সম্প্রতি ভারতের লোকসভা জরায়ু ভাড়া নিয়ে সন্তান জন্মানোর আইন পাশ করেছে। ইসলামী সরিয়া মোতাবেক পরিচালিত দেশ ইরানের বহু নারী ক্ষুধার জ্বালা নিবারণের অন্য কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে, জরায়ু ভাড়া দেবার মতো কষ্টকর এবং মানবেতর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সারোগেসির মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুদের কোনো পরিসংখ্যান না দিলেও, এ বিষয়টি এখন অনেকটাই খোলামেলা, লুকানো-ছাপানো কিছু নেই এবং অনেকেই ব্যাপারটি জানেন। ইরানের রক্ষণশীল সমাজে আগে এমনটা ভাবাও কষ্টকর ছিল। অর্থনৈতিক সংকট এবং গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো এর সাথে যোগ হয়েছে অতিমারি, সে কারণে সমাজপতিরাও মুখে কুলুপ এঁটেছেন।
নিউইয়র্ক থেকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্সিয়ান সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে আজকের ইরানের এমন দৈন্যতা প্রকাশ পেয়েছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানি অর্থনীতি ধস নেমেছে, মুদ্রার মূল্য কমে গেছে এবং বেড়ে গেছে মুদ্রাস্ফীতি। ফলে দারিদ্র্য ও বেকারত্বে জীবন অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। চরম আর্থিক সংকট থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে প্রতিদিনই ইরানের প্রত্যান্ত অঞ্চল থেকে জরায়ু ভাড়া দিতে ইচ্ছুক মহিলারা শহরের ক্লিনিকগুলোতে ভিড় করছে। দিনদিনই বাড়ছে তাদের সংখ্যা। আর এমন মানবিক বিপর্যয়কে পুঁজি করে একদল দালাল ‘জরায়ু ভাড়া’র রমরমা ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। মধ্যস্থতাকারী অর্থাৎ দালালচক্র আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ই-কমার্স সাইট এবং অ্যাপ্লিকেশনগুলি কাজে লাগিয়ে বন্ধ্যাত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে ইচ্ছুক ধনাঢ্য দম্পতিদের মনোযোগ আকর্ষণে কোনোই ত্রুটি করছে না। এ ব্যবসায় নিয়োজিত দালালেরা একেকবার সন্তান ধারণের জন্য গর্ভ অর্থাৎ জরায়ু ভাড়া বাবদ সন্তান লাভ ইচ্ছুক দম্পতি, ব্যক্তিদের কাছে ৮ কোটি টোমান অর্থাৎ প্রায় ৩০০০ মার্কিন ডলার থেকে শুরু করে, কখনও কখনও ১৫ কোটি টোমান অর্থাৎ ৫৬০০ মার্কিন ডলারেরও বেশি দাবি করে থাকে। অথচ ইরানে একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি মাত্র ৭৫ মার্কিন ডলারের মতন। ইরানের বর্তমান অবস্থায় এমন মোটা অংকের অর্থ খুব একটা কম নয়। তবে দুঃখের বিষয়, জরায়ু ভাড়া বাবদ অর্জিত অর্থের সিংহভাগ চলে যায় দালালদের পকেটে।
আসল (বায়োলজিক্যাল) মা ছাড়া অন্য মহিলার গর্ভে ভ্রূণ থেকে ভুমিষ্ট হওয়া পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াকে সারোগেসি বলে। আর বিজ্ঞানের আশীর্বাদে এ পদ্ধতি যদিও বন্ধ্যাত্ব মোকাবেলার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতিগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয়। তবে যারা মানবেতর জীবনের তাড়নায় নিজেদের দেহকে এমন একটি দীর্ঘ এবং কষ্টকর প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত করেন, তারা চরম মানসিক এবং শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। অনেকেই আবার এ পদ্ধতিতে একাধিকবার সন্তান ধারণ করছেন। তারা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছেন।
তবে সন্তান লাভে ইচ্ছুক, সন্তান উৎপাদনে অক্ষম দম্পত্তি ছাড়াও জরায়ু ভাড়া করতে উৎসাহী হচ্ছেন অনেক নারীরা যারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উচ্চশিক্ষিত এবং উচ্চপদে চাকুরি করছেন। অর্থনৈতিক সংকট যাদেরকে স্পর্শ করতে পারেনি। সেই সাথে আছে শাররীক সৌন্দর্য সচেতন দেশি-বিদেশী সেলিব্রেটি তারকাদের একটি অংশ।
এককালের সমৃদ্ধ ইরান আজ দারিদ্রতার সাথে লড়াই করেছে। এমন করুন অবস্থার জন্য কে দায়ী? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদেরকে খানিকটা পিছনে ফিরে যেতে হবে। ইরান পারমানবিক বোমা তৈরির উদ্যোগ নিলে, ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় বিশ্বশক্তির (যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি ও জাতিসংঘ) সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করে ইরান। চুক্তি মেনে দেশটি পারমাণবিক কার্যক্রম থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয়। বিনিময়ে তেহরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা ধাপে ধাপে প্রত্যাহারের কথা জানায় পশ্চিমা দেশগুলো। অথচ, ক্ষমতায় আসার পরপরই তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার পূর্বসুরীর অর্জনগুলোর প্রায় প্রতিটিকেই নস্যাৎ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অনেকগুলো চুক্তির মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল ইরানের এই পারমাণবিক চুক্তি, সেখানে পশ্চিমা মিত্রদের বেকায়দায় ফেলে এক তরফাভাবে সে চুক্তি থেকেও তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পিছু হটলেন।
তবে অনেকেই বলেন যে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র শক্তিগুলো পারমাণবিক অস্ত্র হ্রাসে মোটেই আন্তরিক নয়। তাদের অপছন্দের রাষ্ট্রগুলো যাতে এমন বিধ্বংসী অস্ত্রে সমৃদ্ধ না হতে পারে, সেজন্য তারা তৎপর হয়, সে দেশগুলোর বিপক্ষে অবস্থান নেয় এবং জোট বাধে। এমন একচোখা নীতির কারণে পারমাণবিক অস্ত্র হ্রাস সম্ভব হচ্ছে না। এ কথা সত্যি যে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার বিশ্বমানবতাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে। তাই এর বিস্তার রোধে পক্ষপাতহীনভাবে কাজ করতে হবে। সেই সাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের এমন সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হতে হবে এবং দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। সর্বোপরি জাতিসংঘ তথা আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থাকে পালন করতে হবে সক্রিয় ভূমিকা ।
পৃথিবীতে যত রকমের কষ্ট আছে, তার মধ্যে সবচে বড় কষ্ট হচ্ছে ক্ষুধার কষ্ট। যখনি কোন দেশে বা সমাজে প্রাণঘাতী মহামারী, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দুর্যোগ, অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় বা কোনো পরাশক্তি সে দেশটির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ, নিষেধাজ্ঞা জারি করে তখন পুরো দেশ এবং সমাজে তার নেতিবাচক প্রভাব প্রকট হয়। আর প্রথমে আক্রান্ত হয়, পরিস্থিতির নির্মম শিকার হয় সমাজের দুর্বল অংশ- নারী এবং শিশুরা।
বিবেকহীনতার পরিচয় দিয়ে বিশ্বমানবতাকে খণ্ডিত করা খুবই অন্যায়। পৃথিবীর এক অংশের মানুষকে অসুখী রেখে সুখী সাজা এক ধরণের আত্মপ্রতারণা। তাতে আর যাই হোক, সভ্যতার দম্ভ করা যায় না, নিজেদেরকে সভ্য বলে দাবি করা যায় না। মানবতার জন্য চরম লজ্জাস্কর যে একবিংশ শতাব্দীতেও জঠর জ্বালা জুড়াতে পৃথিবীর এক অংশের নারীদের জরায়ু ভাড়া দিতে হয়!
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট