পর্ব-৩৮
এ অঞ্চলে মশা খুব । গোটা জায়গাটা এক সময়ে জলাভূমি ছিল । এখন অবশ্য অগুনতি বাড়ী । উচুঁ উচুঁ সব বিল্ডিং তৈরী হয়েছে ,হচ্ছে । তবু জলাভুমির ভূমির স্মৃতি ভূলতে দেয়না মশারা । সন্ধে হলেই ঝাঁকে ঝাঁকে হানা দেয় । বিকেল সাড়ে চারটার দিকে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে । দুপুরে হাসপাতাল থেকে ফিরতে ফিরতে অপরাহ্ন পেরিয়ে গেছে । দু’দিন ধরে শীত ঝাঁকিয়ে বসেছে । অহনা অফিস থেকে এসে ঘরের দরজা জানালা ভেজিয়ে বাতি জ্বেলে দিল । আমি চোখ মেলে চাইতেই বলল -কফি করে দেই এক কাপ ? আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই কিচেনে গিয়ে ঢুকল । টুংটাং আওয়াজ পাচ্ছি । চরাচরে এখন গাঢ় অন্ধকার । রাস্তার বাতি জ্বলে গেছে । মিহি কুয়াশায় চারপাশের বাড়ীর আলো কেমন অস্পষ্ট দেখায় । হাওয়া দিচ্ছে মাঝে মাঝে । এলোমেলো ঠান্ডা ঠান্ডা । এ বছর শীতটা ভালোই পড়বে মনে হচ্ছে । সবে ডিসেম্বরের দশ তারিখ , এখনই বাতাস কী ঠান্ডা হয়ে গেছে । অহনা বেশ শীত কাতুরে । দু’দিন ধরে একেবারে জবুথবু ।
এই মাত্র সন্ধ্যা নেমেছে শহরে ।আলোর সাজে সেজে উঠল রাস্তাঘাট । তির তির করে হাল্কা বাতাস বইছে ।বাদামী মখমলের মতো একটা নরম অন্ধকার ছড়িয়ে চারদিকে । আশে পাশের বিন্ডিং গুলো থেকে আলোর রশ্মি গড়িয়ে এসেও থমকে গেছে অদুরে । চোখ বুজে অহনাকে চোখে আনলাম ।অহনা এখনো বড্ড ছেলে মানুষ । বাচ্চা মেয়ের মতো কারনে অকারনে হাসি ,কথায় কথায় অভিমান ,একটুকুতেই খুশি ,দ্যাখ না দ্যাখ চোখ টলটল । নাটক সিনেমার আবেগী কোন সিন দেখছে ব্যস অম্নি চোখ টলটল । ওর অবস্থা দেখে আমি হেসে গড়াগড়ি খাই । অহনাকে পেয়ে সব দুঃখ ভুলে থাকি আমি । অহনা নতুন করে ভালোবাসা শেখাল ,নতুন করে স্বপ্ন দেখাল ,জীবনের ওপর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনল আবার । অহনা এখন আমার সব থেকে বড় আশ্রয় ।
অহনার চোখে চোখ রাখলে চৈতন্য বিবশ হয় আপনা আপনি । সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে । গালের খাঁজে ছড়িয়ে পড়ে লজ্জা ,নিজের অজান্তেই । কেন এমন হচ্ছে ।এই বয়সেও ,আশ্চর্য! তবে কি ভালোলাগা মুহুর্তগুলোর কোনও বয়স থাকেনা । নাকি তারা এরকমই বেহায়া ।রীতিনীতিহীন উল্টোপাল্টা স্রোতের মতো ।ট্রাফিক জটে বসে আছি ,সব সময়ে এই মোড়টা যেন জঙ্গল হয়ে থাকে । মানুষ আর যানবাহনের জঙ্গল । অনেকক্ষন হলো বসে আছি ,বসে বসে ভাবছি । পাশের রিকশায় দুই ভদ্র মহিলা আলাপ করছেন ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ী থেকে কি দিয়েছে আর কি দেয়নি । ভদ্রমহিলার কন্ঠে উষ্মা ,ভাই ইঞ্জিনিয়ার ভাই কে এটা দেয়নি সেটা দেয়নি । মনে মনে গালি দিলাম ,শালা ভিখিরির দল । মানুষ এমন কেন ? মেয়ের বাবার বাড়ী থেকে কি দিয়েছে জিজ্ঞেস করার আগে কেন যে ভাবেনা মেয়ের বাবা তো তার কলিজার টুকরো মেয়েটাকেই দিয়ে দিয়েছে ।কলিজার টুকরো দেয়ার পর আর কি দেয়া বাকী থাকে । এক অজানা মেয়ে ও তার বাবার জন্য আচানক একটা কষ্ট বোধ হতে লাগলো । আহারে জীবন ? মেয়েটাকে হয়তো সারাজীবন এই খোঁটা শুনতে শুনতেই মুখ বুঝে সংসার নামক সরু দড়ির উপর দিয়ে ব্যালেন্স করে চলতে হবে ।
মানুষ ভাবে অনেক কিছু , কিন্তু করে উঠতে পারে কই ? সপ্তাহে একটাই ছুটি অহনার , টানা ছ’দিন অফিস করে বেচারী শুক্রবার মরার মতো পড়ে ঘুমায় । গত ক’দিন ধরে কেবল বলছে কত দিন টিএসসসি যাওয়া হয়না ,শুক্রবার নিয়ে যাবে ? আমি অহনার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি , বেচারী ভরসা পায়না । ভরসা না পাওয়ার কারন হলো ,এমনিতে কারন ছাড়া বাইরে যাওয়া হয়না ।যদিও বা কোনওদিন বাসনাটা চাগাড় দিয়ে ওঠে ,একটা না -একটা ঝামেলা এসেই পড়বে ।হয়তো আচমকা কেউ বাড়ীতে এসে হাজির কিংবা আমার কোন প্রোগ্রাম সেট হয়ে যায় । আজ আমার চেম্বার নেই । অন্যদিন যখন রওয়ানা হই তখন আশেপাশের বাড়িঘর আধবোজা চোখে সবে শরীরের আড় ভাঙছে তখন । রাতের গ্লানি গায়ে মেখে সরু গলিটা এলিয়ে থাকে বাজারের মেয়েদের মত । রাত জাগা রাস্তার বাতি মাতাল চোখে পিটপিট তাকায় যেন । এইতো গত শুক্রবার ভোর রাতে একপসলা বৃষ্টি হলো ,সকালে যখন বের হলাম তখন রাস্তার এখানে সেখানে জমে ছিল গোলাটে জল । একটা আঁশটে গন্ধ ম ম করছিলো চর্তুদিকে । রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা নোংরা ন্যাকড়া ,এঁটোকাটা ,কুকুরের পায়খানা সব মিলে মিশে একাকার । বহুকাল এ গলির কোন সংস্কার হয়নি । জায়গায় জায়গায় ডুমো গর্ত ।পীচ ঢালাই ঢেউ খেলে গেছে ।
টিএসসি যখন পৌছেছি তখন ও বাইরে এখন ফটফটে আলো । তবে কেমন নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে বিকেলটাকে । যেন মরা মরা । কলা ভবনের সামনের ছায়া ছায়া গাছপালা , মলিন প্রান্তর । লোকজন বসে বসে নিজেদের মধ্যে গল্প করছে । প্রত্যেকের গল্প গুলো তো জীবনের এক একটা ভগ্নাংশ । এক একটা মুহুর্ত এক একটা গল্পের ভগ্নাংশ । এসব গল্পে হয়তো টিভি নাটকের গল্পের মতো ঝ্যাং ঝ্যাং বাজনা বাজে না । অহনা আদুরে বেড়ালের মতো আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো ।অহনার মেজাজটা ফুরফুর করছিল খুশীতে । কুয়াশা ঝরছে । মশা ওড়ছে নাকমুখের পাশ দিয়ে । বাসায় ফিরে অহনা ক্লান্ত । রাতে অহনা ঘুমিয়ে পড়লে আমি মাঝে মাঝে বেড়ালের মত নিঃশব্দ পায়ে এসে দাঁড়াই জানালার গরাদের ওপারে । এক ছটাক আকাশ গাঢ় নীল রং নিয়ে ঝুঁকে পড়ে আমার মুখের ওপর । গুটি কয়েক তারা জ্বলে ,নেভে । অনেক কিছু ভাবনায় আসে ,মস্তিষ্কের কোষে ঢুকে পড়তে থাকে অতীত । হিসেব মেলাতে চাই অনেক কিছু । পারিনা । চিন্তাগুলো একসঙ্গে তালগোল পাকিয়ে মন্ড হয়ে যায় । একটাকে অন্যটার থেকে পৃথক করার ক্ষমতা হারিয়ে যায় । মাথা যেন টগবগে ভাতের হাঁড়ি । তার ভেতরে অতীতের কথা গুলো হাতা-খুন্তির মতো অবিরাম পাক খেয়ে চলে ।
ঘরের বাইরে ভেতরে সমান অন্ধকার ।তবে সব অন্ধকারেই বোধহয় এক ধরনের আলো থাকে । নাকি সয়ে গেলে অন্ধকারও অভ্যাস হয়ে যায় ?বাইরের মেহগনি গাছটাকে অন্ধকারে কি রকম অশরীরি মনে হচ্ছে । শেষরাতে চাঁদ ডুবে গেছে বেধ হয় ।তাই কি অন্ধকার এত গাঢ় । আকাশ ছায়া ছায়া । কালচে । বাতাসে প্রচুর হিম । হিম বাতাস বাষ্প জমিয়ে দিচ্ছে বুকে । মনটা স্যাঁতসেঁতে করে দিচ্ছে । ছেড়ে আসা সব জায়গার কথা মনে পড়ছে । আসলে কি সব মানুষের জন্য জায়গা স্থির করে রাখা আছে ।সময় ফুরালে পুরনো জায়গা ছেড়ে দিতে হয় । কোন মানুষটা একা নয় পৃথিবীতে ? নিজের হৃদয়ে সকলে তো আজীবন একা । বাইরের পৃথিবীতে আলো ফুটতে শুরু করেছে । হঠাৎই বাইরের মেহগনি ডাল থেকে একটা কাক ডেকে উঠল রুক্ষ স্বরে । ঘোর কেটে গেল ।উঠে নিঃশব্দে বিছানায় শুয়ে পড়লাম । বাঁ হাত দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে দু’চোখ ঢেকে শুয়েছি । অহনা হাত দিয় পেঁচিয়ে শুয়ে পড়লো । চোখের ওপর অন্ধকার নামলে আমি একটা নদী দেখতে পাই । বিশাল চওড়া এক রুপোলী নদী । নদীর বুক বেয়ে তিরবেগে ছুটে যাচ্ছে নৌকা । দ’পাশে টলমলে ঢেউ উঠছে । যেখান দিয়ে নৌকা যায় ,দাগ ফুটে ওঠে । গাঢ় । রাস্তার মতো। কয়েক মুহুর্তের জন্য । তারপর ঢেউ ও নেই , দাগ ওনেই । মায়া ।সব মায়া । বিশাল নদীটাই সত্য শুধু নৌকা নয় ।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট