পর্ব- ৩৩
দূর হতে যেন বাঁশি বাজছে। যেন আবহমান কাল ধরে সৃষ্টির মর্ম লোকে একটা স্পন্দন ক্রমশ স্ফীতকায় হয়ে চলেছে। এ যেন তারই এক প্রান্ত ভাগ। প্রসারিত হচ্ছে যেন সূর। অস্পষ্ট থেকে স্পষ্টতম। যেন অরন্যের অন্ধকার পেরিয়ে প্রান্তরের জ্যোৎস্নায়। তাই বেড়ে চলল বুঝি প্রান্তরের সীমা।আকাশ তাকে রুকতে পারছেনা, সময় তাকে ছুতে পারছেনা, সে কী নারী, সে কী প্রেম? সে কী জীবন? যার জন্য মানুষের সবটুকু অস্তিত্ব।
মানুষ তাকে রুপ দেব বলে জন্মাল, বাড়লো, বাঁচল। তারপর ঝরে পড়লো সময়ের বৃন্ত থেকে ফুলের মতো।যার গন্ধ পেয়ে আলো পেয়ে জেগে ওঠে নারী, পুরুষ তার নাম। প্রতীক শুধু। নগ্ন প্রান্তরের বুকে সে বর্ষার মতো ঝরে, সূর্যের মতো আলো দেয়। তার পর মাটি ফেটে বীজের আবরন ভেদ করে শস্য হয় অংকুরিত, তার নাম নারী। প্রতীক শুধু প্রতীক। আর রুপ মিলিয়ে যায় সময়ের বুনো ঘোড়ার পায়ের তলে। এতো ধুলোর ঘর। ভাঙবার জন্য বানানো।
ইদানিং এমন হয় ভোরবেলা অহনা যখন ডেকে দেয়, তখন ঘুমচোখে বাথরুমের আয়নায় নিজের মুখ দেখতে গিয়ে মনে হয়, আমি নই অন্য একটা লোক আয়নায় দাঁড়িয়ে আছে। বয়স কম। চেম্বার না থাকলে সারা দুপুর পড়াশুনো করে, টিভি দেখে মস্তিষ্কে একটা ঝিমধরা ভাব আসে। রাস্তায় বেরুই মাঝে মাঝে সিগারেট ফুরিয়ে গেলে। দোকান পাটে লোকজন গলা ফাটায়। করোনায় আক্রান্ত, মৃত্যু, দ্রব্যমূল্য, শিশু ধর্ষন আর নারী নির্যাতন আশঙ্কা জনক হারে বেড়ে যাওয়া নিয়ে সবাই উত্তেজিত। ধর্ষন বা মৃত্যুর আলোচনা আমাকে একটুও টানে না। আমি সিগারেট ফুকতে ফুকতে দেখি দুরের রাস্তাঘাট, মানুষজন। চৌরাস্তার মোড়ে জীর্ণ ময়লা কাপড় পরা একটা পাগল সারাদিন ট্রাফিক কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে, কেউ তাকে মানে না, তবু সে নিজের মনে কাজ করে যায়। যেন ঢাকার সমস্ত অবাধ্য যানবাহনকে বশে রাখার জন্যই তার জন্ম হয়েছে। আমি দুপুরে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে একদৃষ্টে পাগলটাকে দেখি।
মাঝে দু-একদিন অহনা বেরিয়ে আসে অফিস থেকে। অহনার শান্ত ভঙ্গি রহস্যময় লাগে আমার কাছে। সন্ধ্যায় রেস্টুরেন্ট এ খেতে গেলে উচ্ছল হাসিতে ভেঙ্গে পড়া অহনা, অফিস ছুটির পর রাস্তা পার হতে গিয়ে সৌম্য শান্ত অহনা, উবার কারের পেছনের সিটে আড়ষ্ট বসে থাকা অহনা, কোনটা তার আসল রুপ? নাকি অন্য কোন অহনা লুকিয়ে আছে এই ছদ্মবেশের আড়ালে? হপ্তা দুয়েক ধরে একটা বল্গাছাড়া বুনো রাগ আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। এই মাথা ঠান্ডা, হাসিমুখে কথা বলছি লোকের সঙ্গে, আবার মেজাজ আগুন। কি জানি কি হচ্ছে??
আসলে কি এ মডার্ন সোসাইটির পারফেক্ট নাটবল্টু হয়ে উঠতে পারছিনা তো। হ্যাংলামি আমি একদম পছন্দ করিনা। কিছু লোক আছে আমাদের সমাজে এরা পরনিন্দা পরচর্চা ছাড়া এদের আর কোন কাজ নেই । এদের কাজই হলো কার হাজবেন্ড কি করছে? কত কামাচ্ছে? কিংবা কোন কলিগের ওয়াইফ কি করছে? এসব এদের কথাবাত্তা। এসব কথা বাত্তায় একদম পিত্তি জ্বলে যায় আমার। আরে বাবা লোকের নিন্দে না করে নিজের চরকায় তেল দাও না ভাই , মিছি মিছি লোকের সমালোচনা করে কি মজা পায় এরা । স্টুপিড বাঙ্গালী। নিজের পাছায় কাপড়ের খোঁজ নাই অন্যলোক কি পরছে তা নিয়ে মাতামাতি।
আজও অহনার অফিস , বাইরে তুমুল বৃষ্টি। আমি হাসপাতালে গিয়ে চেম্বার শেষ করে ফিরে এলাম। বাসার গেট দিয়ে ঢুকেছি অম্নি ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। ছুটির দিন বলতে এখন আমার জীবনে ইদানিং আর কিছু নেই । দুপুর দুইটা থেকে পাঁচটা এই আমার অবসর। বৃষ্টির জন্য অহনা লাঞ্চে আসতে পারেনি। বেচারী কি খাবে কি জানি? দুপুরের খাবার সেরে টিভিতে মুভি ছাড়লাম “অন্তরাল “। টিভি দেখতে দেখতে সোফায় ঘুমিয়ে পড়লাম।ঘুম ভাঙলো দরজার খুট শব্দে। কলিং না বাজিয়ে চাবি দিয়ে ঘরে ঢুকেছে অহনা। ঢুকেই কটমট করে টিভির দিকে তাকালো। পারলে যেন চোখ দিয়েই টিভিটাকে ভস্ম করে দেয়। নিজের মনে বিড়বিড় করে চলেছে, ইডিয়ট বক্স। ইডিয়ট বক্স। যাহ বাবা আজ মেজাজ চড়া কেন? আমি বসেই চোখ কচলাচ্ছি। হন হন করে ভেতরের ঘরে গিয়ে ঢুকলো। ছবির শেষ দৃশ্য চলছে টিভিতে। আমি উঠে ভেতরের ঘরে যেতেই চড়া মেজাজের কারন জানা গেল, এবার অহনার কোম্পানি ঈদ বোনাস দেবেনা। আশ্চর্য কেন দেবেনা! সারা বছর ধরে স্টাফদের দিয়ে টাকা কামিয়ে নিজেদের ব্যাংক ব্যালেন্স তাগড়া করবেন আর দেবার সময় এলেই মহামারী আর শত বাহানা দাঁড় করাবেন, এটা কেমন কথা? বেতন বোনাস না পেলে এতো গুলো লোক ঈদ কি দিয়ে করবে?? আহারে বেচারীর জন্য কেমন মায়া লাগছে।
খোলা জানালা দিয়ে শিশুর মতো চঞ্চল বাতাস ঢুকছে। মিনিট কয়েক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর অহনা নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দিল।
পুরো মুভিটা শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হানা দিল পুরো ঘর জুড়ে। নিঃশব্দে ঘরে গিয়ে দেখি কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে অহনা। বিছানায় নিথর। কেবল হালকা বুকের উঠানামা। এই মানুষটাই এখন আমার শরীর মন সংপৃক্ত করে রেখেছে। সময় কত কিছু নিয়ে যায়। শুধু কি নিয়েই যায়? রাখে না কিছুই?? ঘণ ঘণ বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করলো। আচম্বিতে দমকা হাওয়া উঠলো। সোঁও সোঁও আওয়াজের সাথে তাল মিলিয়ে তান্ডব নৃত্য শুরু করেছে বৃষ্টি। আকাশচেরা আলোয় ঝলসে যাচ্ছে আশপাশের দুনিয়া। অহনা নেশা গ্রস্থের মতো তাকলো আমার দিকে। একটা মিষ্টি হাসিতে হৃদয়ে যেন কাঁপন ছড়িয়ে দিল হৃদয় জুড়ে। হাত বাড়িয়ে ছুলো আমার হাত। হাত ধরে টানলো। ঝড়ের ঝাপটায় পাশের বাগানে মেহগনি গাছটার ডাল মড়মড় শব্দে ভেঙ্গে পড়লো। আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে বিদ্যুৎ শিকড় ছড়িয়ে দিচ্ছে। সেই ঝলকানিতে অন্ধকার ফালা ফালা। মুহুর্তের জন্য দিনের মত আলোকিত রাস্তাঘাট,ঘরবাড়ী। পর মুহুর্তেই কালিমালিপ্ত। পুরো দুনিয়া ভেসে যায় যাক, নিভে যাক সব আলো কিন্তু অহনার হাতের স্পর্শে আমার হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়ছে এক ফালি রোদ।
হালকা নীল নাইটল্যাম্প জ্বলছে ঘরে। পুরোপুরি ঘর অন্ধকার করলে আমার ঘুম হয়না। মনে হয় কবরে শুয়ে আছি। আবছা আলোয় অহনাকে ভালো ঠাহর হচ্ছিল না। অহনার চোখ বন্ধ। সমান বিরতিতে উঠানামা করছে বুক। তীক্ষ্ণ নাক। চিবুকের কাছটা সামান্য ছুঁচোলো। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে ঘুমন্ত অহনা কে দেখছি। ঘুমন্ত মানুষকে কী যে অসহায় দেখায়। নির্জীব! প্রতিরোধ হীন! সন্তর্পনে নেমে এলাম বিছানা থেকে। এই গরমেও কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে অহনা। জ্বর করেনি তো? আলতো হাত ছোঁয়ালাম অহনার কপালে। না ঠান্ডা।
রাত গাঢ় হচ্ছিল। শহরের কোলাহল এখন অনেক ঝিমিয়ে এসেছে। হঠাৎ হঠাৎ রাস্তা মাড়িয়ে উদ্দাম ছুটে যাচ্ছে গাড়ী। তার হর্ণের তীক্ষ্ম আর্তনাদ পলকের জন্য ছিঁড়ে দিচ্ছে স্তব্ধতাকে। রাতচরা পাখির মতো। ক্রমশ বিলীয়মান তার আওয়াজ দীর্ঘক্ষন রেশ রেখে দিল ঘরের বাতাসে। অহনা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। গুটিসুটি মেরে। প্রথম দিন থেকেই দেখছি অহনার এরকম কুঁকড়ে শোওয়ার অভ্যেস। যেন ঘুমের মধ্যেও অরক্ষিত। যেন আত্মরক্ষা করছে। আমি ফ্রিজ খুলে শীতল জল খেলাম। ঘড়িতে চারটা ছুঁই ছুঁই। সন্তর্পনে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। অহনা পাশ ফিরেই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো আমার বুক। ওমা! ওকি জেগে ছিল নাকি? না, ঘুমের ভেতরই স্বভাব বশত জড়িয়ে শুয়েছে আমায়। আলতো করে মাথাটা রাখলো আমার বুকের বাঁ পাশটায়।
আহারে! কী প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছে ও। সকাল সকাল উঠেই আবার ছুটবে অফিসে। ছুটির দিন ওর জন্য ঈদের মতো। ফ্যানের বাতাসে উড়ছে অহনার চুল। আমার চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে তার কয়েকটা।
আমি আবেশে তাকিয়ে আছি ওর মুখের দিকে। আমার চোখের পাতা যেন লক্ষ টন পাথরের মতো ওজনদার হয়ে আসছে। অহনার ঠোঁটের স্পর্শে ঘুম ভাঙ্গলো। ও অফিসের জন্য বেরিয়ে যাচ্ছে। বেরিয়ে গেল সদর দরজার চাবিটা হাতে নিয়ে। আমি ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে আছি সেদিকে। বিদ্যুৎ নেই। গিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙ্গলো এক রোগীর ফোনে। উনি মেসেঞ্জার এ কি এক রিপোর্ট পাঠিয়েছেন একটু যেনো দেখে দিই।
ওমা এফবি তে ঢুকে চোখ ছানাবড়া কার্ডিয়াক সার্জন ডা. সাবরিনা গ্রেফতার হয়েছে। নিজের লোভ লালসা সংবরণ করতে পারেনি নাকি স্বামীর লোভের সহযাত্রী হয়েছিল, কোনটা? করোনার ভূয়া রিপোর্ট করেছে ওর হাসপাতাল, মাঝে মাঝে ওর সাথে কথা হতো। কিন্তু কখনো বুঝতেই পারিনি ওর মতো মেধাবী একটা ডাক্তার অমন একটা কান্ডে যুক্ত হবে। লোভ মানুষকে কি বিবেক শূন্য করে ফেলে? ফেসবুকে ওর ব্যক্তিগত ছবি দেখছি, হয়তো শখ করে আপলোড দিয়েছিল। লোকজন এখন সমানে সেসব আপলোড করছে, চটকদার চটকদার কমেন্ট করছে। হ্যা সে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছে, তার প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসাবে এমন একটা জালিয়াতির দায় সে কোনভাবেই এড়াতে পারেনা। আইনের কাঠগড়ায় তাকে দাঁড়াতে হবে কিন্তু তার অপরাধের সাথে তার ব্যক্তি জীবনের এসব ছবির কি সম্পর্ক?
হ্যা সে একজন সরকারি চিকিৎসক হিসাবে কোন ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের পদে থাকতে পারেন না। কিন্তু এতোদিন তাহলে তার এই পদে থাকা নিয়ে কেন কোন প্রশ্ন তোলা হয়নি? আমি এমন অনেককেই চিনি যারা সরকারী বিভিন্ন পদে থেকেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লাভজনক পদে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে তো? আমি কোনভাবেই ডা. সাবরিনার পক্ষে সাফাই দিচ্ছি না। আমি জোরালো ভাবেই চাই তার শাস্তি হোক। কিন্তু আমার আপত্তি তার ব্যক্তিগত ছবি এভাবে আপলোড দেয়া নিয়ে। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সে গ্রেফতার হয়েছে, প্রচলিত আইনে তার বিচার হবে। সে দোষী প্রমাণিত হলে তার সাজা হবে কিন্তু আমরা কোনভাবেই তার একান্ত ব্যক্তিগত ছবি কিংবা মোমেন্ট এর ছবি এভাবে আপলোড দিতে পারি না। অনেকে দেখছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার ছবি সেটাও ফলাও করে প্রচার করছেন। আরে বাবা এতে কি প্রমান করতে চাইছেন? হ্যা বাংলাদেশের হাতে গোনা কয়েকজন মহিলা কার্ডিয়াক সার্জনদের মধ্যে ডা. সাবরিনা একজন। প্রধানমন্ত্রী ডা.সাবরিনার মেধার প্রতি সম্মান করে হয়তো সে ছবি তুলেছেন। তাতেও বাঙ্গালী বিকৃত রাজনৈতিক সুখ খুজে পাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করছি, চার দিকে করোনা আক্রান্ত, মৃত্যু, ডেঙ্গু, বন্যা, বানভাসি মানুষ, ধর্ষন আর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুরাবস্থার খবরের মাঝে এটা নতুন খবর। ফেসবুকে টুইটারে ব্যস্ত থাকার জন্য বাঙ্গালীর খোরাক জুটে গেল। লে হালুয়া এবার কয়দিন আপলোড দিতে থাকুন। তারপর আবার কিছুদিন পর ভুলে যাবেন সব কিছু । কিন্তু যে অব্যবস্থাপনার জন্য ডা.সাবরিনারা এসব অপরাধ করার সূযোগ পায় সে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ভেতো বাঙ্গালী কিছুই বলবে না কিংবা সেসব নিয়ে ভাববেও না। আরে ভাই যে সিস্টেম ডা.সাবরিনাকে জালিয়াতি করার সূযোগ দিয়েছে সে সিস্টেমের সাথে জড়িতরা কি দায় এড়াতে পারেন? পারেন না।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট