পর্ব – ২১
বিছানায় উঠে বসে দু-হাতে চোখ ঘসলাম ভালো করে। জোরে জোরে শ্বাস টানলাম। রোজকার মতোই রাতভর বিছানায় এপাশ- ওপাশ করে কখন যেন ভোরের মুখে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ঘুম ভাব। অনিদ্রার ক্লান্তি এখনো ছড়িয়ে আছে চোখের পাতায়। শরীর নতুন করে বিছানায় গড়িয়ে পড়তে চাইছে। পূবের জানালা দিয়ে ওই যে শৈশবের মতো নিষ্পাপ নতুন সকালটা এক মুঠো নরম আলো ছড়িয়ে হামা টানছে ঘরের মেঝেতে। ওই আলো প্রবীন হওয়ার আগেই রেডি হওয়া দরকার। বলা যায়না ভোরের ইচ্ছে বেলা বাড়লে হয়তো ফুরিয়ে যেতে পারে। ধীর পায়ে মুখ-চোখ ধুয়ে এলাম বাথরুম থেকে। কি অদ্ভুদ নিরবতা ঘরটা জুড়ে। ভুতুড়ে রকমের থমথমে। একটু চা খেলে মন্দ হতো না। রোজা রেখেছি তাই খাওয়া যাবে না।
সিগারেট টা ছাড়ব ছাড়ব করে ও ছাড়া হচ্ছে না তবে কমিয়ে দিয়েছি।
আজকাল অকারনে মনটা হু হু করে। মনটা অকারনে ভারী হয়। কে’ই বা কবে আমার জন্য কিছু করেছে? যারা আমার জীবনটা এলোমেলো করলো তারা হয়তো ভালো আছে তাদের ছেলে, তাদের মেয়ে, তাদের নিজস্ব সুখ দুখ নিয়ে হয়তো ভালোই আছে।
আমার এ নিয়ে কারো উপর কোন অভিমান আর অভিযোগ নেই। উলটো একটা জেদ ছিল। তাদের থেকেও ভালো থাকবো। আমার জীবনটা এমনই। সবার জন্য প্রানপনে খেটে যাওয়া। আমার শরীর, শরীর নয়। মনটাও মন নয়। এ নিয়ে আমার আপসোস নেই। তবুও কেন যে ইদানিং বুকের ভেতর একটা গোপন কান্না দানা বাঁধতে চায়। বড় অর্থহীন মনে হয় সবকিছু। কার জন্য? কীসের জন্য খেটে মরলাম এতগুলো বছর?
বৃথাই মানুষ ভাবতে ভালোবাসে তাকে ঘিরেই পৃথিবী চলছে। তার জন্যই সূর্য উঠছে। চাঁদ ডুবছে। তার জন্যই বেঁচে আছে প্রিয় পরিজন। ভুল ভুল। এ এক ভয়ানক নিষ্ঠুর ভ্রান্তি!
কারো জীবনে আমার জায়গা কি ছিল? জায়গা কি আদৌ ছিল? সংসারে? বাইরে?
নিজের টুকিটাকির দিকে তাকালে বুকটা হু হু করে। সব গেল। এখন আর কেউ তেমন মনে করেনা। এরকমই তবে হয়। এভাবেই সময়ের সাথে সাথে বিস্মৃত হয় সব কিছু। নিজেদের বিশেষ বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া আজকাল আমাকে কারো মনে পড়েনা।
এই যে যাদের সাথে এতো কালের বসবাস, সুখ দুঃখ হাসি কান্না ভাগ করে নিয়েছিলাম নিজের মতো করে। যাদের ছাড়া আর কাউকেও কখনো ভাবতে চাইনি। তারাই তো সবার আগে নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে কেটে পড়লো।
মাঝে মাঝে বুক জুড়ে হাল্কা কুয়াশার মতো ভেসে বেড়ায় শূন্যতা। সব কিছু কেমন নিবে গেল এক ফুঁয়ে।গত কিছুদিন আগেও আমি এক অন্য আবেগে আচ্ছন্ন ছিলাম। সে আচ্ছন্নতায় শূন্যতাবোধ ছিল। শূন্যতাবোধ? নাকি হাহাকার? হারিয়ে যাওয়ার। ফুরিয়ে যাওয়ার। বাতিল হয়ে যাওয়ার।
আজকাল কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না। এই যা বলি দু একটা। না বলা কথারা কি দুমড়ে মুচড়ে ওই দুই একটা কথা হয়ে যায়? না কি যে কথা না বলা থেকে যায়, সে কথা নিজে নিজেই মরে যায় একদিন?
কী জানি???
লক ডাউন চলছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ওপর থেকেই বৃষ্টির গন্ধ পেলাম। ঠান্ডা বাতাস গায়ে এসে লাগে। গাড়ি বারান্দায় এসে বাইরের ঝিরিঝিরে বৃষ্টি একটুক্ষণ দেখি। মনে হয় আকাশ থেকে ছোট ছোট কাচের টুকরা ছড়িয়ে পড়ছে রাস্তায়।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখছি আমি। কাকের পাখার মতো অবসাদ নেমে আসে শরীর জুড়ে। বাড়ীর দেয়ালের কোনও গোপন কোনে যেমন হঠাৎ উঁকি দেয় এক অশ্বত্থ চারা। কেউ লক্ষ্য করেনা। ওই ভাবেই অলক্ষ্যিতে শুরু হয় একটা বাড়ির ক্ষয় নিজের ভেতর সেই অশ্বত্থের গোপন চারাটি খুঁজছি কিছুদিন ধরেই। অনুসন্ধান করছি। কোথায় সে চারা? খুঁজে পাচ্ছি না।
আমাদের গ্রামের বাড়ীতে একটা মস্ত পুকুর আছে, দিঘির মতো। তার এপার ওপার দেখা যায়না। তার জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে খুব। বর্ষায় জল উপছে রাস্তায় উঠতো। অনেক জল। অথৈ জল। দেখতে দেখতে নেশা ধরে যেত।
দুরে কোথাও মেঘ গর্জনের মতো শব্দ হয়। বিদ্যুৎ চমকায়, মেঘ মাটি কেঁপে ওঠে। ঘরে ফিরে আসি। অহনা চুপচাপ শুয়ে আছে। বিড়বিড় করে কী যেন বলে ঘুমের ঘোরে। কী বলে? বোধ হয় জীবনের অনিত্যতার কথা নিজেকে শোনায়।
রাত বেড়ে যায়। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে। ঘুম হয় না। অপলক চেয়ে থাকি, সোনালী দিনের বাঁধানো ফটোফ্রেমে নিজের মুখ। ইদানিং আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজের প্রতি খুব মায়া লাগে। সাধু হয়ে যাচ্ছি মনে হয়। এখন কেবল রুদ্রাক্ষের মালা, কম্বল, চিমটে আর গাঁজার কলকে দরকার। আমি সন্নাসী আর অহনাকে সন্নাসিনী বানিয়ে কুষ্টিয়া চলে যাই। বিশাল এই শহরটা আমার চোখে খুবই ফাঁকা ও অর্থহীন লাগে। অবধারিত মৃত্যুর হাতছানির এই শহরে ফাঁকা লাগারই কথা। জীবনটা যাদের আত্মরক্ষার কাজেই কেটে যায় তারা পৃথিবীতে কোনো ঘটনাই ঘটাতে পারে না, তারা কেবল নানা ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে মাত্র। বেঁচে থাকাটা এক-একজনের এক-একরকম। আমি কেন বেঁচে থাকতে চাই? কার জন্য? অহনার জন্য? রোগীদের জন্য? পরিবারের জন্য? কিছুই ভেবে পাইনা। মাঝে মাঝে কেবল মনে হয়, কয়েকটা প্রতিশোধের জন্যই বেঁচে থাকা বুঝি! কিন্তু কোথাও আমার আঁচড় কামড়ের দাগ বসছে না। বড় আলগা ভাবে লেগে আছি পৃথিবীতে।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট