1. fauzursabit135@gmail.com : Fauzur Rahman Sabit : Fauzur Rahman Sabit
  2. sizulislam7@gmail.com : sizul islam : sizul islam
  3. mridha841@gmail.com : Sohel Khan : Sohel Khan
  4. multicare.net@gmail.com : অদেখা বিশ্ব :
মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫৪ পূর্বাহ্ন

ডা. মোজাহিদুল হকের ধারাবাহিক গল্প ৩৫

সাহিত্য ডেস্ক
  • প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২২

জীবনের গল্প

– ডা.মোজাহিদুল হক

পর্ব-৩৫

ভেন্টিলেটরের ভেতর একটা চড়ুই পাখির নতুন সংসার হয়েছে। চড়ুই ছানাটার চি চি ডাকে সকালের ঘুম ভাঙ্গে আজকাল আমার। আজ কোন কাজ নেই। সকাল থেকে চড়ুইয়ের খুনসুটি দেখছিলাম শুয়ে শুয়ে। আজ কাল সময় গুলো থমকে গেছে। নেই গৎবাঁধা কাজের কোন বালাই। কয়েকটা বাসী কাপড়ের একটা স্তুপ জমেছে ঘরের কোনায়। ইতি উতি ছড়ানো ছেটানো জিনিস পত্তর। ঈদে বাড়ী যাবার খুশীতে অহনা ইদানীং আর অন্য কোন কিছু ভাবছেই না। বাস্তবিক বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের যে সব উন্নতি হয় বলে শুনেছি তার কিছুই আমার হলো না। উন্নতি বলতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ছেলে পুলে বাচ্ছা কাচ্ছায় গিজগিজ করা সংসার। সুখী সুখী ভাব করে থাকা মানুষ। সংসার টাও কোথায় যেন ঝুলে আছে। উন্নতি হয়নি। ইদানিং আবার কাজকর্ম না করতে করতে এক ধরনের কাজের আলসেমীতে পেয়ে বসেছে। ইদানিং উঁচু বিল্ডিংয়ের ছাদে উঠলে মনে হয় অচেনা জগতে চলে এসেছি। উঁচুতে উঠার তীব্র আনন্দে আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি। ঢাকা শহরের অচেনা এক অদ্ভুত জগত। বিশাল বিশাল বিল্ডিং রষকসহীন জীবন যাপন। দুর থেকে দেখলে মনটা হু হু করে। এখানে সব অসুখী লোকের বাস।আজকাল কত সহজ সব হয়ে যায়।  সকালে অহনা অফিস চলে গেলে আমি একা থাকি। একা হাসতে থাকি। তারপর একা একা সারা সকাল অন্যমনস্ক থাকি। বেলা বাড়ে। আমি বিছানায় গড়াতে গড়াতে মধ্যাহ্নের উঁকিঝুঁকি।

কাল রাতে চেম্বার থেকে ফিরছিলাম। বাসে পাশের সিটে এক মেয়ে কেঁদে কেটে চোখ মুখ লাল করে কোন এক সূতপা দি কে ফোনে বলছে কোন এক বাপ্পার কথা। যাকে সে সর্বস্ব দিয়ে দিয়েছে। এখন সে প্রেগন্যান্ট। এখন কত সহজে সব হয়ে যায়।

মেয়েটা কাঁদছে। আমার ভেতরে কোন কান্না জমা নেই। মেঘ ছাড়া তো বৃষ্টি হয়না। আমার ভেতরে মেঘ কই?  কাঁদতে পারিনা বলেই হয়তো আমার কষ্টটা বেশী। আমার ঘরের দরজা জানাল বন্ধ থাকলে দুপুরের হলকা ঢোকেনা। শব্দ আসে না বাইরের। তবে জল তোলার মোটরটা চালু করলে কেমন একটা শোঁ শোঁ শব্দ উঠে। দুপুরে বিছানায় শু’লেই মনে হয় গভীর নির্জন একটা শহরে কেবল আমার শ্বাসের শব্দ ছাড়া আর আমি ছাড়া আর কিছু নেই। আবছা, অস্পষ্ট একটা কারনে আমার বুকে মাঝে মাঝে বাতাস আঁটকে যায়। শরীর ঝিমঝিম করে। কি যে সে কারন তা ঠিক বুঝতে পারি না। ইদানিং আমার চাওয়া গুলো খুব ছোট। পোলাওর চালের একপ্লেট ভাত, একটা রুইয়ের পেটি আর দু একটা কাঁচালংকা। পেট পুরে খেয়ে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো এর বেশী আমি কিচ্ছু চাই না।

অহনাদের বাড়ী যাব ঈদের ছুটিতে। আরো কয়েকটা দিন বাকি। আমি কৃপনের মতো দিন গুনছি। আমার বাসার সদর দরজার বাইরে দাঁড়ালে বেলফুলের গন্ধ আসে কোথা থেকে। মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে যায়। পৃথিবীতে বহুকাল বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। অহনার আম্মা ফোন করে বলেছে বৃষ্টিতে বাড়ীর সামনের ভূমিতে জল জমেছে। রাত হলে নাকি সেখানে কোলাব্যাং এর সংগীত আসর বসে। বাড়ীর পাশের হিশনা নদী ও নাকি জলে টইটম্বুর। আমি চোখ বুজে সেসব দৃশ্য আঁকি আমার মগজের খসড়া খাতায়। গত শীতে সে নদীতে আনমনা হয়ে দেখেছি ডাহুকের জলকেলী আর বালি হাঁসের ডুব সাঁতার। কলার ভেলায় কাছিমের রোদ পোহানো দেখে আমি হয়েছি মুগ্ধ। বর্ষায় হিশনার রুপ দেখা হয়নি। আচ্ছা হিশনার জলের কি ঢেউ হয়?  পাড় ভাঙ্গে?  অহনাকে কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি। অহনাদের গ্রামের সাথে আমার মামা বাড়ীর গ্রাম পশ্চিম বঙ্গের হুগলী জেলার ধনিয়াখালির চকসুলতানের বেশ মিল। মানুষ জন, ঘর দোর, দোকান পাট, রাস্তাঘাট আর চলনে বলনেও বেশ মিল। সে গ্রামে দশভুজা দুর্গার মতো মেজ মা আছে, তার সহযোগী হয়ে আছে রুবেল ভাইয়ের সহধর্মিণী যেন লক্ষী প্রতিমা। কোন কাজেই যাদের কোন ক্লান্তি নেই। আছে অহনার চাচী মা, ভর্তা বানানোতে তার জুঁড়ি মেলা ভার। আহা প্রাণের মানুষ গুলোকে কত দিন পর দেখব।

ছুটির দিনের খসড়া খাতার আঁকি ঝুকি হিসাবে ছুটির হিসাব খুব অল্প। বাসে উঠলেই অহনা খুব অসুস্থ হয়ে যায়। বসেছে কাঠ হয়ে। অহনা বলে ওর নাকি হৃদপিণ্ডে অদ্ভুত শিরশির অনুভূতি হয়,  হাত – পা জেলির মতো তলতলে লাগে, মাথায় একটা ভোঁ ভোঁ ভাব থাকে। নিয়মিত জার্নি করার অভ্যেস থাকলে পরিস্থিতিটা হয়তো অহনার রপ্ত হয়ে যেত। আমার যেমন জলভাত। হরবখতই এ শহর ও শহর আমি যেমন ছুটে বেড়াই, অহনার তো বাপের বাড়ী যাওয়া ছাড়া আর কোন জায়গা নেই। জ্যামে গাড়ী চলছে ধীরে ধীরে। মানুষ  গাড়ী আর ট্রাক লরীর জঙ্গল ঠেলে ঠেলে। বাইরে চামড়া পোড়ানো কড়া রোদ। আলোয় আলোয় ঝলমল চতুর্দিক। কাচের ভেতর দিয়ে ঠিকরে আসা রোশনিতে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। থমকে থমকে এগোচ্ছে গাড়ী, আবার একটা যানজটে আটকেছে। নড়ছেই না। পায়ে পায়ে গাড়ী থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়েছি, এই ভালো, গাড়ীতে বসে মেজাজ খিটখিটে না করে বরং রাস্তায় দাঁড়াই। একটা নিকোটিনের চাওয়া জানান দিচ্ছে ফুসফুস। চার ঘন্টা পার হলো এখনো মাওনা। ধুস,ভাল্লাগে না। উৎসাহটাই মাটি। কী যে ছাই উন্নতি হচ্ছে দেশের। চার ঘন্টার রাস্তায় সাত ঘন্টা পার হলো এখনো এলেঙ্গাই এলোনা। পিঁপড়ের মতো মানুষ ছুটছে ট্রাক লরী যা পাচ্ছে তাতে করেই। মির্জাপুরে এসে গাড়ী আর এগুচ্ছেই না। সূর্য অনেকটা পশ্চিম আকাশে হেলে গেছে। নরম একটা মায়া ছড়িয়ে আছে চরাচরে। গুটিসুটি মেরে বাসের সিটে শিশুর মতো ঘুমিয়ে আছে অহনা। সেই ভাল। নীল আকাশে কুচও কুচি সাদা মেঘ। ভাসন্ত মেঘে রং লাগছে।

উন্মাদ হয়ে ছুটছে মানুষ। উন্মাদনা জীবনের অঙ্গ ঠিকই, কিন্তু জীবন মানেই তো উন্মাদনা নয়। একটা না একটা সময় তো স্থিত হতেই হয় মানুষকে। জীবনই বাধ্য করে। তখনও যদি চোখে উন্মাদনার ঘোর লেগে থাকে, মানুষ তো ছটফট করে মরে যাবে।চলতে চলতে গাড়ীর চালক অসুস্থ হয়ে পড়লো। গোঁদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো। বাস থেমে গেল দুই ঘন্টার জন্য। নতুন চালক জোগাড় করে বাস যখন চালু হয়েছে তখন সন্ধ্যে কেবল গাঢ় হয়েছে। রাত বাজে সাড়ে এগারোটা আমাদের বাস কেবল এলেঙ্গা ক্রস করছে। গুটি সুটি মেরে শুয়ে আছে অহনা। প্রচন্ড গরম পড়ছে বাইরে। মেজাজ বিগড়ে আছে। মেজাজ বিগড়ে থাকলে ঠান্ডা গরমের অনুভূতিটাই বুঝি কমে যায়। সকালের আগে পৌছতে পারবো তো?  গা – হাত-পায়ে বিশ্রী জ্বালা জ্বালা ভাব। তুৎ, অযথা একটা বিরক্তি পুষে রাখা কি বাড়াবাড়ি নয়?

নিজেকে পরিস্থিতির হাতে ছেড়ে দিলেই তো মঙ্গল।যমুনা সেতু পার হয়ে বাস যখন চলতে শুরু করেছে তখন রাত দেড়টা।  বাস থেকে যখন নামলাম ছায়া ছায়া অন্ধকার কেটে একটু একটু করে আলো ফুটছে। সামনের আকাশ এতক্ষণ বর্ণহীন ছিল, এখন হালকা গোলাপী। এরপর লালের আভা লাগবে। গতিময় তাজপুর জাগছে, জেগে উঠছে। ভোরের মেদুর হাওয়ায় আবেশ মতো লাগছে। অহনা এখন বেশ ফুরফুরে মেজাজে। আমি বললাম, তোমাদের তাজপুরের সানরাইজ। বেশ লাগছে একটা লাল গোলা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে……। এনজয় করো, অহনা হেসে জবাব দিল।গ্রামের ভোরবেলার একটা অদ্ভুত মায়া আছে গো। দু- চোখ জড়িয়ে যায়।

হাসি হাসি মুখে অহনা বলল, এ্যাই শোন না, আমাদের শেষ জীবনে আমরা এসে তাজপুর থাকব। তাজপুরেই একটা ডুপ্লেক্স বাড়ী বানাবো আমরা। ঢাকার জীবনে সবই আছে, থরে থরে আছে,…  সুখ, বিলাস, ভোগ কিছুরই কমতি নেই এতটুকু। তবু কী একটা যেন নেই!  সেটা হচ্ছে একটা স্নিগ্ধতা। আর তাজপুরে এলে আমি সেই স্নিগ্ধতা টের পাই। জানো,এই স্নিগ্ধতার অভাবেই সংসার ঠিক সংসার লাগছে লাগছে না। আসবে তো?  আহা রে, ভোরের বাতাসে অহনাকে ঠিক ফুটে ওঠা পদ্মের মতো লাগছে। আমি চেয়ে রইলাম। অহনা আমার চোখের ভাষা পড়তে চাইছে, পড়তে পারলো কিনা জানিনা ওর মুখে স্নিগ্ধ একটা হাসি ফুটে রইলো।

তমাল বাস স্টপেই দাঁড়িয়ে ছিলো। একটা একটা করে মালপত্র তুলল অটোতে। ব্যস্ত সমস্ত মুখে। সতর্ক চোখে। অহনার বাসি মুখে আলগা ক্লান্তি। কচি সূর্য ঘুমভাঙা শিশুর মতো লেপ্টে আছে পুব আকাশে। আড়মোড়া ভাঙছে, হাই তুলছে, তাপ ছড়ানোয় মন নেই। কথা বলতে বলতে কখন যে এসে পড়েছি। স্বর্গদ্বার এসে গেলাম, অহনার ছোট স্বর্গের দ্বারে। বাড়ীর সামনে বর্ষার জমে থাকা সবুজ জলে উজ্জ্বল দীপ্তি ছড়িয়ে সম্রাটের মতো মাথার ওপর দাঁড়িয়ে সূর্য, হীরের কুচি মেখে ঝিকমিক করছে জল, বালি, তাজপুরের আকাশ আর অহনার ছোট্ট পৃথিবী। ভেজা বাতাসের ঝাপ্টানিতেও কী বিবশ মাদকতা!  উফ্ কী ভাল যে লাগছে!  কতদিন পর আবার তাজপুর এলাম!  বাইশ ঘন্টার জার্নি তাতে কী এসে যায়?  হাই উঠছে। একটু গড়িয়ে নিতে গেলে আর ঈদের নামাজ পড়া হবে না। থাক,  বারান্দায় বসে থাকতেই বরং ভালো লাগছে বেশী। জীবন ভাই রাতে বেশ কয়েকবার কল দিয়ে খবর নিয়েছেন। কাল হয়তো আসবেন। অসাধারন মানুষ জীবন ভাই। ওনার কথা শুনলে সবাই হেসে লুটোপুটি খায়, প্রচন্ড হৈচৈ করা মানুষ। এর পিছনে, ওর পিছনে লাগবে, মানুষটার ভেতর উচ্ছ্বাসের কোন ঘাটতি নেই। মাঝরাতে উঠে চা আর সেমাই খাওয়া জীবন ভাইয়ের অভ্যেস।  আর লিজা আপা নেহাত সহজ সোজা মন বলে হাসিমুখে সব সহ্য করে নেয়, অন্য কেউ হলে রেগে ফায়ার হয়ে যেত। নাহ জীবন ভাই লিজা আপা না এলে মজাই মাটি হয়ে যাবে।

পা টিপে টিপে এলো ছোট গিন্নী কুসুম। এসেই অহনাকে জড়িয়ে ধরলো। অহনার জীবনে এই ছোয়া টুকু বোধকরি এক অসহ্য সুখের অনুভূতি। কুসুম ওর বোন কম সন্তান বেশী। আর আমার কাছেও তাই। অহনা আর কুসুম নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। ক্ষনে ক্ষনে ভোরের বাতাস এসে এলোপাতাড়ি জড়িয়ে ধরছে ওদের, চুল টুল সব উড়ে একসা। কত দিন পর দু’বোন একসাথে কি জানি কত কথা জমে আছে দুজনের। সত্যি, এখন একটু চা পেলে ভালো হতো। তমালের বউ ছুটে গেল, চা বানাতে। পুরো বাড়ীতে ঈদের আমেজ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

আরো সংবাদ পড়ুন

ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট

Theme Customized BY LatestNews