পর্ব- ২৬
হঠাৎ কেমন অস্থির অস্থির লাগছে দু-চার মিনিট এপাশ ওপাশ করলাম। টিভির রিমোট খুঁজছি। টিভি খুলে দেখবটা কী? এতো রাতে টিভিতে নিশ্চয়ই সব অখাদ্য প্রোগ্রাম। খামোখা বোকা বাক্সটা চালিয়ে কী লাভ! পায়ে পায়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। এই ভাল, এখানে খানিক দাঁড়িয়ে থাকলে মনটা তাও অন্যরকম হয়ে যায়।হু হু করে সময় কাটে। হু হু করে একটা ঠান্ডা বাতাস বইছে। দুপুর বেলার এই হাওয়া অবশ্য নরমসরম আরাম বিলোয় শরীরে। নীচের রোদ ঝলমলে পৃথিবীটাকে ভারী মায়াবী লাগছে। মানুষ গুলো যেন অলীক পুতুল, ছুটন্ত গাড়ি গুলো যেন দম দেওয়া খেলনা, তার মাঝেই কংক্রিটের জঙ্গলে সবুজে ছোপ, রক্তিম আবেশ। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়ালে কল্পনায় আমি চলে যাই অনেক অনেক দূর। দূরমনা আমি তখন ভাসতে থাকি স্মৃতির আকাশে। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, রাগে-অভিমান মেশানো কত যে ছবি সেখানে।
সরকার লক ডাউনে নতুন করে নিয়ম করেছে, যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি আছে তারা ঈদে বাড়ী যেতে পারবে। তখন থেকেই মেজাজ বিগড়ে আছে। গরম লাগছিল খুব। এখন আর সেরকম অনুভূতি হচ্ছে না। মেজাজ বিগড়ে থাকলে ঠান্ডা গরমের অনুভূতিটাই বুঝি কমে যায়। বড়লোকের জন্য এক নিয়ম আর গরীবের জন্য আরেক? এ কেমন নিয়ম? একটি স্বাধীন দেশে জনগনের জন্য দুই নীতি, এই ভাবনাতেই নতুন করে খিঁচড়ে আছে মন। গা – হাত-পায়ে বিশ্রী জ্বালা জ্বালা ভাব। তুৎ, এখনও এতটা বিরক্তি পুষে রাখা কি বাড়াবাড়ি নয়? ফেরী ঘাট থেকে কয়েক লাখ লোককে পূনরায় ফেরত পাঠানো হলো আবার গাড়ী ওয়ালাদের জন্য সব খুলে দেওয়া হলো। দেশের লোকের কোন বিকার নেই আর এই চিন্তায় পীড়িত হওয়াও তো নেহাতই অর্থহীন। সবই তো বুঝি, তবু কেন স্নায়ুকে বশে রাখতে পারছিনা? চুলায় যাক সব।
ব্যালকনিতে স্থির দাঁড়িয়ে আছি আমি। ছায়া ছায়া অন্ধকার কেটে একটু একটু করে আলো ফুটছে। সামনের আকাশ এতক্ষণ বর্ণহীন ছিল, এখন হালকা গোলাপি। এরপর লালের আভা লাগবে। শহরটা জাগছে, জেগে উঠছে। ভোরের মেদুর হাওয়া আবেশ মতো এসে লাগছে আমার মুখে। ভোর বেলার একটা অদ্ভুত মায়া আছে। এবার ঈদে দেখা হবেনা কত কত প্রিয় মুখ। লাইফ ইজ লাইফ। আ রানিং হুইল। গড়াতে গড়াতে চলে, ঠোক্কর খায়, গর্তে পড়ে, ওঠে, আবার গড়ায়, আবার গাড্ডায় পড়ে…. জীবন তো বহতা নদী। কখনও মজা স্রোত, কখনও ঢেউ থইথই। ঢাকায় সবই আছে, থরে থরে আছে, কিছুরই কমতি নেই এতটুকু। তবু কী একটা যেন নেই! সেটা যে কী? শুধু বুঝতে পারছি সেই অদৃশ্য জিনিসটার অভাবে ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে যাচ্ছে।
অহনা নিজের ঘরে। ঘুমাচ্ছে কি? যা হুড়ুদ্দুম সব করেছে আজ। ঘরের ঝুল পরিষ্কার করেছে, ফ্যানের ডানার ময়লা সাফ করেছে, কাপড় ধুয়েছে, ঘরদোর সব সাফ সুতরো করেছে। নিশ্চয়ই ক্লান্ত এখন। উঠে গিয়ে একবার দেখে এলাম। কী নির্লিপ্ত সুখে ঘুমায় মানুষটা! জেগে যখন থাকে তখনও কি বদলায়? আশ্চর্য দেড় বছর হতে চলল মানুষটার সাথে অথচ অহনার মনের তল পাওয়া গেল না। বড্ড বেশি শান্ত, বড় বেশি চুপচাপ। ফর্সা শরীরটা নীল চাদরের ওপর রজনীগন্ধার ডাঁটির মত শুয়ে আছে অহনা। খাটের গা বেয়ে ঝুলছে ওর খোলা চুল। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি। ওই হাসিকে কি বলে? সুখ? তৃপ্তি? আনন্দ? একটা মানুষের তো অজস্র চেহারা থাকে। আমরা হয়তো একটা মুখ দেখি, বাইরে থেকে দেখে স্বামী -স্ত্রীর প্রকৃত সম্পর্ক করা অত সহজ নয়।
বিছানায় রোদ পড়তেই ঘুমটা ছিঁড়ে গেল। চোখ খুলতে পারছিনা,কে যেন ভারী পাথর বসিয়ে দিয়েছে পাতায়। পিটপিট করে তাকালাম। আলো সওয়াচ্ছি চোখে। পাশে অহনা, হাত পা ছড়িয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। কটা বাজে এখন? চোখ রগড়ে উঠে বসতেই মাথা ঝিমঝিম। হাতের পিঠে নাক মুছে বাইরে চোখ মেললাম।হু হু হাওয়া আসছে জানালা দিয়ে। আজ আকাশে ভাসা ভাসা মেঘ, মেহগনি গাছের কী সুন্দর হালকা ছায়া। রোদ বেশ চড়া এখন। পৃথিবী এখন সত্যিই মায়াময়। সুন্দর একটা বাতাস বইছে। সবে বাথরুমের দরজা বন্ধ করেছি, অমনি ফোন ঝনঝন। এ এক নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। আমি বাথরুমে ঢুকলেই দূরভাষ বাজবেই। টিভি খুলে বসলাম। বিশেষ কিছু দেখার জন্য নয়। করোনায় আক্রান্ত আর মৃত্যুর সংখ্যা দেখার জন্য? কিংবা কিছুই যেন না দেখতে হয়, হয়তো বা সেই জন্যে। রিমোটে আঙুল চলছে নিজের মনে, চ্যানেল আসছে একের পর এক, সরেও যাচ্ছে। বিশেষ কোথাও থিতু হওয়ার মতো মানসিক স্থিরতাই নেই আমার।
জৈষ্ঠ্যের গরম বিকেলটা ও কী সুন্দর! অতীতের স্মৃতি বিভ্রম কি নিতান্তই এক অসুখ। দিন দিন কেমন যবুথবু মেরে যাচ্ছি। যে আমি কাজ-কাজ করে চিরকাল পাগল, সে আমি ঘর ছেড়েই বের হওয়া ভূলে গেছি। সারাদিন শুধু শুয়ে আছি, শুয়েই আছি। যে ঘোড়া অবিরাম ছুটছে, সে যদি হঠাৎ বসে যায়, ভেতরে -ভেতরে কি তার একটা ছটফটানি চলে না? সূর্য পশ্চিমে হেলে গেছে, পূর্বের এই বারান্দায় এখন নরম ছায়া। আজকাল মাঝে-মাঝেই একটা অবসাদ ভর করে। কিচ্ছু ভালো লাগে না তখন। সারাক্ষণ বাসায় বসে থাকি, কারোর সাথে যোগাযোগ করতে ভালো লাগেনা, পৃথিবী থেকেই যেন বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে ইচ্ছে করে নিজেকে। দুঃসহ একটা একাকীত্বের নাগপাশ তখন আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ধরে, কিছুতেই তাকে ছাড়াতে পারি না। আসলে ভালোবাসা ব্যাপারটাই বড় গোলমেলে। সে এমনই বায়বীয় বস্তু কখন আছে, কখন নেই, কোথায় কী ভাবে নিঃসাড়ে সরে যাবে, বুঝে ওঠাই দুষ্কর। কাছের লোকজনের সাথে কথা বলতে তো ভালোই লাগেনা এখন। কথা বললেই মন খারাপ হয় ভীষন রকম। ওরা কেন বোঝেনা, মন খারাপের কথা বার বার শোনাতে নেই। একটা ঘায়ে মলম লাগানো নয়, খুঁটে খুঁটে দেখা ঘা কতটা সারল। ক্ষত যে এতে গভীর হয়, কেন যে টের পায়না আপনজন?
সংসারের অনেক অপ্রিয় সত্যকেই তো আমরা টের পাই, তবে যতক্ষণ তা আড়ালে -আবডালে থাকে আমরা হজমও করে নিই। পরদা হঠাৎ সরে গেলে সত্যের অনাবৃত চেহারাটা কি অসহনীয় ঠেকে না? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যে কেন ভাঙ্গে, তৃতীয় ব্যক্তি কখনও কি তা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে? বন্ধু-বান্ধব স্বজনদের কাছে এসে যতই প্রাণের কথা বলুক, কোথাও একটা কিছু কি গোপন থেকে যায় না? যা শুধু চারটে দেয়ালই জানতে পারে, আর কেউ না। কিংবা দেয়ালেরও অজ্ঞাত থাকে। হৃদয়ের তলদেশের ছবি দেওয়াল ও কি দেখতে পায়? কত কত কারনেই তো সংসার ভাঙে। একজনের মনকে পুরোপুরি বুঝে উঠতে আরেকজন কি পারে? প্রথম প্রথম চেষ্টা হয়তো থাকে তারপর শুরু হয় মানিয়ে গুছিয়ে চলা। এক সঙ্গে শোওয়া বসার অভ্যেস। আর তা করতে না পারলেই ইয়ে শুরু। কেউ কেউ তো আবার বলে ম্যারেড লাইফের ওসব মধুর মধুর দৃশ্য ফিল্মে ভালো লাগে কিংবা লিখিয়েদের গল্প উপন্যাসে। প্র্যাকটিকেল লাইফে ওরকম কখ্খোনো হয় না। বাস্তব হলো সমুদ্রের মতো। যত উচ্ছাস তীরের কাছে। যত ভেতরে যাবে জল ক্রমশ কেমন শান্ত, গভীর…। আজকাল শরীর ঝামেলা করে। একটু ঘুমালেই গা ম্যাজম্যাজ, মাথা ভার, বুক জ্বালা। সারাদিন একা মনে শুধু সময় নিয়ে নাড়াচাড় করা।
কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের আলো থাকলেও জোৎস্নার মায়াবী আনন্দ যেন হালকা কালো পর্দায় ঢেকে রেখেছে কোনও অদৃশ্য জাদুকর। আঁধার মাখা কাচের মধ্যে দিয়ে দুরের এক আধটা বাড়ীর টিম টিম আলো। কাচের গায়ে শুধুই নিজের মুখের আবছা প্রতিচ্ছবি। ঘুমন্ত কামরার মৃদু আলোয় নিজের সেই প্রতিচ্ছবিকেও কেমন অলৌকিক মনে হচ্ছে আমার। রহস্যময়। কে আমি! কী চেয়েছিলাম এত দিন ধরে! এখন কী চাই! কেন ওই সামনে শুয়ে থাকা মেয়েটিকে প্রতিমার মতো লাগছে। মানুষের জীবনের প্রায় সব সম্পর্কই রক্তের সূত্রে পাওয়া। শুধু একটা সম্পর্কই গড়ে তুলতে হয়। বোঝাপড়া তৈরী করে নিতে হয়। ওই ওখানেই একাত্মতার অনুভূতিটাই একান্ত জরুরি। সেটা হল বৈবাহিক সম্পর্ক। স্বামী স্ত্রীর বন্ধন। সম্পর্কের ব্যালেন্সশিট খুব আজব! মানুষ এক আজব জীব।কখন যে তার মতি পাল্টায়, কীভাবে যে স্রোতের মুখ অন্য দিকে ঘুরে যায়, তা বুঝে ওঠা বড়ই কঠিন। কিছুতেই হিসেব মেলানো যায় না।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট