পর্ব-৩৬
সকাল থেকেই জোর বৃষ্টি নেমেছে। আকাশ এখনও সীসে বরণ,মেঘের ভারে নেমে এসেছে নীচে। টানা বৃষ্টিতে পথঘাট থইথই। এই যে বৃষ্টি এতে সবচেয়ে বেকায়দায় পড়বে অফিসগামী মানুষ গুলো আর স্কুল কলেজে যাওয়া বাচ্ছা গুলো।
খোলা জানালা দিয়ে লাজুক লাজুক বাতাস আসছে মাঝে মাঝে। জোর বৃষ্টি হচ্ছে। এমন দিনে আমার স্বপ্নের কুঠুরি খুলে যায়। আমার একটা স্বপ্নের কুঠুরি আছে। শীর্ন নদী বয়ে চলেছে শরকাশ হোগলার বনের ভিতর দিয়ে, তারপাড়ে ছোট্র বাংলো, বাংলোর ছাদে মাধবীলতা, সেখানে তোমার আমার দিবস রজনী।নিকুঞ্জের উপর রোদ ছায়ার মাখামাখি, হেমন্তের পরে শীত, শীতের পর বসন্ত, আকাশে রঙের খেলা, চাঁদ মেঘের মিলন বিরহ, নিচে তোমার আমার অনন্ত ভালোবাসা। বৃষ্টি হলেই আমার সে স্বপ্নের কুঠুরি আমাকে নিয়ে চলে এক প্রমত্ত যৌবনে। বাইরে এক নিষ্করুন বারিধারা।
গত দুবছর আগে আমার দুর্ঘটনার পর থেকে আমার অনেকের সাথেই সম্পর্ক এখনও স্বাভাবিক হয়নি,বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া পরস্পরের কথাও হয় না। যাও বা হয়, ভাববাচ্যে। ক্রিয়াপদবিহীন।
এখন বৃষ্টি নেই। ফ্ল্যাট ময় ফিরে বেড়াচ্ছে এক স্যাঁতস্যাঁতে বাতাস। হালকা একটু রোদের হল্কা। একটু জিরিয়ে নিচ্ছে আকাশ। তবে মেঘ এখনো পুরোপুরি কাটেনি, ভারী শরীর নিয়ে অলস মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে আকাশময়। তার ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ সূর্য চোখ খুলছে। তার লাজুক আলোয় দুপুরের আকাশ যেন জলরঙে আঁকা ছবি। আমার ঘরে এক মায়াবী আলোছায়া।
ইদানিং খুব উদ্বেগে দিন কাটছে। উদ্বেগের ও প্রাণ আছে, প্রাণীদের মতো তার রুপভেদ ও অজস্র। কখন ও সে তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলে। কখনও বা একছিটে মেঘ হয়ে দেখা দেয় মনের আকাশে, ক্রমশ দখল করে নেয় হৃদয় গগন। আবার কখনও বা নিজের ফুঁয়েই নিজে হাওয়া ভরা বেলুনের মতো আতিকায় হয়ে ওঠে। আব্বা সব সময় বলতো সৎ পথে খেটে খাবি। মরে গেলেও চুরি জোচ্চুরি করে পকেট ভরাস না, দেখবি পেট আপনিই চলে যাবে।
তাই হয়তো কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নেই আমার। দিনতো চলে যাচ্ছে। অসৎ লোকগুলো নিজেদের স্ত্রী ছেলেদের মুখ দেখায় কি করে?? অথবা অসৎ লোকদের স্ত্রী রা নিজেদের কাছে নিজেরা মুখ দেখায় কী করে??
বাতাস বইছে। মৃদু, অতি মৃদু। ছিরছিরে বৃষ্টি নেমেছে বাইরে। আলো কমে এসেছে খুব। এই মুহুর্তে এই ঘরে নিজেকে ভিন্ন গ্রহের মানুষ মনে হচ্ছিল। বৃষ্টি পড়ছে। মুষলধারে, বড় বড় দানায়। জলের ঝাপটায় ভেসে যাচ্ছে ব্যালকনি। ধোঁয়া ধোঁয়া জলকণা মথিত করছে ত্রিভূবণ।
আজ অনেকদিন অহনাকে নিয়ে কোথাও যাওয়া হয় না। ইদানিং দেখছি ও খুব ছটফট করে। অহনা অফিস থেকে ফিরেই বলল, ইতি আপা আসছে ,খুশীতে ঝলমল করছিল অহনা। ওর অফিস থেকে ছুটি জুটছেই না। গত কয়েকদিন আগে আমাদের ঘর ভর্তি মানুষজন ছিলো,আম্মা এলেন ।তার পর আম্মা যাওয়ার পর এলেন অহনার আব্বা আম্মা ।উনারা চলে যাওয়ার পর কয়েকদিন আমাদের ঘর ধূ ধূ মরুভূমি ।আপা এলে ভালই হবে ।শুক্রবার কোথাও যাব না বরং অহনাকে নিয়ে একটু শহর ময় ঘুরব ।আহা কতদিন কোথাও যাওয়া হয়না দুজনের ।
হৃদয়ের গভীরে, অনেক গভীরে, কোথায় যেন একটা ভুমিকম্প হচ্ছে। বাতাসে এখন হিমরেণু।দুরের আকাশ তার জমাট দুঃখের নিশ্বাস পাঠাচ্ছে এই শহরে।বর্গাকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। আচমকা মহিলাকন্ঠ ছিটকে আসছে,তারপরই সম্পূর্ণ নীরব। কে যেন কাকে খুব জোরে বকে উঠল। একটা বাচ্চা কাঁদছে।
সংসার হল গিয়ে দড়ির ওপর হাঁটা। আমাদের সামনের ফ্ল্যাটের এক বৃদ্ধা দিনরাত বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবেন,রোদ্দুর আলো বাতাসের গন্ধ নেন। কীসের যেন একটা শব্দ হচ্ছে। একটা পাখি। কার্নিশ ছেড়ে সাঁ করে উড়ে গেল সামনের ফ্ল্যাটের ছাদে। দুর থেকে একবার ঘাড় ফেরালো আমার দিকে,তারপর মুখ ঘুরিয়ে নেমে এল কার্নিশে। সেখান থেকে আবার গুলমোহর গাছে উড়ে যাচ্ছে। উড়ছে। উড়ছে। দেখতে দেখতে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল পাখি। ইস্ মানুষের যদি ডানা থাকতো??
দিনকাল যত পাল্টাচ্ছে, সমাজ বদলাচ্ছে, ভাঙচুর হচ্ছে পুরনো, প্রচলিত ব্যবস্থায়, ততই এবং তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিয়তিও বদলাচ্ছে মানুষের। একটা লোকের থাকা না থাকার মধ্যে ব্যবধান সঙ্কুচিত হয়ে আসছে ক্রমশ,মানুষের অস্তিত্ব হয়ে পড়ছে অকিঞ্চিৎকর। মানুষের সাথে মানুষের যে সম্পর্ক, মৃত্যুর পরেও তার কোন রেশ থাকে কি??
আকাশের ভাবগতি দেখে মনে হচ্ছে যে কোন সময় নামতে পারে আবার।
চোখ বুজলেই স্মৃতির মিছিল। একটা গরম বাতাস আলগা ভাবে বয়ে গেল বুকের ভেতর দিয়ে। কত সযত্নে যে কত ক্ষত লালন করছি। কে জানে কেন বুকের ভেতর একটা সূঁচ বিঁধছে।
পত্রিকার পাতা জুড়ে কেবল ধর্ষণের খবর ,কি হচ্ছে সব চারিদিকে ।মনে হচ্ছে চারদিকে সব অমানুষে গিজগিজ করছে ।ছোট ছোট বাচ্চা মেয়ে গুলো ও রেহাই পাচ্ছে না ।জাহেলিয়াতের যুগ চলে এল বুঝি ।আগে তো রাগ-বিরাগ-অনুরাগ কিছুই লুকাতে পারতাম না । কিছু হলেই মুখ ছেয়ে যেত মেঘে । এইযে যখন অহনার প্রেমে পড়লাম কিন্তু কিছুতেই ওকে প্রকাশ করতে পারছিলাম না তখন মনে হত ভালোবাসায় হেরে যাওয়ার মতো লজ্জা আর কিছুতেই নেই ।নিজেকে প্রকাশ করতে না পারার যন্তণা বোধহয় আরও কষ্টের ।সে কষ্ট আমি জানি তবু চেষ্টা একবার করেছিলাম মরিয়া হয়ে বলে ফেললাম ।
চা শেষ করে সিগারেট ধরিয়েছি ।ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম । এখনো ঝাড়পোঁছ হয়নি । বই এর তাঁকে ধুলো ।চেম্বারে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছি ,পেছনে অহনা ।খোলা দরজার দিক থেকে শরতের বাতাস আসছে । বাইরের আলোর ঝলকানি ঘরে ঢুকে মৃদু ।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট