গত দুই দিনের ধারাবাহিক কিছু ঘটনায় আমার মনে হচ্ছে আমি আইয়ুব খান কিংবা ইয়াহিয়ার শাসনকালে আছি । লেখক মুশতাক ভাই কারাগারে বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন । কি অপরাধ ছিলো তার ? কিশোর একটা কার্টুন এঁকেছিল আর সে কার্টুন শেয়ার করছিল মুশতাক । এ অপরাধে এগারো বার তার জামিন আবেদন বাতিল করা হলো । কোন আইনে বন্দী ছিল মুশতাক ? না কোন হত্যা কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধে ও নয় । ডিজিটাল নিরাপত্তা নামক ঘৃণ্য আইনে । এক তরফা রাতের অন্ধকারে জনগনের ভোটের অধিকার হরণ করে ক্ষমতায় আসা এই সরকার এই স্বেচ্ছাচারী আইন প্রস্তুত করে জনগনের কণ্ঠরোধ করার মাধ্যমে মসনদে বহাল থাকার অলীক স্বপ্ন দেখছে । আইয়ুব , ইয়াহিয়ার শাসনামনলে যেমন পাকিস্তানে ব্যক্তি স্বাধীনতার কোন সুযোগ ছিলনা তেমনি হাসিনা সরকারও সরকারের সাথে সব বিষয়ে একমত নয় কিংবা সরকারের সমালোচনা করছে এমন মানুষের ওপর নির্যাতন শুরু করেছে । বিনা বিচারে মাসের পর মাস কিংবা বছরের পর বছর বন্দী করে রাখা হচ্ছে বিরুদ্ধাচারীদের । অপর পক্ষে খুনি আসামীদের গোপনে ক্ষমা করে বিদেশে উন্নত জীবন যাপনের আয়োজন করছে ।
ছাত্রদের শান্তিপুর্ন মিছিলে সরকারের পেটুয়া পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে নির্যাতন ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে । জিনিস পত্রের দাম আজ জনগনের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে । দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করে জনগনের জীবন যাপনকে দুর্বিসহ করে তোলা হচ্ছে । বিনা বিচারে কোন নাগরিককেই আটক রাখা যায় না , বিচার পাওয়ার অধিকার তার সর্ব্ববাদী স্বীকৃত অধিকার । কাউকে এই অধিকার হতে বঞ্চিত করতে হলে যথেষ্ট সংগত কারন থাকা প্রয়োজন । গত বেশ কয়েক বছরে দেশ যেভাবে উন্নতি করা উচিত ছিল সেভাবে করেনি । আমরা যারা উজ্জ্বল দিন ও সূর্যালোকের স্বপ্ন দেখেছিলাম আমরা সম্পূর্ন মোহমুক্ত হয়েছি । আশাবাদের যে গভীর চেতনা মানুষকে সজীব রেখেছিল তার স্থান দখল করেছে ভবিষ্যতের একটা হতাশাগ্রস্থ চিত্র এবং আশাভঙ্গের চেতনা । দেশের সব থেকে জরুরী এবং গুরুতর সমস্যসমূহ শুধু যে সমাধান হয়নি তাই নয় , উপরন্তু সেগুলি বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আরও প্রকট ও নিয়মিত হচ্ছে । বেকার সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে । দেশের ১ কোটি ১০ লক্ষ প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক , ২ কোটি ৩০ লক্ষ কৃষি শ্রমিক এবং আরো প্রায় ৩ কোটি ২০ লক্ষ অন্যান্য পেশার শ্রমজীবি মানুষের কারো জন্যই আর্থিক , সামাজিক বা স্বাস্থ্যগত সুরক্ষা নিশ্চিত হয়নি । আজকের দিনে ও এদেশের শাসকগোষ্ঠী ধনিক শ্রেণির স্বার্থে লুটেরা ব্যবসায়ীদেরকে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা দিলেও বিদেশ ফেরত শ্রমিক কিংবা করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়াদের কোনো প্রণোদনা দেয় না ।
সাধারণ মানুষ দিন দিন নিঃস্ব হচ্ছে । দেশের ৩% ধনীর বিপরীতে ৯৭% সাধারণ মানুষ । দেশের এক চতুর্থাংশ কর্মক্ষম মানুষের পূর্ণকালীন কাজের ব্যবস্থা নেই । ১৯নভেম্বর ২০২০ জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী , সরকারী চাকরীতে ৩ লক্ষ ৬৯ হাজার ৪৫১ টি শূন্য পদ রয়েছে । দেশের উচ্চ শিক্ষিত যুবদের ৪৭ শতাংশের কাজ নেই । দেশের বিপুল এই কর্মহীন যুবকদের সাথে করেনাকালীন পরিস্থিতিতে যোগ হয়েছে আরো কোটি বেকার । বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলছে, করোনা কালে ২৬ শে মার্চ ২০২০ থেকে ৩১ শে মে ২০২০ এ সময়ে ৩ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছে । কমপক্ষে ১৪ লক্ষ প্রবাসী শ্রমিক বেকার হয়েছে । প্রাতিষ্ঠানিক খাতে ১৩ ভাগ মানুষ চাকরীচ্যুত হয়েছেন । বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে দেশের ৭২% মানুষের আয় কমেছে । জনজীবনের সংকট আরো তীব্রতর হয়েছে ।
এরকম মুল সমস্যার সমাধান না করে জনগণের সংহতির নামে একটি একদলীয় একনায়কত্বমূলক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । নিবর্ত্তন মূলক আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে । ব্যক্তি স্বাধীনতা – যা প্রতিটি নাগরিকের একটি অত্যন্ত সম্মানজনক ও মূল্যবান অধিকার । তাকে সব রকম নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার দ্বারা শেষ করে দেয়া হচ্ছে । সাংবিধানিক ও আইনসঙ্গত বিরোধিতা সহ্য করা হচ্ছে না । রাষ্ট্র ,সরকার ও ক্ষমতাসীন দলকে একাকার করে দেয়া হয়েছে এবং কোন একজন মন্ত্রী কিংবা সরকারের বিশেষ কোন কাজের সমালোচনা করলেই সেটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে রাষ্ট্রের স্বার্থ এবং নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর । এবং এসব কিছুই রাষ্ট্রের নামে করা হলেও আসলে তা করা হচ্ছে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত গোষ্ঠীর নিরাপত্তার জন্য । সংক্ষেপে বলতে গেলে একটি সত্যিকার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সর্ব প্রকার বিরোধী শক্তিকে কারাগারে নিক্ষেপ করে বিরোধীতার কন্ঠকে কার্যকরভাবে রোধ করা হয়েছে । স্বৈরাচারী সরকার যে কোন দেশেরই জনগণের সাথে প্রতারণা ব্যতিত কিছুই নয় ।
মধ্যবিত্ত আজ ত্রাহী ডাক ছাড়ছে । মানুষের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে ।স্কুল ,কলেজ ,বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ভেঙ্গে পড়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা । ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মধ্য আজ সতের কোটি লোক অন্ধকুপ হত্যার কাহিনীর মতো নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মরার উপক্রম হয়েছে । জনগণের মত প্রকাশের অধিকার ও সত্যিকারের গণতান্ত্রিক অধিকার ও রাষ্ট্র পরিচালনাকারী ধুরন্ধর চক্রের অত্যাচার হতে মুক্ত হওয়ার কোন ও পরিষ্কার আভাষ মধ্যবিত্ত দেখতে পারছেনা , দেশের মানুষ দেখতে পারছে না । গোটা বাংলাদেশের অধিকাংশ উপজেলা ও ইউনিয়নে কে যে আওয়ীমী লীগের প্রকৃতপক্ষে নেতা -নেত্রী, সেটা অধিকাংশ জনসাধারনই জানেন না। চেনা তো দুরের কথা। আর চিনবে জানবে কি করে? কোনো সুশিক্ষিত, যোগ্য কিংবা অভিজাত পরিবারের লোকজন তো আর এ দলে থাকেনা। দুনিয়ার যত চোর ছ্যঁচ্চড়, বাটপার, মাস্তান, চাঁদাবাজ দীর্ঘ দিন ধরে হয়ে আছে আওয়ামীলীগের নেতা কর্মী আর ত্যাগী পরিক্ষিত নেতা কর্মীরা নিরবে পড়ে আছেন ঘরে। এলাকায় যাদের দুর্নাম ছাড়া কোনো সুনাম নেই, ভালো মানুষ হিসাবে পরিচিতি নেই, নেই সামাজিক গ্রহনযোগ্যতা তারা এখন যুবলীগ নামে পরিচিত। শুধু তাই নয় এমন কিছু নেতা আছে যাদের উপর পরিবারের লোকজনেরই ভরসা নেই। তাহলে জনসাধারন কিভাবে আস্থা রাখবে?
তৃণমূল পর্যায়ের নেতা কর্মীরা জনগনের সাথে কোন সম্পর্ক রাখেন না রাখার প্রয়োজন মনে করেন না।কেবল উমুক ভাই তমুক ভাই কে নিয়ে মৌজ মাস্তিতে ব্যাস্ত। এখন তো আওয়ামীলীগের লোকজন শোনে না তাদের সুখ দুঃখ। হ্যা একেবারেই যে শোনেন না তা কিন্তু নয় সেগুলো শোনেন যেগুলোতে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকে।। কার জমিতে ভেজাল, কোন সম্পত্তি দেবোত্তর, কোন বাজারে খাস জমি আছে, এগুলো কিভাবে ভোগ করা যায়, কিভাবে অসহায় লোকদের মামলা মোকদ্দমায় ফাঁসিয়ে দখলে রাখা যায় এসব ধান্দা নিয়ে থাকে তারা। ব্যবসা -বানিজ্য আর চাঁদার টাকার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে থাকে তারা।
কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল ছেলপেলকে উসকে দিয়ে এলাকার বয়স্ক মুরুব্বিদের হুমকী দেয়া, স্থানীয় স্কুল আর কলেজে মারামারি পিটাপিটির আয়োজন করাই তো আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ কর্মীদের অধিকাংশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এছাড়া চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, গ্রাম্য সালিশে অন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো এসবই এখন আওয়ামীলীগের কাজ। সাধারন মানুষ এদের উপর চরম বীতশ্রদ্ধ এবং বিরক্ত। তৃণমূল নেতা কর্মীদের আরো একটা কূর্কীতি হলো মোটা টাকার বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট বিক্রি করা। টাকার বিনময়ে পুলিশে লোক নিয়োগ করা, ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়ে চাকুরী ফলে বেড়েছে বিশ্বাস ঘাতকতা, বেঈমানী আর বর্তমান আওয়ামীলীগের ভোট বাক্স আর নিজেদের দীনতা ।
দ্রব্যমূল্যের উধ্বগতি, দলবাজি, অপশাসন সীমাহিন দূর্নীতি, শেয়ার বাজার, হলমার্ক, সোনালী,জনতা বেসিক ও বাংলাদেশ ব্যাংক এর টাকা লুট সব মিলিয়ে আওয়ামীলীগের অবস্থা লেজে গোবরে তাই বিরোধী মতকে দমনের নামে নিত্য নতুন ইস্যু তৈরী করে জনগণকে ব্যস্ত রেখে নিজেদের আখের গোছানোই এখন তাদের কাজ ।
এই ফ্যাসিজম থেকে বের হয়ে আসতে হলে আমাদের প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ জন আন্দোলন । ঐক্যবদ্ধ জনআন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্টার মাধ্যমেই কেবল এই অবস্থা থেকে মুক্তি সম্ভব ।