পর্ব-১৬
আমার ইদানিং খুব ছোটবেলার পুরনো জগতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। সেই শাল মহুয়ার জঙ্গলে। পাইন বনে। হৃদয়ের কোমল তার গুলো হঠাৎ হঠাৎ বেজে উঠে টুংটাং ধ্বনিতে। বয়সের সাথে সাথে ছোটবেলায় ফিরে যেতে কি সবারই মন আনচান করে? সেই সময় গুলো কোথায় যে নির্বাসিত হয়ে গেল? আনচান মন নিয়েই বিকেলে চেম্বারের জন্য বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় নামতেই মনটা খুব ভালো হয়ে গেল। চমৎকার এক ঝকঝকে দিন ফুটে আছে বাইরে। বসন্তের রোদের রঙ এত নরম, এত সোনালী হয়! এরকম দিনে মন খারাপ করে থাকাই যায় না। যে কোন ঘ্যানঘেনে ভিখিরিকেও পয়সা দিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। ছোট বেলায় পাহাড়ে থাকার সময় এমন সোনালী রোদে বন্ধুরা হৈ হুল্লোড় করে বেড়াতাম। শৈশবের বন্ধুরা আর কজন টিকে থাকে শেষ পর্যন্ত?? যে কজনই আছে তাদের সাথে আমার সম্পর্ক অবশ্য ততটা ভাঙা নয়, মাঝে মাঝে কথাবার্তা হয়, আড্ডা আর মারা হয়না।
আমার নিত্য একটা রিকশাওয়ালা আছে। চেম্বারে নিয়ে যায় আবার কখনো কখনো ফিরতি পথেও ঠিক আমার জন্য বসে থাকে। লোকটার কন্ঠস্বরে একটা স্নেহ মাখা আছে। কিছু কিছু লোকের কন্ঠস্বরে এত স্নেহ মাখানো থাকে! স্নেহের জাদু সহজেই বশ করে ফেলতে পারে মানুষ কে। লোকটা আমাকে অনেকটা স্নেহের জাদুতে ফেলেছেন।
কৃষি মার্কেটের উল্টোদিকে ফুটপাত দিয়ে একটা মেয়ে অন্যমনস্কভাবে হাঁটছে। এত অন্যমনস্ক যে আচমকা কেউ সামনে এসে পড়লে স্থির দাঁড়িয়ে পড়ছে,ঠিক করতে পারছেনা কোন পাশে সরে জায়গা করে দেবে সামনের পথচারীকে। দু’হাত বুকের কাছে জড়ো, হাল্কা মেরুন সৌখিন পাতলা শাল জড়ানো। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ কামিজের ঝুল বরাবর নেমে এসেছে,দুলছে হাঁটার তালে তালে। প্রত্যেকটি মানুষেরই হাঁটার নিজস্ব ছন্দ আছে। চরিত্র ও। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে প্রতিকূল পরিস্থিতি তে প্রচন্ড রকম ঘাবড়ে যাওয়া একটা মেয়ে। হাউমাউ করে কাঁদে। আমি কেবল ভাবছি এই মেয়েটাকে আগে কোথায় দেখেছি।
সন্ধ্যের দিকে এমনিতেই এদিকে বেজায় ভিড় থাকে। দল বেঁধে সব খায়দায় আর কেনাকাটা করে। রাস্তা পার হচ্ছি তখনই মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। আরে এতো মল্লিকা। আমারই প্রতিবেশী ছিল গত বছর।
ভেঙে চুরে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পর আমার সেই ছোট্ট ঘরের লাগোয়া বিশাল ফ্ল্যাটে থাকতো ওরা। সেই সময়েই আমার জীবনে এসেছিল অহনা। ভয়ঙ্কর দূর্যোগে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগেই শক্ত করে ধরেছিল আমার হাত। তার পর আমি ও নিজেকে তিলে তিলে নিজের মতো করে তুলেছি আবার। অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছি।
ইদানিং ভোরবেলা ঘুমচোখে বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখ দেখতে গিয়ে মনে হয়, এ যেন আমি নই অন্য কেউ। নিজেকে ঝড়ে বিধ্বস্ত ভাঙা মাস্তুলের মতো লাগে।
হপ্তা খানেক ধরে একটা বল্গাছাড়া বুনো রাগ আমাকে আলটপকা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। এই মাথা ঠান্ডা, হাসিমুখে কথা বলছি লোকের সঙ্গে, আবার এই মেজাজ আগুন। এই গত পরশু সন্ধ্যায় অহনা মেসেজ দিল এ্যাই অফিস সেরে ফুচকা খাচ্ছি, ব্যস আমার মেজাজ টং। অকারনে ওর সাথে মেজাজ দেখানো হয়ে গেল। দুদিন অহনা গম্ভীর মুখটা দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কেন অমন মুর্খের মতো ওকে বকলাম? কি দরকার ছিল বেচারীকে বকার? আমার বিধ্বস্ত জীবনের জন্যই হয়তো এই অভ্যাসটার জন্ম হয়েছে। রেগে যাওয়ার। নিজেরই অবচেতনায়।
অহনা নিজেই জানেনা ও আমার একটা নিস্তরঙ্গ পুকুর। আমার খুব মন খারাপ হলে সে পুকুরে ডুব মারলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। আর আমি কিনা ছোট্ট ইঁটের কুচি দিয়ে সে নিস্তরঙ্গ পুকুরের জলকে নাড়িয়ে দিয়ে যাই। এ যে নিজেকেই নিজের কষ্ট দেয়া।
ফাল্গুন পড়তে না পড়তেই বাতাস শিশুর মতো চঞ্চল। কাল রাতে হয়তো রাগ করেই অহনা নিজের ঘরে শুয়ে পড়েছিল। আমি সামনের ঘরে। আচমকা নিজেকে ভীষণ বিচ্ছিন্ন মনে হল। সম্পূর্ণ একা। উত্তাল সমুদ্রে কম্পাসবিহীন দিক্- ভ্রান্ত জাহাজের মতো।
যে মানুষটা আমার শরীর মন সংপৃক্ত করে রেখেছে, কত প্রেম, কত আনন্দ দিয়ে ভরে রেখেছে বিষাদে ভরা আমার মনটা, সেই মানুষটাকে আমি কষ্ট দিচ্ছি?? কেন এমন হয়? হঠাৎ আমার বুকের ভেতরটা এক্কেবারে ফাঁকা হয়ে যায়। হঠাৎ কোন তীব্র আঘাত পেলে বেশ খানিকক্ষণ স্নায়ু অসাড় হয়ে যায়। সেই অসাড়ভাব এক ধরনের নিরাসক্তি এনে দেয় মনে। চিন্তা নৈর্ব্যক্তিক হয়ে পড়ে। আমার ঠিক সে রকমটাই হলো।
আমার একটা ইচ্ছার সাথে আরেকটা ইচ্ছা কেন জানি ঠিকঠাক মিলাতে পারছিনা। কেন যে মিলতে চায় না। দুটো চাওয়া যদি নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু করে তবে মাঝের মানুষটা শুধুই পুড়তে পারে। এ যে এক নিদারুন কষ্টের।
সূর্য হেলে পড়েছে। প্রথম বিকেলের সাদাটে সূর্য। ক্রমশ তাপ ফুরিয়ে আসছে। তবু শেষবারের মতো ভাস্বর। আমার মুখে সেই পড়ন্ত বেলার রোদ। রাস্তায় অবিশ্রান্ত পথচারীদের আসা যাওয়া।
অহনা কে দুপুরে খুব উচ্ছলই মনে হল দগ্ধ দিনের পর বৈশাখের উত্তাপ কমাতে ফিনফিনে বাতাস বইলে প্রকৃতি যেমন দেখায় তেমন লাগছিল ওকে। গত দুদিন অহনাকে মনে হয়েছে নিঃসঙ্গ এক দুঃখের দ্বীপ। অহনা আমার সাথে রাগ বা অভিমান কোনটাই করে থাকতে পারে না। আমার সঙ্গে ঝগড়া হলে সাধারণত অহনাই মিটিয়ে নেয়। হয়তো অহনা ভাবে বাড়ির ভেতর একটা হুতুম প্যাঁচা ঘুরে বেড়াবে, এটা হয়তো ওর কাছে দৃষ্টিনন্দন নয়।
প্রতিটি মানুষই কোন এক নির্দ্দিষ্ট বিন্দুতে এসে নিজের কাছেই অসহায়। আর অহনার সেই নির্দ্দিষ্ট বিন্দুটা আমি। আর ওর হাসি হাসি মুখটাই আমার শেষ গন্তব্য।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট