়ার ইংরেজি দৈনিক দ্য স্টারকে নিশ্চিত করেছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামজা জাইনুদিন। তিনি বলেন, ‘একটি অভিযোগ থাকায় খায়রুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ বিষয়ে তাঁর দেশের (বাংলাদেশের) একটি অনুরোধ আছে।
এম খায়রুজ্জামান ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলহত্যা মামলায় খালাস পাওয়া আসামি। তিনি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলেন (২০০৭ থেকে ২০০৯)। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বিচারের মুখোমুখি হতে তাঁকে দেশে ফেরার নির্দেশ দিলেও তিনি ফেরেননি।
দীর্ঘ ১২ বছর পর বাংলাদেশের অনুরোধে মালয়েশিয়া তাঁকে গ্রেপ্তার করায় জেলহত্যা মামলা আবারও পুনরুজ্জীবিত করার ইঙ্গিত মিলেছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম গতকাল ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, খায়রুজ্জামানকে দ্রুত ফিরিয়ে আনতে সরকার কাজ করছে। মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ আছে কি না, স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় তা খতিয়ে দেখবে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘মামলাটি কোন পর্যায় থেকে অথবা আবার মামলাটি কিভাবে পুনরুজ্জীবিত করা হবে বা পরবর্তী সময়ে পদক্ষেপ কী হবে। তাঁকে হয়তো বা জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ’
এক যুগের বেশি সময় ধরে মালয়েশিয়ায় ছিলেন খায়রুজ্জামান। দেশটির পুলিশ গত বুধবার সেলাঙ্গর প্রদেশের আমপাং এলাকার একটি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বুধবারই বাংলাদেশ হাইকমিশনকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, অভিবাসনসংক্রান্ত আইন লঙ্ঘনের জন্য খায়রুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, “মালয়েশিয়ার অভিবাসন ইস্যুতে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়, তাদেরকে নিজ নিজ দেশে ‘ডিপোর্ট’ করার জন্য ‘ডিপোর্টেশন সেন্টারে’ অন্তরীণ করে রাখা হয়। তাঁকেও সেখানে অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে। ”
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, “মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিবাসনবিষয়ক একটি আইন লঙ্ঘনের কথা বলেছে। একটা ‘কোড’ উল্লেখ করা আছে। আমার এই মুহূর্তে জানা নেই। তবে তা অভিবাসনসংক্রান্ত। ”
মালয়েশিয়ায় গ্রেপ্তার খায়রুজ্জামানকে দ্রুত দেশে ফেরার সরকারের উদ্যোগের কথা জানিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমি যতদূর জানি, সেই মামলা (জেলহত্যা মামলা) থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়েছিল। এর কারণ তদন্তের দুর্বলতা হতে পারে, অন্য কিছু হতে পারে—এটা আদালতের এখতিয়ারাধীন, বিচার বিভাগের বিষয়, তাই আমি মন্তব্য করতে চাই না। ’
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক কর্মকর্তা এম খায়রুজ্জামানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জেলহত্যা মামলার অভিযোগপত্রে নাম এলে সে সময় ফিলিপাইনে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে থাকা খায়রুজ্জামানকে দেশে ডেকে পাঠানো হয়। ওই বছর ২৪ সেপ্টেম্বরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে সময় তাঁকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয় সরকার।
তবে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় ফিরলে জামিনে মুক্ত হন খায়রুজ্জামান। ২০০৪ সালে জেলহত্যা মামলার রায়ে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়। তবে মামলা চলাকালেই নজিরবিহীনভাবে তাঁকে পদোন্নতি দেয় সরকার। করা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০৫ সালে তাঁকে মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত পদেও নিয়োগ দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের আগস্টে তাঁকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার করা হয়।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১৩ জানুয়ারি খায়রুজ্জমানকে কুয়ালালামপুর থেকে দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি ওই বছরের ৩ জুলাই পর্যন্ত ছুটির আবেদন করেন। ৪ জুলাই থেকে তাঁর ‘এলপিআরে’ যাওয়ার কথা ছিল। তবে সরকার তাঁর ছুটির আবেদন মঞ্জুর না করে ৮ মার্চের মধ্যে দেশে ফিরতে আদেশ দেয়। এই আদেশ পেয়ে ২৪ জানুয়ারি তিনি দায়িত্ব ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হন। সরকার এরপর তাঁর পাসপোর্ট বাতিল করে।
খায়রুজ্জামানের গ্রেপ্তারের বিষয়ে গত বুধবার টুইট বার্তা দেয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের (এফআইডিএইচ) এশিয়া ডেস্ক। তারা বলেছে, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) স্বীকৃত শরণার্থী খায়রুজ্জামানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তাঁকে বাংলাদেশে পাঠানোর ঝুঁকি আছে। বাংলাদেশে তিনি বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন।
সংস্থাটি খায়রুজ্জামানকে ইউএনএইচসিআরের দেওয়া শরণার্থী পরিচয়পত্রের ছবিও টুইট বার্তায় প্রকাশ করেছে। পরিচয়পত্রটি ইস্যুর তারিখ ২০২০ সালে ২ মার্চ, মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালের ২২ মে।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট