পর্ব-৩০
কোন ঘটনাটা যে আকস্মিক, সেটার বোধহয় সঠিক সজ্ঞা হয়ও না। বুক নিংড়ে দীর্ঘশ্বাস গড়িয়ে এল। দীর্ঘ দিনের অনভ্যাস নিকটতম সম্পর্কেও মরচে ধরিয়ে দেয়। একটা জলপ্রপাত তুষারের স্তুপ হয়ে জমে গেছে বুকে। সবাই পর। সবাই পর। কিছু কিছু দৃশ্য ছবি হয়ে বুকে গেঁথে যায় চিরদিনের মতো। দাঁতে দাঁত চেপে ভুলতে চাইলেও আচমকা চোখের সামনে এসে অস্তিত্বের মূল পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়ে যায়। এছাড়াও আরও কিছু দৃশ্য প্রতিটি মানুষের মনে জমা থাকে। মানুষ ভাবে ভূলে গেছে। অথবা সময় সম্পূর্ণ মুছে ফেলেছে দৃশ্যটা। বাস্তবে তা হওয়ার নয়। অবচেতন মনে ছবি রয়েই যায়। সামান্য সুক্ষ্ম ইঙ্গিতে, অবচেতনের পর্দা সরে গিয়ে, ছবিটা জ্যান্ত হয়ে চোখের সামনে নড়াচড়া করতে থাকে। ভোরে বাসা থেকে বের হওয়ার মুহূর্তের আকাশটা সারাদিনে কতবার যে রঙ বদলালো। ভোরের আলো যখন শেখের জায়গার এই জায়গাটায় পড়ছিল তখন জায়গাটাকে মনে হচ্ছিল ধ্যানস্থ সন্ন্যাসী। তিন বছর আগে রোজ সকালে এই জায়গাটাতেই এক প্রতারক মানুষ কে নিয়ে রোজ যেতাম, মোটর সাইকেল টা দাঁড় করিয়ে সে জায়গাটা দেখছি। ভালোবাসার সে প্রতারক আমায় ফাঁসিয়েছিল। এত বছর পর দৃশ্য গুলো কেন উঠে আসছে আমার চোখে? আসছেই যদি তবে কেন শুধু ই ভয়ংকর সে স্মৃতি গুলো? বুক ভেঙে আচমকা একটা কান্না উঠে আসতে চাইছে। চোখের দু কূল ছাপিয়ে গেল। নিঃসীম আকাশের নীল মিলিয়ে গেল চোখের জলের পর্দার ওপারে।
মোটর সাইকেল পুনরায় স্টার্ট করে আমি চলছি ভাসতে ভাসতে, দুলতে দুলতে। মনে হচ্ছে আমি হাওয়ায় ভাসছি। এক ঝাঁক পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে মায়াবী রোদ্দুরে সকালের আকাশে। পুরনো চেনা রাস্তা, প্রতি বুধবারে এই চেনা রাস্তা ধরে কতদিন গেছি। আজ পথই যেন ফুরাচ্ছে না। আজ রাস্তা বেশ ফাঁকা, আশে পাশে কোন সাড়া শব্দ নেই। বাতাসের ফিসফাস ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না এই মুহুর্তে। ফেরীতে মেঘনা পার হচ্ছি। ছোট বেলায় প্রথম যখন মেঘনা নদীটা দেখেছিলাম তখন কি বিশাল মনে হয়েছিল। ছোটবেলায় যা বিশাল, বর্ণময়,রোমাঞ্চকর, বড় হলে সেটাই একেবারে ছোট্ট, ম্যাড়মেড়ে। নদীর জল রোদ্দুরে ঝিকমিক। দূর্যোগ চলছে। মানুষের চোখে মুখে অনেক বেশি ক্লান্তির ছাপ। আমার সামনে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে উনাকে দু’বছর ধরে দেখছি। গত ছয়মাস আগেও মুখখানা কত মসৃন ছিল। চকচকে। কমনীয়। অথচ এখন চোখের নীচে ঘন কালি, কপালের দিকের চুল সবই প্রায় সাদা। মাত্র ছয়মাসের মধ্যে বুড়িয়ে গেল? না ফুরিয়ে গেল? ভয়ঙ্কর দুর্যোগের আঘাতে এভাবেই বোধ হয় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় কেউ কেউ।
খুব ভোরে বিছানা ছাড়া আমার বহুদিনের অভ্যাস। ছোটবেলায় সকালে উঠে চিৎকার করে পড়া মুখস্থ করতাম। আব্বা বলত, ভোরবেলা মস্তিষ্ক তাজা থাকে , গ্রহনক্ষমতা অনেক বেশী বৃদ্ধি পায়। আর এখন এম্নিতেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। এনিয়ে অহনার অভিযোগের শেষ নেই। আমি উঠে গেলেই ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমাদের দু ঘরের মাঝারি ফ্ল্যাট । ডাইনিং স্পেস নেই বললেই চলে। একটা ফ্রিজ আর বুকসেলফ রাখতেই সে স্পেসটায় আর কোন জায়গা নেই। টু সিটের ডাইনিং টা তাই ড্রয়িং রুমের এক কোনে পাতা হয়েছে। ব্যালকনির দরজা খুললাম খুব সাবধানে। অহনা শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে। মুখ একহাতে আড়াআড়ি ঢেকে। তমালের বউ ফিরে এসেছে। ফিরে এসেছে কথাটা বোধহয় ঠিক না, ফিরিয়ে এনেছে তমাল। একদম বগলদাবা করে নিয়ে এসেছে। মনের ওপর তো হাত চলে না। কোন মানুষ কি সম্পূর্ণ রিপুমুক্ত হতে পারে? একেই কি নিয়তি বলে?
দু’বছর আগের আমি আর এখনকার আমি মাঝখানে বিশাল একটা দেওয়াল উঠে গেছে। সময়ের। সময় কত কিছু নিয়ে চলে যায়। শুধু কি নিয়েই যায়? রাখে না কিছুই? আচম্বিতে দমকা হাওয়া উঠল। ধূলোর ঝড়ে নিমেষে রাস্তা ঘাট ঝাপসা হয়ে গেছে। সোঁ সোঁ আওয়াজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তান্ডব নৃত্য শুরু করেছে ধুলোবালি। কাগজের টুকরো, প্লাস্টিক ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে। চোখে মুখে সূচের মতো বিঁধছে ধূলোর ঝড়।লোকজন এলোমেলো দৌড়তে শুরু করেছে। তাল বেতাল বাতাসে সারাদিনের গুমোট ভাব কেটে গেছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করল। আকাশচেরা আলোয় ঝলসে যাচ্ছে পথঘাট। সুক্ষ্ম সর্ষে দানার মতো কষ্ট বুকের ভেতর ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছি আমি। কি ভয়ানক এক অন্তর্দাহের পাহাড় বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি সারাক্ষণ। ঝুপ করে আলো নিভে গেল। অনেকদিন পর আজ বিদ্যুৎ গেল। ঝড় উঠেছে বলেই মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক অন্ধকার আমাদের দুটো ছায়াকে আরও আবছা করে দিয়েছে। অহনাকে আমি আমার কষ্ট গুলো অনুভব করতে দেই না। আমার হৃদয়ের জমা কষ্ট আমার হৃদয়েই আছে। থাক। অভিমান আর যন্ত্রণার দানা না হয় মুক্তো হয়েই জমা থাক বুকে। জীবন তো একটাই। সেই জীবন কতভাবেই না ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে মানুষ। জীবনের মানে খুঁজছে। নিজেদের মতো করে।
আকাশ আজ তারায় তারায় ঝকঝক। আজ কালের মধ্যেই বোধহয় পূর্ণিমা। ফিনফিনে মসলিনের মতো চাঁদের কিরণ ছড়িয়ে গেছে গাছের মাথায়। উগ্র একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগল আমার। কি ফুলের গন্ধ এটা? বুক ভরে ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করলাম। গাছেদের মাথায় রুপোলী সরের মতো জ্যোৎস্নার ঢেউ। সব দুঃখ ছাপিয়ে একটা ভালো লাগা। একটা অসম্ভব ভাললাগা। সমস্ত পার্থিব অস্তিত্ব যেন তুচ্ছ হয়ে যায় এই ভালোলাগার কাছে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছি, হাতে বেনসন এন্ড হেজেস, কয়েকটা টান দিতেই চামেলীর কথা মনে পড়ল। চামেলী আমার বন্ধু। একটা বিশাল স্বার্থপর মানুষের সংসার করে যাচ্ছে দম বন্ধ করে। বিষুব রেখা থেকে শুরু করে দুজন মানুষ যদি দুই মেরুর দিকে হাঁটতে শুরু করে, তবে তারা কোনওদিন মিললেও মিলতে পারে। কিন্তু যদি তারা পাশাপাশি দুটো রেলের লাইন ধরে হেঁটে চলে তবে তারা হাঁটতেই থাকে অনন্তকাল, মেলে না কখনই, দুরত্ব ও কমে না এক চুল। চামেলী আর তার হাজবেন্ডের সম্পর্ক টা সে রকমই।
একই পৃথিবীতে এরকম দুজন মানুষ থাকতেই পারে কিন্তু একই ছাদের নিচে এদের স্থান হওয়া কঠিন, এক বিছানায় তো দূর্বিসহ। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, একে অন্যের ভালোলাগা মন্দলাগার প্রতি সম্মান না থাকলে সে সংসার আর সংসার থাকেনা সেটা হয়ে ওঠে কারাগারের মতো। তখন সে সম্পর্কটাই হাঁসফাঁস হাঁসফাঁস লাগে, দমবন্ধ লাগে সম্পর্ককে। আর এই ধরনের নিকটতম সম্পর্কের মধ্যেই ভবিষ্যত প্রজন্মের ধ্বংসের বীজ লুকিয়ে থাকে। যে বিষিয়ে ওঠা সম্পর্কের থেকে বীজের আর্বিভাব, সে সম্পর্কের ছায়া তো বীজের ওপর পড়বেই। সেই ছায়াই বোধহয় ফুটে ওঠে পরবর্তী প্রজন্মের অসন্তোষের মধ্যে দিয়ে। চামেলীর মেয়েটার ছবিটা দেখছি আর ভাবছি এই মেয়েটাই যদি একদিন পাল্টে যায়? হয়তো নিত্য অশান্তিতে এই ছোট্ট মেয়েটা হয়তো নীরব থাকে কিন্তু চামেলীর স্বামীর বুঝা উচিত নীরবতাও কখনও কখনও শব্দের চেয়ে বেশী মুখর হয়ে ওঠে। কখনও কোনদিন মেয়ে যদি প্রশ্নের বান ছোটায় সেদিন কি ঘটবে?
চামেলী বলে মেয়ে ইদানীং সব বুঝে, মেয়ে বদলাচ্ছে। আমার মন বলছে এরা বদল নয়, ভাঙ্গন। পাহাড়ের ধসের মতন। পাহাড়ে ধস তো আকস্মিক ভাবে নামে না, ভূমিক্ষয় শুরু হয় অনেক আগে থেকে। আর চামেলী রোজ যে শোষিত হচ্ছে? ওর পরিবারের চারপাশের লোকজনের হয়তো সেভাবে চোখেই পড়ছে না দিব্যি হাসিখুশি দেখছে হয়তো ওকে। যারা শাসন করে তারা যে কখন শাসিতের বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দেয়, নিজেরাও জানতে পারে না। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যা সত্যি সমাজের ক্ষেত্রেও তাই। পরিবার বা ব্যক্তির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে কি করে??
রাত নির্জন হয়ে আসছে, রান্নাঘরে খুট করে একটা শব্দ হলো, গোটা বাড়ির নিস্তব্ধতার মধ্যে সামান্য শব্দও বড় কানে লাগে। মনে খুব চাপ অনুভব করছি আজকে। মনে চাপ থাকার জন্য সময়টাকে বড় দীর্ঘ মনে হয়। মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। সাথে বাতাসের তোড়। ঝড়ের ঝাপটায় পেছনের বাগানের মেহগনি গাছটার ডাল মড়মড় শব্দে ভেঙে পড়ল। আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে বিদ্যুৎ শিকড় ছড়িয়ে দিচ্ছে। সেই ঝলকানিতে রাত ফালা ফালা। মুহুর্তের জন্য দিনের মত আলোকিত রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি। পর মুহুর্তেই কালিমালিপ্ত। হঠাৎ চামেলীর জন্য খুব খারাপ লাগছে। একেই কি বন্ধুত্ব বলে? চামেলীর জন্য আমার সবসময়ই খারাপ লাগে। কি করে যে ওইরকম একটা হামবাগের পাল্লায় পড়েছিল? আচ্ছা ডিপ্রেশন মনে অনেক দিন চেপে রাখতে রাখতে চামেলী যদি ডিপ মেলানকলিয়ায় আক্রান্ত হয়? নিজেকে ভীষণ নিঃসঙ্গ ভাবতে ভাবতে….। চামেলী সংসার করছে হামবাগটার সাথে পাশাপাশি। অথচ দুজনের মন কত আলোকবর্ষ দূর একেকজনের চেয়ে। সম্পর্কের সব সূতো ছিঁড়ে যাওয়ার পরও এ কোন গ্রন্থিতে বাঁধা পড়ে আছে চামেলী? গ্রন্থিটা ওর দুটো মেয়ে। প্রতিটি মানুষই কোন এক নির্দ্দিষ্ট বিন্দুতে এসে নিজের কাছেই অসহায়। আহারে জীবন। আহা জীবন।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট