পর্ব – ২৩
বাইরে এখনও বিকেল। রোদ মরে গেছে,তবে তার সোনালী আভা পুরোপুরি মিলোয়নি। আমার বাসার অন্দরে অবশ্য তা টের পাওয়ার উপায় নেই, ঘরে ঘরে দ্রুত দখল করে নিচ্ছে অন্ধকার। শহরের এই প্রান্তটায় এখন কেবল কংক্রিটের জঙ্গল।সর্বত্র কেবল বাড়ী আর বাড়ী। আশে পাশের বাড়ীর খাড়া পাঁচিল যেন বুক চিতিয়ে আলো বাতাসকে শাসায়।
এক কাপ চা খেতে পারলে ভালো হতো । বাইরে বেরুতে ও মন চাইছে না। বাইরে গুমোট গরম। বৃষ্টির দেখাই নেই। মাঝে মাঝে আকাশ মেঘে ছেয়ে যায় ঠিকই, শুধু মেঘই সার, ভ্যাবসা গুমোটে বৃষ্টি যেন উবে যায়।
অহনার অফিস থেকে ফেরার সময় হয়ে গেছে। চোখের কোণে ভাসে বিয়ের আগের স্মৃতি। অহনার ক্ষনে ক্ষনে এসএমএস, মাঝরাতেও মোবাইলে টুংটাং কিংবা ভিডিও কল। এখনও এই সদা ব্যস্ত, নিষ্ঠুর প্রতিযোগীতার দুনিয়ায় আকন্ঠ ডুবে থেকেও সেই অস্থির প্রেম টাকে বাঁচিয়ে রেখেছে অহনা। ভাবলে একটা আলাদা গর্ব হয় বৈকি। অহনা এমনই এক বিশেষ নারী, যার অমোঘ টানে আমি বাঁধা পড়ে আছি।
শুধু শরীর নয় আরো অনেক কিছুই পাই তার কাছে, এক মায়াবী জাদু, এক অজানা রসায়ন….। এমনি এমনি কি শত কাজের মাঝে মনে পড়ে মুখখানা? কী অপূর্ব শিহরন যে জাগে তখন!
শুক্রবার এলেই সে খুশীতে আহ্লাদে আটখানা। অফিস নেই। অনেক বেলা অব্দি আমার ছড়িয়ে থাকা হাতে আলগাভাবে ছুঁয়ে শুয়ে থাকা। ঘুম না এলেও শুয়ে থাকবে। এ স্পর্শটুকুই নাকি ওর সম্পদ।
আমাদের ছোট ঘরটায় ওর এ যেন এক নরম সুখ।
কী যে ছাই হচ্ছে, আবহাওয়ার কোন ছিরিছাঁদ নেই।এত যে গরম গা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। গোটা পৃথিবীরই নাকি উঞ্চতা বাড়ছে। এবার তো কংক্রিটের জঙ্গলে টেরই পাইনি বসন্ত কে। তেলে ধূলোয় মলিন গাছে দু,চারটে ফুল ফুটেছিল বটে, ব্যস ওই পর্যন্তই। আমার ফ্লাটের পেছন দিকটার ব্যালকনিতে দাঁড়ালে খুব প্রশান্তি লাগে। কংক্রিটের জঙ্গলে এক টুকরো সবুজের ছোঁয়া আছে। কয়েকটা নাম না জানা পাখিও ডেকে যায় মাঝে সাঝে। দখিনা বাতাস যদিও বা আসে এদিকে ঠেকে ঠেকে ইট লোহায় ঠোক্কর খেতে খেতে।
শুনেছি বঙ্গোপসাগরে সুপার সাইক্লোন আম্পান ধেয়ে আসছে,মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। সেই সাইক্লাোনের প্রভাবেই গুমোট গরম গত তিনদিন ধরে। করোনা আক্রান্তের সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে আজ, ষোলোশো ছাড়িয়েছে, সাথে মৃত্যুর ও একুশজন মরেছে আজ। বাঙ্গালী জেনে শুনেই মহামারীর দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। লক ডাউনের কোন ছিরিছাঁদ নেই। যা আছে তা কেবল নাম মাত্র। লোকজন জটলা করছে, দল বেঁধে শপিং করছে, পাড়ার চায়ের দোকানে পাড়ার বুদ্ধিজীবিরা টেবিল থাপড়ে আড্ডা দিচ্ছে।
কতদিন গোধূলি দেখিনা। ভালো সময়ে রোজ এই সময়টায় চেম্বারের জন্য বেরিয়ে পড়তাম। এখন এই সময়ে আমার মনটা ম্যাদাটে মেরে থাকে। কত দিন দেখিনা গাছের ফাঁকের সেই খুনখারাপি সূর্যাস্ত। সূর্যাস্ত দেখলে যে মনটা ভালো হয় তা কিন্তু নয়। মুম্বাইয়ে থাকার সময় সূর্যাস্তটা ভারী নির্জন, ভারী নিস্তব্ধ ছিল। এখনো সেই সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে বরং পুরোনো ক্ষতে টাটানো ব্যাথা হয়। একটা দুটো সূর্যাস্ত তো সকলের জীবনেই ঘটে।
এই যে নিস্তরঙ্গ জীবন এবং সামন্য পুঁজি নিয়ে বেঁচে আছি এও আমার কিছু খারাপ লাগেনা। গাড়ী, বাড়ী, তাগড়া ব্যাংক ব্যালেন্স কি ছিলো না আমার। কিছু মানুষের নিখুঁত ধোকা, প্রতারণার ফাঁদে পড়ে আজ অহনা ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। একটা হোন্ডা ভটভট করে পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল, পেট্রোল পোড়া গন্ধে রাস্তাটা ভরে গেল। পেট্রোলের পোড়া গন্ধে একটা মাদকতা আছে। গন্ধটা বরাবরই ভালো লাগে আমার। মন চনমন করে ওঠে। ইদানিং ঘুমাতে গেলেই মনে হয় একটা জেটিতে আমি একা শুয়ে আছি সামনে প্রকান্ড নদী দিগন্ত পর্যন্ত, নদীতে বিন্দু বিন্দু আলো, জেটির গায়ে জলের শব্দ, আমার সামনে ভীষণ অন্ধকার। কেন এমন মনে হয়? একি মৃত্যুর প্রতীক? নাকি নস্টালজিয়া? চোখ বু্জলে স্বপ্নে বড় জ্যাঠাদের ছাড়া বাড়ী, গাছের তলায় শ্যাওলা গজাত, সেই ঠান্ডা জায়গাটা দেখি। ঘুম ভাঙলে সকাল বেলা গ্রামের বাড়ীর পুকুর ঘাটের কথা মনে পড়ে। খুব বড় বড় কচুপাতা বাতাসে নড়ত। মাছ ফুট কাটত জলে। সেই পুকুরে আমরা ডুব সাঁতার কাটতাম। সেই পুকুরের জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে বড্ড ইচ্ছে করে।
আমার ছেলেবেলা কেটেছে পাহাড়ে।চারদিকে ঘন গাছের বেড়াজাল, বৃষ্টি হতো খুব, আবার রোদ উঠলে নাম না জানা পাহাড়ী পাতার মাতলি গন্ধে ম -ম করতো বাতাস! রাতে ফেউ ডাকত,শেয়াল কাঁদত, আমাদের বাংলো বাড়ীর আশেপাশে আনাচে-কানাচে এঁটোকাঁটা খেতে আসত শুয়োরের মতো মুখওয়ালা বাগডাশ। ঝিঁঝিঁর ডাক রাতের অরণ্যকে গভীর করে তুলত। শীতকালে পড়ত অসহ্য শীত, মাটির তাপ কুয়াশার মতো হয়ে বর্ষাকালে আড়াল করত। আহা কি দিন ছিলো সে সব।
সূর্যের শেষ আলো সিঁদুর -গোলা রঙ ঢেলেছে রাস্তায় রাস্তায়। বাড়ী গুলোর গায়ে সেই অপার্থিব রঙ।রাস্তায় যাকেই দেখছি মনে হচ্ছে মুখে সঙ্কোচ, দ্বিধা, যদিও হাসে ভয়মিশ্রিত বিনয়ী একটু হাসি, আত্মবিশ্বাসের অভাব। দু’মাসের লক ডাউনে মধ্যবিত্ত নেমে এসেছে নিম্নমধ্যবিত্তে। দুঃখের কথা শোনার মতো ধৈর্য্যশীল কান তো আজকাল পাওয়াই যায় না। মানুষের মধ্যে একটা ছাপা অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে ।
শহরের মানুষ এবার ঈদ করতে গ্রামে যেতে পারবে না। গ্রামের মানুষ এখন আর শহরের লোক গ্রামে যাক সেটা চায় না। সন্দেহ করে। ভাবে করোনা রোগী পালিয়ে এলো বুঝি। আমার আজকাল একটু আধটু ভয় করে। অস্বস্থি ও লাগে। এই যে ভয় আর অস্বস্তি আমার ভেতর ঢুকে গেছে গত কয়েকদিনের আয় ব্যয়ের অসঙ্গতি। সারাদিন ভিখিরির চিৎকার শুনি, মেঘহীন আকাশে সূর্যের আলোর তীব্রতা দেখি। ভয় পাই। ভিখিরির চিৎকার মন দিয়ে শুনি আর অনুভব করি এক অজানা দহন। শরীর জ্বলে, হাত পা নিসপিস করে। কি করব তা ভেবে পাই না। আগুনের মতো হালকা বাতাস মানুষকে নির্জীব করে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বাইরে। বারান্দায় দাঁড়িয়েও আমি অনুভব করি দমবন্ধ বায়ুহীনতা। বাতাসের হলকা বুক পর্যন্ত সব রস শুষে নিচ্ছে। রোদের থাপ্পড় চড়াৎ করে মুখে এসে পড়ে। চোখ জ্বালা করে।
মানুষের মুখ নাকি তার মনের আয়না? কই, আমার হাসি হাসি মুখটাতে কি লোক আমার দুঃখের ছায়া দেখতে পায়? দু’বছর আগের পরাজয়ের বিস্মৃতি মনে হলেই আমার গায়ে শুঁয়োপোকার মতো রোঁয়া দাঁড়িয়ে যায়। থির থির করে শরীর কাঁপে, আবার আমি নিজেকে সামলাই, একটা নিস্তব্ধ পুকুরে হঠাৎ ঢিল পড়লে ঢেউ ভাঙে ঠিকই, আবার সময় নিয়ে নিস্তরঙ্গ হয়ে যায় জল! মানুষের সমাজ ওই রকম। মানুষের আছে স্বস্তিকর বিস্মৃতি। আমার মনের জ্বালা ও হয়তো সে নিস্তরঙ্গ জলের মতো মিলিয়ে গেছে গত দুই বছরে।
অবশ্য অহনা গত দুই বছরে আমার পেছনে নিরলস লেগে থেকে আমাকে মোটামুটি ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। ওর আগমন অনেকটা ধুমকেতুর মতো। যখন আমার মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে আমার কেউ নেই, কিছু নেই, আমি ভীষণ একা, অসহায়। আমি প্রানপনে কান্না আটকানোর চেষ্টা করতাম, কিন্তু পারতাম না। আপনি জল গড়িয়ে পড়ত। বুক ঠেলে বেরিয়ে আসত কান্নারা। তখন চোখের জল মোছার এক অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল অহনা।
সন্ধে গাঢ় ক্রমশ। সোয়া ছয়টা বাজে। অহনা অফিস থেকে বেরোয় ছয়টায়। এতক্ষনে ফেরার কথা।
অহনা জানে না,অহনার আগে বাসায় ফিরলে ছোট্ট একটু শব্দের প্রতীক্ষায় বসে থাকি আমি। শব্দ না ছোট্র একটা ধ্বনির। টুং।ওইটুকু ধ্বনির যে কি ক্ষমতা। অহনা কখনো বুঝবে না।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট