পর্ব – ২৪
ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছি। অহনা অফিস থেকে ফেরেনি। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। ইদানিং কেন জানি না চোখ বন্ধ করলেই টুকরো টুকরো পুরনো কথা মগজে ঘুরতে শুরু করে, মগজের ভাঁজে স্মৃতির যে ডাইরী সযতনে রাখা আপনা আপনি উল্টাতে শুরু করে অনাকাঙ্ক্ষিত পাতা গুলো। সুখে থাকা মানুষের ভাগ্য। সুখতো চিরকাল এক মাত্রায় থাকে না। দু’জন মানুষের ছোটখাট বিরোধ তো অনিবার্য ভাবেই হয়ে থাকে। সেটা যত চটপট মিটিয়ে নেয়া যায় তত সম্পর্ক ভালো থাকে। আমি পারিনি। পারা সম্ভব ছিল না তাই।
আপনাআপনি আমার ঠোঁটের কোনে বিচিত্র এক হাসি ফুটে উঠলো। নারী। নেশা। আবেগ।রিপু।নিয়তি। নারী কখনো সুখ দিয়েছে, আবার নারীই কখনো করেছে বিষন্ন, আবার কখনো সব কেড়ে নিয়ে করেছে শূন্য, রিক্ত। দিল্লীর স্কলারশিপ শেষ হওয়ার পর মুম্বাইয়ে থাকার সময়ই ইয়াহু মেসেঞ্জারে একদিন রাতে টুং করে কারো আহবান। কথোপকথন শুরু। অদ্ভুত এক বুনো আকর্ষন ছিল তার মধ্যে। জন্তুর মতো আঁচড়ানো কামড়ানো ভালোবাসায় জড়িয়ে গেলাম। বিয়ে হতে না হতেই সেই মানুষটার মুর্তি বদলে গেল আমুল। সহজভাবেই একদিন দাঁড়ি টেনে দিল সম্পর্কে। আসলে ঠিক ভালোবেসে আমার জীবনে আসেনি সে। আমি ছিলাম তার প্রয়োজন কিংবা ক্ষনিকের অবলম্বন।তার আর আমার সম্পর্ক টা ছিল ক্ষীণ। পুরোপুরি মরা নয়। বহতা ধারায় জল ছিলনা, ছিল বালি। হয়তো বা কিছুটা কাদাও। ঘৃণা আর ভালোবাসার মিশ্রণে মজে আসা সে সম্পর্কের চেহারা ছিল একটু বা অপ্রাকৃত।
আদতে কোন সম্পর্ক কি ছিলো? হাসপাতাল চেম্বার করে মাঝরাতে বাসায় ফেরা। এক বিছানায় দুজন দুদিকে মুখ করে শুয়ে থাকা। শুধু এইটুকুতে কতটুকু টিকে থাকে সম্পর্ক? অবিশ্রান্ত একঘেয়ে এক সংসার জীবন। আমার মুখখানায় একটা পাতলা বিষাদের মসলিন লেপে থাকতো, কেউ কখনো টেরই পেত না। ক্রমশ মরে যাচ্ছিল মনটা। মনের আবার দোষ কী, যা উৎপীড়ন চলেছে মনের ওপর। বুকের গভীরে ছিল পাহাড়ের ভার। তছনছ হয়ে গেল সব। নেশাগ্রস্তের মতো টলতে টলতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছি, কী ঝকঝকে নীলাকাশ। মানুষ যা চায় তাই কি ঘটে সর্বদা? যদি বা ঘটে তাতেই কি ভাঁড়ার ভরে পুরোপুরি? ভালোবাসা জিনিসটা সঠিক হিসেবে আসে না। সকলের ভালোবাসা কি সকলের মাপ মত হয়? বৃথা এক ভালোবাসার রক্তস্রোত এক গোপন ক্ষতস্থান থেকে ড্রিপ ড্রিপ করে ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে যাচ্ছে। তার সামনে অঞ্জলি পেতে কে ভিক্ষে করছে? কে পান করছে পিপাসার্তের মতো? কেউ না।
সিগারেট ধরিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছি। ফাঁকা ঘরটা কি ভীষণ বিষন্ন লাগছে। রোদ-মরা আলোয় ঘরটায় ঘুলিয়ে উঠছে অন্ধকার। মনে পড়ছে অহনাকে প্রপোজ করার দিনের কথা।
সূর্য ডুবছে। শেষ বিকালের আকাশ প্রায় বর্ণহীন। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি অহনার দিকে। তির তির সুখ কাঁপছে অহনার দু-চোখ। ওই কাঁপন ছড়িয়ে পড়ছে আমার বুকে। শিরায়। উপশিরায়।
অহনা শক্ত করে ধরে আছে আমার হাত। বুঝতে পারছিলাম না কোনটা ভালোবাসা?
প্রাণপনে শুধু নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছি, কিছুতেই যেন কেঁদে না ফেলি। সাত মাস আগের সেই কান্নাটা কি এখনও রয়েছে বুকের ভেতর? গলার কাছে তবে এত বাষ্প জমেছে কেন? ঢোঁক গিলতে কষ্ট হচ্ছে।
অহনা এক দুষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার মুখপানে।
একটু এগিয়ে এসো তো? আমি তাকিয়ে দেখি ওই স্থির তাকিয়ে থাকা মুখ যেন একদম অপরিচিত ।
-কী হলো এসো!
মনে হল কোন নারী কন্ঠ নয়। সাপুড়ের বাঁশি ডাকছে যেন সাপিনীকে। পায়ের তলায় ছড়িয়ে যাচ্ছে স্পন্দন। সব ওলটপালট হয়ে গেল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে চলেছি। চর্তুদিক আবছা হয়ে এল। বিশ্বসংসার, আমার কষ্ট বেদনা আর একাকীত্ব সব ভেসে গেল। অহনা টুপ করে জড়িয়ে ধরলো আমায়। শরীরের সমস্ত রোমকুপ যেন খুলে গেল। লক্ষ কোটি সরোদ বেজে উঠল শিরা -উপশিরায়।
নিষ্পলক দৃষ্টি আমারই চোখে স্থির। চেতনা ক্রমে অবশ হয়ে আসছে। সম্বিত ফিরতে মনে হল পৃথিবীর বয়স বেড়ে গেল কয়েক হাজার বছর। অথবা কয়েক মুহুর্ত মাত্র। আমিও দুহাত বাড়িয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিলাম অহনাকে। প্রবল ভূমিকম্পের পর মাটি শান্ত হচ্ছে যেন। রাত এখন বড় মায়াময়। চাঁদের বুড়ি রুপোলী সুতো কেটে চলেছে চরকায়। সেই সুতোয় বোনা মসলিন এখন ভাসছে চরাচরে। রুপোলী সর মেখে ছুটছে অলৌকিক গাছপালা, ছুটছে মাঠ, ছুটছে নদী, ছুটছে বালির চর।
জোস্না মেখে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর অহনা। আলতো বাতাস বইছে। সে বাতাসে ভেসে রইল অহনার গলা, চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি । ঢপের কেত্তন নয় তো? সত্যি বলছো বিয়ে করবে আমায়? আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম -পারবে তো?
অহনা হাত বোলাচ্ছে পিঠের মাঝখানটায়। আঙুল নড়ছে পিঠে? নাকি যাদুকাঠি? কুহকিনীর মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে দেহ। হৃদপিণ্ড অসাড়। মায়াবী ছোঁয়ায় এইভাবেই কি স্বরযন্ত্র রুদ্ধ হয়ে যায়?
আমি টের পাচ্ছিলাম ভালোবাসি বলার থেকেও ভালবাসি না বলাটা অনেক অনেক বেশী কঠিন।
কেন যে কঠিন?
অহনা এখনো অফিস থেকে ফেরেনি। উঠে গিয়ে ফ্রিজের ঢালা খুলে ঢকঢক করে ঠান্ডা জল ঢাললাম
গলায়। ক্রমশ এক ভরভরতি ঝিম ভাবে ছেয়ে আছে শরীর। ফোঁটা ফোঁটা আলস্যের তৃপ্তি স্ফটিকের দানা হয়ে গড়াতে থাকে বুকের অন্দর মহলে। এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। গত দু’মাস ধরে সারাদেশে লকডাউন চলছে। কোন কাজ কর্ম নেই। চেম্বার বন্ধ। আয় রোজগারের বালাই নেই। কিন্তু এভাবে আর চলে ক’দিন। মানিব্যাগে টান পড়তে শুরু করেছে। গত ক’দিন ধরে সূর্য দেব পূর্ণ মহিমায় ভাস্বর। জ্বলন্ত আগুনের পিন্ড মেঘনাদের মতো তাপ নিক্ষেপ করে চলেছে।কবির ভাষায় যাকে বলে দারুন অগ্নিবাণ। তাপের সঙ্গে সারাদিন গরম শুকনো বাতাস, হঠাৎ সেই হাওয়াটা বন্ধ হয়ে গত তিনদিন ধরে এসেছে এক অসহ্য বাষ্পময় গুমোট। সূর্য উঠতে না উঠতেই গুমোট শুরু হয়ে যায়, সারাদিন ঘামভেজা শরীরে হাঁসফাঁশ করে মানুষ। আজও আকাশের সেরকমই মতিগতি। চিট পিট গরমে ঘাড় গলা ভিজে যাচ্ছে, বনবন পাখার নীচেও চ্যাট চ্যাট করছে গা।
একটু ঢুলুনি মতো হলো। তবে ঘুম আসছেনা। কিবা দিন কিবা রাত আমার ঘুম বড় বালাই। আসে,আর এসে এসে পালায়। ঘুমানো আর জেগে থাকার মাঝে যে একটা বড়সড় এলাকা আছে, এটা এখন টের পাই আমি। কী আর করা। এখন দিন কাটে রাতের প্রতীক্ষায় আর রাত কাটে দিনের। দিন মানে খিদে তেষ্টার লড়াই। দয়া আর করুনা পাওয়ার জন্য খামচাখামচি। রাত হল গিয়ে শ্বাস টিকিয়ে রাখার মহাসংগ্রাম এই বুঝি বেরিয়ে গেল প্রাণবায়ু! কী জীবন! অহনা আড়াইটা নাগাদ বাসায় ফেরে। বহু বছর আগে আব্বার চাকুরী সুবাদে থাকা সরকারি বাংলোর ছাদে সোঁদাটে একটা গন্ধ পেতাম, তখন আমি বুক ভরে সে ঘ্রাণ নিতাম। গত কয়েকদিন ধরে মাঝরাতে আমি সে ঘ্রাণ পাই। রাত হলেই এক গাঁধা ভাবনা এসে জড়ো হয় মগজে। আঁধারের একটা নিষ্ঠুর সম্মোহনী শক্তি আছে, রাত বড় অলীক ভাবনা ভাবায় মানুষকে। দিনের আলোয় ভাবনাকে কাজে পরিণত করা যে কী কঠিন! দিন বড় কঠোর বাস্তব।
সামনে ঈদ, মাস পেরুলেই ঘর ভাড়া, সংসারের খরচ। যে কয়টা টাকা আছে, এতোই কম। যে সমুদ্র বাঁধার জন্য কাঠবেড়ালির মুখে বয়ে আনা নুড়িপাথর।খুট করে একটা শব্দ হলো বাইরে। অহনা এলো নাকি! না অহনা এলে তো দরজার লক খুলে নব ঘুরিয়ে দরজা খুলত। একটা অন্য রকম আওয়াজ হয়। অমন খুট করে আওয়াজ হয় না। কয়েক সেকেন্ড কান পেতে রইলাম। আলগা হিসেব কষছি মনে মনে। এক ছোট ভাই কিছু টাকা পাঠিয়েছে। দুঃশ্চিন্তা উদ্বেগের মধ্যে ও হাসি পেয়ে গেল। এভাবে বিন্দু বিন্দু করে টাকা সংগ্রহ করেই বা কতদূর পৌছনো যায়। লোকে কথায় বলে রাই কুড়িয়ে বেল, সত্যি সত্যি কি কেউ কুড়িয়ে দেখেছে? কোনখান থেকে টাকা আাসার কোন ব্যবস্থা নেই। ঠুঁটো হয়ে বসে আছি। ঠিক ঠুঁটো হয়েও নয়, নিশ্বাস বন্ধ করে। মানুষ যেভাবে জলের তলায় নাক টিপে ডুবে বসে থাকে, অমেকটা ঠিক সেরকম। জলতলের নীচে দৃষ্টি বেশী দূর যায় না, মনে হয় সবই যেন এক শ্যাওলাটে আস্তরণে ঢাকা। এখন আমার পৃথিবী ও যেন ঠিক তেমনই। হাসপাতাল, চেম্বার, সংসার সবই চোখের সামনে অথচ যেন কিছুই নেই।
গত কয়েকদিন ধরে শরীরে তীব্র এক দমচাপা ভাব ফুলিয়ে দিচ্ছে ফুসফুস, অসহ্য কষ্টে আঁকুপাঁকু করছি। জল তল থেকে মাথা তোলারও উপায় নেই, প্রতি মূহুর্তে আশংকা এই বুঝি ধেয়ে আসছে অদৃশ্য করোনা নামের আততায়ী। গত কয়েকদিন বেশী বেশী লোক আক্রান্ত হচ্ছে আবার মরছেও বেশি। তবু মনে ক্ষীণ আশা, অলৌকিক কিছুই কি ঘটেনা পৃথিবীতে? এমনতো হতে পারে কাল সকালেই হয়তো শুনবো করোনা তার সব শক্তি হারিয়ে সাধারন সর্দি জ্বরের ভাইরাসে পরিণত হয়েছে? চরম অভাবে পড়ার আগে সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। অসম্ভব কি কখনও সম্ভব হতে পারে না আমার জীবনে??
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট