নদের দেখা পেতে পলাশীর প্রান্তরে গিয়ে অনেক খুঁজে কিছু একটা পাওয়া গেল! বদ্ধজলের এই ধারাকে নদ মনে হয়নি একবারের জন্যও। কিন্তু বাসুদেবপুরে গিয়ে গিয়ে সেই ক্ষীণধারাটিও লাপাত্তা।কোন খোয়াব দেখিনি তো! আমার গাইড সুপ্রীতা বলে উঠলেন, এদিকের নদ-নদী এমনই। এই আছে এই নেই। পলাশী হাইস্কুল থেকে বাসুদেবপুর বাজার খুব দুরের নয়। আরেকটু এগুলে আমরা কপোতাক্ষের দেখা পাবো। কিন্তু আজ মাইকেলের নদীর দিকে যাবো না আজ আমাদের গন্তব্য একান্তই হরিহর নদ।
বলা হয় ঝিকরগাছার পাশে জামতলা নামক স্থানে কপোতাক্ষ থেকে হরিহর নদের উৎপত্তি!কথিত উৎসের খুব কাছে চলে গিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু হরিহরের ৩২ কিলোমিটার প্রবাহপথের কথা ভেবে কপোতাক্ষের লোভ সম্বরণ করে এগুনোর সিদ্ধান্ত নিলাম। সুপ্রীতা রায় দত্তের দেওয়া বিবরণ কানে আর আমার জলের চশমা চোখে সেট করে এগুতে থাকলাম মনিরামপুরের দিকে।বাঁশের পাটা আর জেলেদের জালের সুঘন আয়োজন এক বদ্ধজলের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। এ নদ নয় মানুষের নির্যাতনে নিপীড়িত জলের ফসিল।
এরপর চিনাটোলা বাজার। হরিহর এখানে মাছের অভয়ারণ্য! তবে ঘের দেয়া একের পর এক মাছের খামারের ভেতরে কবে কোথায় ডুব দিয়েছিলো নদ এখন জানার কোন উপায় নেই, এখানে ধইঞ্চার বাম্পার ফলন হচ্ছে। আর এখান থেকেই হরিহরের ভেতরে চলে আসছে নতুন নতুন বসতি। নদে বানের বদলে দখলীরা দুইপাশ জুড়ে বসেছে। স্রোতহারা হরিহর ভিক্ষুকের মতো শুয়ে হাত পেতে আছে। তাঁর পাতা হাতের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে মাঝে মাঝে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে নদ খননের জিগির ওঠে। পত্রিকায় ছাপা সংবাদ ছাড়া নদে এই খননের কোন প্রভাব পড়ে না।
আমরা কেশবপুরে চলে এসেছি হরিহরের আত্মা হয়ে। সুপ্রীতা রায় দত্ত এখানে ফেমাস। হরিহরের চেয়েও বেশি। তাঁর পিতা এই থানার বড়কর্তা। নদী সম্পর্কে ভদ্রলোক আমাকে একটা দীর্ঘ লেকচার দিতে শুরু করলেন। তাঁর মতে নদী একটা ক্রিমিনাল। হাতকড়া পড়ানোর জন্য নদীকে অপরাধীর তালিকা থেকে বাদ দেয়া যায় না। তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আমাদের গন্তব্য মঙ্গলকোট এবং চুকনগর। এদিকে কিছু অপরূপ বাঁওর আছে সময়ের অভাবে আমরা বাঁওর ডানে আর বামে ফেলে আপারভদ্রা, হরিহর ও বুড়িভদ্রা নদী তিনটির সংযোগস্থল আবিস্কার করে নিলাম।
বড়েঙ্গার ত্রিমোহিনী হড়হড়িয়ার মুখ। হড়হড়িয়া থেকে উত্তরমুখী হয়েছে হরিহর নদ। খুলনা সাতক্ষীরা সড়ক আর যশোর সাতক্ষীরা সড়কের আশ-পাশ দিয়ে অনেক হেঁটেছে হরিহর। কিন্তু তাঁকে ভালবেসে সকলেই তাঁর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে নিয়েছে। আমার গাইড বারবার জিজ্ঞেস করেছে কি খুঁজছি আমি এই দীর্ঘ ৩২ কিলোমিটার পথজুড়ে। অনেকবার নীরব ছিলাম, ফিরে আসার সময় বললাম আপনার বাবার মতো একটা ক্রিমিনালকে খুঁজছি। তাঁর নাম হরিহর। সুপ্রীতা রায় দত্ত হেসে বললেন, ভাগ্যিস হারানো প্রেমিকার স্মৃতি খুঁজতে আসেননি।
আশেক তো সেই যার মাশেক থাকে দুই চোখের মাঝখানে। আমি জলের আশেক জল থেকে আমাকে কেউ তুলতে পারে না। এরপর অনেকদিন হয়ে গেল হরিহরের সাথে আর দেখা হয়নি।