পর্ব- ৩২
আষাঢ়ের আকাশ। আকাশে একফালি চাঁদ। ভেসে চলেছি নদী পথে। জাহাজের ছাদে বসে বাতাসে এলো চুল, যেন বকরাজ যুবক। আধ ফালি চাঁদের সাথে আমার মিতালী সেই ছোটবেলা থেকে। বৃষ্টি যেমন আমায় মাতাল করে তেমনি পূর্ণ চাঁদের চেয়ে আধফালি চাঁদটা আমায় মাতাল করে তোলে। চাঁদটাকে ঘিরে কয়েকটা তারা। হালকা মেঘেরা ভেসে চলেছে এক তালে। গাঢ় নয় ছেড়া মেঘ। নগরের কোলাহল ছেড়ে ছুটে চলছে জাহাজ। ইঞ্জিনের আওয়াজ টা গোঙ্গানীর মতো। মনে হয় কেঁদে চলেছে গুঙ্গিয়ে গুঙ্গিয়ে। আমি বেশ উপভোগ করছি।প্রাচীন নাবিকের মতো লাগছে নিজেকে। তুমি পাশে থাকলে হয়তো আরো উপভোগ করতে পারতাম। ঘর ফেরা মানুষের কোলাহল। কত সুখ দূঃখ আর বিরহ বেদনা ভরা তাদের এই ফেরা। মোবাইলে তাদের সে কথোপকথন শুনছি আমি। কত স্বপ্ন কারো কারো চোখে।
তোমার হাতের খুব কড়া এক কাপ চা হলে মন্দ হতো না। কিছুক্ষন আগে জাহাজের চা খেয়েছি। অনেকটা ওয়াক থু টাইপের। চায়ের তেষ্টা তো মিটেই নি কেবল মুখটা কে কষিয়ে ফেলা হয়েছে। অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো আর কি! শহীদুল্লাহ হলের পুকুর পাড়ে বসে একবার খেয়েছিলাম অমন চা। আমি একাকীত্ব উপভোগ করি সব সময়। আসলে একা থাকতে ভালো লাগে আমার।জাহাজের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কয়েকজন। ঢেউ গুনছে হয়তো। অন্য সময় হলে হয়তো আমি ও গুনতাম। জলের সাথে ভেসে যাওয়া পদ্ম, কচুরীপানার মতো মনে হয় জীবনটাকে। কেবল ভেসে চলা ঘাট থেকে ঘাটে, তারপর এক সময় দেহ থেকে আত্মা বের হয়ে এক অসীম ভূবনে প্রবেশ। কি অদ্ভূদ তাই না? কত ক্ষনস্থায়ী মানুষের জীবন তবু কত লোভ, কত হিংসা, কত অহংকার। আমি প্রকৃতির পূজারী। আমি এসব দেখি আর ভাবি মানব জনমের স্বার্থকতা কোথায়?
ঢেউয়ের তালে হালকা দুলছে বিশাল জাহাজটা। দুলুনি তে চোখ বুঁজে থাকলে হয়তো ঘুমিয়ে পড়ব। চেষ্টা করলাম। কিন্তু জাহাজের গোঙ্গানীটা কেবল ঘুরছে মাথার ভেতর।তোমার হাত ধরে ছাদে বসতে পারলে হয়তো মাথার শব্দটা গায়েব হতো। এমন অনেকবার হয়েছে। মাথার ভেতর কোন শব্দ ঢুকে গেলে সহজে বের হতে চায় না। বেশ কিছুদিন আগে খাগড়াছড়িতে যাবার সময় অমন হয়েছিল একবার। সামনে বিকট শব্দে গাড়ীর টায়ার বাস্ট হলো আর সে শব্দটা পুরো রাস্তায় আমার মাথায় গেঁথে গেল। গন্তব্যে নেমে যাবার পর ও শব্দটা ঘুরপাক খেয়েছিল মাথার ভেতর। আজ ও সে রকম হচ্ছে। জাহাজের গোঙানীর শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছে।
হালকা ছেড়া মেঘের সাথে চাঁদের মিতালী দেখছি আমি। বাতাসটা বেশ লাগছে। বাতাসে জলের গন্ধ। ছোট মাছ ধরা নৌকা। সে নৌকার ভেতর পিদিম জ্বলছে। ঢেউয়ে দুলছে নৌকাগুলো। বিষন্ন আমি তুমিহীন। দুরে মোবাইল ফোনের টাওয়ার গুলোর ডগায় লাল লাইট। জাহাজ থেকে মনে হচ্ছে আকাশে লাল তারা।জাহাজের ছাদে জটলা পাকিয়ে আড্ডা দিচ্ছে কেউ কেউ। কয়েকজন আবার হেঁড়ে গলায় গান ধরেছে। একটা সিগারেট ধরাতে মন চাইছে। ফুসফুস ভর্তি ধোঁয়া নিতে মন চাইছে।তুমি পাশে থাকলে চোখ রাঙাতে খুব। হঠাৎ করে তোমার মাথার মেহেদীর গন্ধ পাচ্ছি। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে সে গন্ধ। আমি চোখ বন্ধ করে তোমার মুখটা ভাবছি। তোমার চুলের স্পর্শ পাচ্ছি আমার মুখে গালে। ইদানিং এমন হয় প্রায় তুমি কাছে না থাকলেও তোমার উপস্থিতি টের পাই। আমার আশে পাশে টের পাই তোমার ইচ্ছা অনিচ্ছার প্লাবন।তুমি পাশে থাকলে তোমার হাতটা হয়তো গুঁজে দিতে আমার হাতে। চোখটা বন্ধ করে টের পাচ্ছি তোমার হাতের স্পর্শ। তোমার শরীরের গন্ধ।জানো নদীর জলে চলছে চাঁদের আলোর মিতালী। অত দুরের চাঁদ নেমে এসেছে নদীর জলে। দুরের নদী পাড়ের গ্রাম গুলো পাহাড়ের মতো মনে হচ্ছে। কী অপরুপ।
কী যে ছাই হচ্ছে,আবহাওয়ার কোনও ছিরিছাঁদ নেই। কাল মাঝরাতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হলো অনেক্ক্ষণ ধরে। অথচ সকাল থেকেই দুপদাপিয়ে পড়ছে গরম। এই এখন দুপুরবেলাটায় গা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। গোটা পৃথিবীরই নাকি উষ্ণতা বাড়ছে। নানান হাবিজাবি গ্যাসের দাপটে নাকি বায়ুমন্ডলের কী সব স্তর নাকি ফেটে ফুটে গেছে। এই জন্যই নাকি এতো গরম।
আর আমি তো আছি কংক্রিটের জঙ্গলে। রোদ্দুরের আজ বড্ড তেজ। ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবনা নিয়ে কাটছে সকাল থেকে। আমি আবার যার তার সাথে হৈ হুল্লোড় কিংবা মস্তি করে কাটাতে পারিনা। নৈতিকতা ফৈতিকতা ঠিক নয় তবু কোথায় যেন বাধে। সংস্কার? উহু তাও নয়। হয়তো রুচি।
গত সেপ্টেম্বরের পর আমার গায়ের চামড়া অনেক মোটা হয়ে গেছে। হ্যা আমার সব গেছে, তাই বলে জীবন তো আর মরুভূমি হয়ে যায়নি।অহনা আমার জীবনে এখন মরুদ্দানের মতো। ওর মুখ পানে তাকালেই দুঃচিন্তা গুলো কর্পুরের মতো উধাও হয়ে যায়। ঝকঝকে দিন। কর্মব্যস্ত শহর ছুটছে নিজের গতিতে। হলুদ রোদ আর নরম বাতাস মেখে। অলস কল্পনার অলিগলি চষে বেড়াচ্ছে আমার মন। কোনও কোনও টার কানাগলি অব্দি গিয়ে আবসর ফিরে আসছে আরেকটায়। সব স্মৃতির জোনাকী।
এই আবছা আবছা। চোখের লেন্সদুটো মাঝে মাঝে ঝাপসা হয়। ফোঁস করে নিঃশ্বাস বের হয়ে বুকটা খালি খালি লাগে।
জীবনের এই সময়ে এসে মনে হয় মাঝদরিয়ায় বসে আছি ফুটো নৌকায়, পালানোর রাস্তা নেই। অহরহ চিন্তা, এই বুঝি ডুবলো ফুটো নৌকো। তারপর কি করবো আমি? আচমকা নিজের এতো দিনের সততার সাইনবোর্ড নামিয়ে ফেলতে পারছি না। আবার অসৎ পথে হাঁটা সেও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে? খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে জীবনযাপনের সর্বক্ষেত্রে একটা মান তৈরী হয়ে গেছে, তার থেকেই বা আচমকা নামা যায় কী করে?? নাহ উন্নতি অবনতি নিয়ে আমার আফশোস নেই। চিন্তা কেবল অহনা কে নিয়ে। আই বিলিভ ইন ডেসটিনি বাট হোয়াট এ্যাবাউট অহনা? এই প্রশ্নটা যেমন সরল তেমন জটিলও বটে। নতুন করে জীবনের অভিমুখ বদলানোর তো প্রচন্ড চেষ্টা করে যাচ্ছি।
সিগারেট ফুরিয়ে গেছে। দরজায় তালা ঝুলিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তার কোন ধরে হাঁটছি আমি। এই রাস্তাটায় হাঁটতে আমার বেশ ভালো লাগে। যেন খানিকটা মায়া ছড়িয়ে আছে এ রাস্তাটায়। বুঝি কিছু অতীত ও। হ্যা, জেল থেকে বেরুনোর পর এই পথটা দিয়েই আবীর নিয়ে তুলেছিল তার বাসায়। নিরাশ্রয় আমার তখন আর কোনও জায়গা ছিলো না। রাস্তা দিয়ে লোকজন এপাশ ওপাশে কেউ উত্তরে কেউ দক্ষিণে ছুটে যাচ্ছে। হয়তো একেক জনের জীবনের কাহিনী একেক রকম। এর মাঝে এই রাস্তার কত বদল। শুধু আমারই কোন বদল ঘটল না। আমি অহনার সাথে দেখা করতে আসার প্রথমদিন যে দোকানটায় চা খেয়েছিলাম ওকে নিয়ে সেখান থেকেই সিগারেট কিনে নিলাম। বাসার দিকে হাঁটছি আর ভাবছি একটা দম দেয়া ঘড়ির মধ্যে জীবনটা আটকে রইলো। পায়ের তলায় শুকনো পাতা ভাঙ্গছে মড় মড় করে। আমি নিজেও তো একটা শুকনো পাতা। খসে পড়িনি এই যা।আমার দীর্ঘশ্বাসের খবর কে রাখে? শহরের ত্বকে কটকটে অপরাহ্নের রোদ। এ রোদের আলোয় যতটা না আবেশ তার চেয়েও বেশী বিষাদ। আলোটুকু মুখে মেখে আমি বাসায় ফিরলাম।ঘরে ঢুকেই দেয়ালে ঝোলানো অহনার ছবিটার দিকে তাকিয়ে আমি থমকে দাঁড়াই কয়েকটা পলক। বুকটা যেন চলকে উঠেছে সহসা। ছবিতে অহনার মুখে অপ্রতিভ একটা হাসি,সে হাসিতে কি যেন একটা সংকেত। যে সংকেতের আশায় একদা আকুল হয়ে থাকতাম সারাবেলা আমি।
মানুষ যেভাবে থাকতে চায় সেভাবেই তো গড়ে নেয় নিজেকে কিংবা যা শুনতে চায় সে ভাবেই গড়ে নেয় কথা গুলোকে। অহনার আঁজলা ভরা সুখটুকু নিয়ে আমি চলছি, ফিরছি আর বেঁচেও আছি। অহনার আহবানে ও কেমন যেন একটা মাদকতা আছে। নীরব উপেক্ষা দিয়ে প্রতিহত করতে পারিনা আমি সে মাদকতা। আমি মাতাল হয়ে যাই সে আহবানে।
এ এক আশ্চর্য না শুধু আশ্চর্য নয় তার চেয়েও বেশী কিছু। এক ধরনের মুগ্ধতা। ভাল লাগা। ঢাকায় আমার খুব প্রিয় একটা জায়গা আছে গত দু’বছর আগের অক্টোবরের ছাব্বিস তারিখ পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন ভোরেই আমি যেতাম আমার পছন্দের জায়গায়। দিগন্ত জুড়ে খোলা আকাশ, কাশবন, আর কুলকুল করে বয়ে চলা মেঘনার শাখা। ইদানিং খুব ইচ্ছে করে খুব ভোরে হুড খোলা রিকশায় অহনার হাতে হাত রেখে সেখানে ঘুরে আসি। কী করব সে আশায় গুড়ে বালি। শুক্রবার যাও একটা বন্ধ পাই তাতেই দুজনে ঘুমিয়েই কুল-কিনারা পাইনা। ফজরের ঠিক পরে ওখানে না গেলে আর যেয়ে লাভই নেই। গত বছর আমি এ সময়টায় রোজ ওখানে যেতাম আর খুব মুগ্ধ হতাম। খুব মুগ্ধ ভাবে শুরু হতো আমার সকালটা। অহনা ইদানিং আমাকে নিয়ে মাঝে মাঝে কনফিউজড হয়ে পড়ে। কেন? ও আমার জীবনে প্রথম প্রেম কিনা তাই নিয়ে। আমি সহজ গলায় বলি – দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম প্রেম বলে কিছু নেই। মানুষ যখন প্রেমে পড়ে তখন প্রতিটি প্রেমই প্রথম প্রেম। ”অবশ্য কথাটা আমার না এ কথাটা হুমায়ুন আজাদ স্যার বলেছেন।
তবে আমার স্পষ্ট কথা হলো আমি অহনার জীবনে চিনেজোঁকের মতো লেগে থাকব। নুন ছিটিয়েও তাড়াতে পারবে না আমাকে।
সকালে বিছানায় উঠে বসেই দু’হাতে চোখ ঘষলাম ভালো করে। জোরে জোরে শ্বাস টানলাম বেশ ক’বার। রোজকার মতো রাতভর বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কখন যেন ভোরের মুখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ঘুম ভাব। অনিদ্রার ক্লান্তি এখন ও ছড়িয়ে আছে চোখের পাতায়। শরীর নতুন করে গড়িয়ে পড়তে চাইছে। পুবের জানালা দিয়ে শৈশবের মতো নিষ্পাপ নতুন সকাল টা এক মুঠো নরম আলো ছড়িয়ে হামা টানছে ঘরের মেঝেতে। ভোরের এমন সুন্দর আলোতেও গোটা ঘর জুড়ে ভুতুড়ে রকমের থমথমে। অবশ্য এ সময়টায় রোজ এমনই থাকে।
হৃদয় খুব বড় ধরনের সন্দেহজনক অঙ্গ। সব সময় তাকে বিশ্বাসও করা যায় না। গত কয়েকটা মাস নিজেকে ঘুছিয়ে নিতে শুরু করেছি আমি। গত পাঁচটা বছর আমার শরীর শরীর ছিল না, মনটাও মন নয়। অবশ্য এ নিয়ে আমার কোন অভিযোগ ও ছিল না।ইদানিং বুকের ভেতর একটা গোপন কান্না দানা বাঁধতে চায়।বৃথাই মানুষ ভাবতে ভালোবাসে তাকে ঘিরেই পৃথিবী চলছে। তার জন্যই সূর্য উঠছে। চাঁদ ডুবছে। তার জন্যই বেঁচে আছে প্রিয় পরিজন। ভূল ভূল। এ এক ভয়ানক নিষ্ঠুর ভ্রান্তি।
আমার গোটা ঘর নিঝুম। আরও থমথমে। সেই গাঢ় থমথমে ভাবটা চেপে বসছে আমার বুকে। নীরবতা যেন আষ্টেপৃষ্টে ফাঁসের মতো জড়িয়ে ধরছে আমাকে। টিভিতে মুভি দেখাচ্ছে “বেলা শেষে “। সকাল থেকে বিকেল অব্দি সপ্তাহে একদিনই আমার অখন্ড অবসর। সারাটা দিন বিছানায় গড়ানো, টিভি দেখা এ জিনিস ওখানে এনে রাখা ছাড়া আমার কোন কাজ নেই। মাঝে মাঝে অহনা অফিস থেকে ফোন করে। এ্যাই, কি করছো? মন খারাপ লাগছে? আমার জন্য? তারপর ওপার থেকে বাঁধ ভাঙ্গা হাসি। এরপর দু’চারটা কথা বলার পর টুক করে ফোনটা রেখে দেয়। আমাদের ফ্ল্যাট টা বেশ নিরিবিলি। বাইরের দরজা বন্ধ করে দিলেই পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এক নির্জন দ্বীপ। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে এমনই একটা অনুভুতি হয় আমার। বিশেষ করে রাত্রিবেলা। সিগারেট ফুঁকছি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। জানালা দিয়ে অহনার বাঁধানো ছবিটা চোখে পড়ছে। অহনার চোখ জোড়া আমার মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় ফোটা দোলনচাঁপার মতো লাগে। মুখটায় গোলাপী আভা। চোখ জোড়ায় দুষ্টুমি। চুলে যেন শ্রাবণের মেঘ।পালক পালক চোখের পাতা। পাতা ছুঁয়ে ভুরু। ন্যাচারাল লাইন লিপস্টিক ঠোঁটে। অহনা বাসায় না থাকলে আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অহনার এ বাঁধানো ছবিটা দেখি। এটা অহনা জানে না। অহনা যখন আমার প্রেমিকা ছিলো, ছবিটা তখনকার। আহা! ছবিটার সামনে দাঁড়ালে আমি আমার প্রেমের দিনগুলো দেখতে পাই।
আজ কয়েকদিন ছোট মাছ দিয়ে মাস কলাইয়ের ডাল খেতে মন চাইছে। প্রতিবার অহনার আম্মা মসুর আর মাসকলাইয়ের ডাল দেন প্যাকেট ভরে ভরে। কিন্তু এবার অহনা নিয়ে আসেনি নাকি উনি দিতে ভুলে গেছেন বুঝতে পারিনি। আমি অহনাকে জিজ্ঞেস ও করিনি কারন তাতে ও কি ভাবে? শ্বশুর বাড়ীর খাবারের কি লোভ, লোকটার? কি জানি? ভাবলেও হয়তো ভাবতে পারে। লম্বা লম্বা জাম্বো সাইজের হাই উঠছে। একটু চা খাওয়া দরকার। সূর্য এখন প্রায় মাথার ওপর,খানিকটা দক্ষিণে চেপে। ভাবছি প্রেম জিনিসটা আসলে কী? কোনও বিশেষ ধরনের বিকীরন? কতই বা তার তরঙ্গ দৈঘ্য? কেউ জানে না। তাহলে প্রেমটা আছে, কিংবা হয়েছিল, কেউ বোঝে কী করে? প্রেমকে কি একটা অসুখ বলা যায়? যার টুয়েন্টি পার্সেন্ট শারীরিক আর এইট্টি পার্সেন্ট মানসিক?? হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই। এটা একটা বিটকেলে রোগ। প্রেম ব্যাপারটাই বায়বীয়। প্রেম ইথারের মতোই অস্তিত্বহীন। হঠাৎ কোন ভাইরাসের আক্রমণ কে প্রেম বলে ভুল করে বসে দুই জন জ্ঞানপাপী। না আমার আর অহনার সম্পর্ক টা বিয়ের আগে কখনোই প্রেম ছিল না, ছিলো ভালোবাসা হ্যাঁ এখন আমাদের সম্পর্কে প্রেম আছে, আছে ভালোবাসাও। অহনা এখনও বড্ড ছেলেমানুষ।বাচ্ছা মেয়েদের মতো কারনে -অকারনে হাসি, কথায় কথায় অভিমান, একটুকুতেই খুশি,দ্যাখ না দ্যাখ চোখ টলটল।
আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। একটা মলিন রোদ বিছিয়ে আছে শহরের গায়ে। বাতাসে সামান্য শিরশিরে ভাব। কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখলাম চারটা পঁচিশ। চেম্বারের জন্য তৈরী হতে হবে। ছোট একটা শ্বাস ফেলে চোখ মেললাম জানালার কাচে।বাইরে এখন ফকফকে আলো। তবে কাচের মধ্য দিয়ে কেমন নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে বিকেলটাকে।
সকাল থেকেই আকাশের মন খারাপ, খুব খারাপ। ওজনদার মেঘ জমেছে আকাশের বুকে। এক্ষুনি হয়তো কাঁদতে শুরু করবে।মায়া ছড়ানো আলো ধরনী জুড়ে। বৃষ্টি মেদুর বাতাস। বাতাসে ঠান্ডার আমেজ। বছরের এই সময়টাই মারাত্মক, একটু বে খেয়াল হলেই বিছানায় আছড়ে ফেলবে। আমি সাপ কে ও এতোটা ভয় পাই না যতটা সর্দি জ্বর কে।
সামনেই এক দিগন্তছোঁয়া ধানখেত। আধা পাকা ধান দুলছে বাতাসে। মায়া ছড়ানো সে আলো খেতের পর। পাকা ধান গুলোও সোনাবরন। ধানের শীষে বৃষ্টির ছাঁট জমে আছে, মনে হচ্ছে নাইয়ে দিচ্ছে যেন। নীলাভ বিষন্নতায় ভরে উঠছে চরাচর। আমার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস। দৃষ্টীর প্রসন্নতায় উবে যাচ্ছে ক্লান্তি। অনেকটা স্নিগ্ধ বাতাসে ফুসফুস ভরে নিলাম।
দোতলার কার্নিশে চোখ পড়তেই কেমন যেন ধন্দ লাগলো আমার জোড়া কাক বসা কার্নিশে। লোকে বলে জোড়া কাক মানে অমঙ্গল। আমার ছেঁড়াফাটা তাপ্পিমারা জীবনে আর কী অমঙ্গল হবে,?? একই মানুষের মধ্যে যে সুন্দর আর কুৎসিত লুকিয়ে থাকে, তা বুঝি অতি নৈকট্যের কারনেই নজরে আসে না। লেন্সে লেপটে গেলে কি মুখের ছবি স্পষ্ট হয়? নাকি ধেবড়ে যায়? সুখ বিলাস আর স্বাচ্ছন্দ্যে মোড়া জীবনে ভেতরের মধুর রুপটাই উদ্ভাসিত হয়, আবার হঠাৎ এক লহমায় যদি খাদে পড়তে হয়, তখন মরিয়া বাঁচার সময়ে পুরনো স্মৃতি সহ টিকে থাকতে হলে অন্দরের কুৎসিতটাকে ঠেলে বেরিয়ে আসাটা ও কিছু অস্বাভাবিক নয়। তবে ঘরের লোক আর বাইরের দুনিয়া তো দুটোকে এক চোখে দেখবে না কোনোদিন। বাইরের লোকের কাছে সেই পুরনো ভাবমুর্তিটাই আসল, আর ঘরের মানুষের কাছে বর্তমানটাই প্রকট। দুটোকে মেলানো কি সহজ কাজ??
ঘরে ঢোকা মাত্রই কোত্থেকে যে একটা দীর্ঘশ্বাস গড়িয়ে এল? কেনই বা এলো? লোডশেডিং ঘর জুড়ে আঁধারই আঁধার। বাড়িঘর সবই কেমন আবছায়া মাখা। শুনশান রাস্তায় একটা আধটা মানুষ হঠাৎ হঠাৎ। অশরীরি আত্মার মতো। আকাশের মুখ সারাক্ষণই ভার আজ সারাদিন। যখন তখন নামছে ঝমঝমিয়ে। কখন যে বিদেয় হবে এই আপদ মেঘগুলো। চারটের দিকে সূর্যদেব হালকা নজরে তাকিয়েছিল একবার। এখন আবার মেঘ ঘনাচ্ছে। হয়তো নামবে ঝমঝমিয়ে। স্বপ্ন দেখা যতটা সহজ, স্বপ্ন পূরণ ততটাই কঠিন। মাঝে নিয়তি দেবীর নিষ্ঠুর খেলাটা কেই বা আগে ভাগে অনুমান করতে পারে?
গেট ঠেলে সামান্য দুলে ঢুকছি খাঁচায়। উহুঁ, খাঁচা কেন হবে? এখানেই তো নিজের জন্য একফালি আকাশ বানিয়ে নিয়েছি আমি।
এই সেই আকাশ, আমার মতো কিছু না পাওয়া মানুষই কেবল যার সন্ধান পায়।আর কেউ নয়।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট