পর্ব- ৩৯
রিকশা ভাড়া মেটাতে গিয়ে চড়াং করে মাথা গরম হয়ে গেল । রিকশা ওয়ালাকে দিলাম একশো টাকার নোট ,ফেরত দেবে পঞ্চাশ অথচ একটা কুড়ি টাকার আর একটা দশ টাকার নোট ঠেকিয়ে কি নির্বিকার পান চিবুচ্ছে !কী অসভ্য ,কী অসভ্য ! কাঁহাতক এই অভদ্র লোক গুলোর সঙ্গে ঝগড়া করা যায় ? টাকার পরিমানটা বড় কথা নয় ,বেসিক অনেস্টি বলে কিছু থাকবে না ? এই চোট্রামির মানসিকতাই তো খারাপ । আজ অবশ্য ঝগড়া করার কোন স্পৃহাই নেই । অন্য সময় হলে ঝগড়া করতাম । মেজাজ খারাপ করে বাসায় গেলে অহনা খুব রাগ করে ।অহনাদের বাড়ী যাব আর এসময়টায় মেজাজের পারদ কিছুটা নিচেই রাখতে হবে । অহনাদের ওখানে দু’একজন আছে যাদের মূল গবেষনার বিষয়ই হচ্ছে আমি আর অহনা । আমি অবশ্য অত গা মাখাই না ,আসলে এ ধরনের লোকজন গায়ে মাখার মত নয় , এরা অনেকটা ক্যাপুচিনো টাইপ । জিভে তেতো লাগে ,কিন্তু স্টিমি উলোটিং । নার্ভ সতেজ রাখে । কিংবা ঠান্ডা সমোসার মত । খেলেই অম্বল । তাই ওসব লোকজন কে খেতেও নেই আবার গিলতেও নেই । সে যাই হোক অহনার বাড়ীর নিরানব্বই পার্সেন্ট ভালো মানুষদের সাথে ওই এক পার্সেন্ট নিয়ে কেন ভাবছি ?
কাজের দিনে অহনার সকালটা ছোটে পাগলা ঘোড়ার মতো । এক ঘন্টা যে কিভাবে কাটে ,অহনা ঠাহরই করতে পারেনা ।আটটার সময় অ্যালার্মের ঝনঝন ,অম্নি ধূপধাপ হুড়ুদ্দুম শুরু । ধূম করে উঠছে , ঢুকছে বাথরুমে , ছুটছে কিচেনে । অহনা বেরিয়ে গেলে ফ্ল্যাটখানা নিমিষে নিঝুম । ঘড়ির কাঁটা যেন আর চলতেই চায় না । এই স্থবির সময়ের ,কিংবা বড় জোর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা সময়ের , আমি আর অহনা পাশাপাশি দেখি বলেই কি কেজো সকালটাকে বেশী বেগবান মনে হয় ? হয়তো বা । আচ্ছা অহনার থাকা না থাকায় যে আসমান-জমিন ফারাক ,তা কি অহনা টের পায় ? সে কি জানে আমার একেবারে শূন্য হৃদয়ের কলসি স্মৃতির বাতাসে শুধু ঢংঢং করে বাজত ।সেই কলসি এখন ছোট ছোট খুনসুটি ,মান -অভিমান , প্রেম -ভালোবাসায় টলটল । অফিস বেরনোর সময় অহনা ব্যালকনি লাগোয়া দরজাটা হালকা খুলে দিল ,ব্যস অমনি ঝুপ করে ঠান্ডা ঢুকে পড়লো ঘরে । বইছে হাড় কাঁপানো হাওয়া । সকাল সকাল ঠক ঠক কাঁপছে শহর । অহনা যাবার পর উঠে গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ালাম ।ছায়া ছায়া অন্ধকার কেটে একটু একটু করে আলো ফুটছে ।সামনের আকাশ এতক্ষণ বর্ণহীন ছিল ,এখন হালকা গোলাপী । গতিময় শহরটা জাগছে ,জেগে উঠছে ।
দুপুরটা নিস্তরঙ্গ কেটে গেল । খেয়ে শুয়ে ,গড়িয়ে গড়িয়ে । মাথার ওপর রোদ ঝলমলে আকাশ ,বাতাস বইছে শনশন … একবার মনে হলো ,আহ , বেঁচে থাকাটা কী সুখের ! আকাশ পাতাল ভাবনা ঘুরছে মনে । ভাবনা ,না সংশয় ? অহনা কি আমার সে প্রেম ,যে প্রেমের সন্ধানে কেটেছে আমার জীবন , কিংবা বুকের শূন্যতা ভরানোর এক মুঠো কুড়িয়ে পাওয়া সুখ ? বাঁচার জন্য আঁকড়ে ধরা খড়কুটো । দমকা বাতাস উড়ে এল একটা ।ঠান্ডা বাতাস ,হাড় কেঁপে গেল । আসলে আমার জীবন এখন আবর্তিত হচ্ছে অহনার চাওয়া পাওয়ার বলয়ে । ক’দিন ধরে জোর ঠান্ডা পড়ছে ঢাকায় । আজ ভালো করে শ্যাম্পু না করলেই নয় । শীতকালে এম্নিতেই বড় খরখরে হয়ে যায় চুল ।কাল পত্রিকায় এসেছে ঢাকায় দিনে উনচল্লিশটা ডিভোর্স হয় । সংসার ভাঙে । হায়রে , লোকে শুধু ভাঙাটাই দেখে ।পিছনের প্ররোচনাটা বোঝে কে ? এক ছাদের নীচে এক বিছানার ভাগীদারই শুধু টের পায় অন্যজন কি চিজ ! বাইরের দুনিয়ায় প্রক্ষেপিত ভাবমূর্তি দেখে কেউ আন্দাজই করতে পারেনা একএকজন কি মাল । একটা আদ্যন্ত বেমানান জুটি হাটের মাঝে পাঁক ছোঁড়াছুঁড়ি না করে পৃথক হলে মন্দ কি ? তবে বেশীর ভাগই পাঁক ছোঁড়াছুঁড়ি হয় ,আদালতে গড়ায় ।কিন্তু সম্পর্ক তাতে টেকে কি ? বিকেল ফুরিয়ে যাচ্ছে । বড় বড় অট্রালিকার আড়ালে একটু একটু করে মুখ লুকাচ্ছে সূর্য । গাছ-গাছালী রং হারাচ্ছে । অহনার ফেরার সময় হয়েছে ।
শীত আসার পর ইদানিং নতুন নিয়ম হয়েছে অহনার ,অফিস থেকে ফিরে নিজ হাতে আমার জন্য কফি করবে আমি চেম্বারের জন্য বেরিয়ে যাবার পর ব্ল্যাঙ্কেটের নিচে নিজেকে সোপর্দ করে রাখবে । আমি ফেরা অব্দি নট নড়ন চড়ন । দু’বছর ধরেই দেখছি একই নিয়মে আমি চেম্বার থেকে ফেরার পর ফোন করেন অহনার বাবা । কথা বলেন কন্যার সাথে । অদ্ভুদ এক বন্ধুর মতো সম্পর্ক বাবা মেয়ের । বয়স হয়েছে সাতান্ন মতো কিন্তু টগবগ করেন সারাক্ষণ । এত জোরে হাঁটেন ,অল্প বয়সিরাও পাল্লা দিতে হাঁফিয়ে যায় । মুখে চোখে বয়সের ছাপ ও নেই তেমন । স্বচ্ছন্দে বয়স চল্লিশ বিয়াল্লিশ বলে চালিয়ে দেয়া যায় । আমার সাথেও বন্ধু সূলভ । আমি আড় পেতে বুঝতে চেষ্টা করি বাবা মেয়ের কথোপকথন । সাধারন সব কথাবার্তা ,সাংসারিক টুকিটাকি ,অভিযোগ আর অহনার মায়ের কথা বার্তা । আর আমরা অহনাদের গ্রামের বাড়ী যাব শুনলেই অস্থির হয়ে যান অহনার আম্মা । কি খাবে মেয়ের জামাই ,সব জোগাড়ে তোড়জোড় লাগিয়ে দেন । মমতার খনি বলা যায় অহনার মা কে । ছোট্র একটা শরীরে এত মায়া ,মমতা কোথায় যে লুকিয়ে রাখেন ,সেটাই একটা বিস্ময় । শ্বশুর-শ্বাশুড়ী দু’জনকেই আমার মারাত্মক রকমের পছন্দ । আমি যেখানেই যাই চারপাশটা একটু অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করি । ভালো মন্দ মিশিয়েই তো মানুষের ভাললাগা । ভাল না লাগাটা এক ধরনের অসুখ । আমাকে এখনো ওই অসুখে ধরেনি ।
আর এক জোড়া মানুষ আছে যারা আমি যাব শুনলেই অস্থির হয়ে যান । অহনার বোন লিজা আপা আর তার বর জীবন ভাই । জীবন ভাই লিজা আপার শরীরের পঁচাশি ভাগ মায়া মমতা আর পনের ভাগ ভালবাসা দিয়ে ভরা । দুজন মানুষ একই রকম । একই রকম বলেই হয়তো কি অপরিসীম ভালোবাসায় মাতিয়ে রেখেছেন নিজেদের সংসার । শুনেছি এবার ইতি আপা ও থাকবে , হ্যা ইতি আপা অহনার আরেক বোন যে পাশে বসলেই আমি একটা মা মা গন্ধ পাই । ছোট বেলায় আম্মার গায়ে যে গন্ধটা পেতাম তেমন মা মা গন্ধ । লোক ব্যক্তি ব্যক্তিতে তফাত খোঁজে ।তফাত আছে কি নেই সেটা বড় ব্যাপার নয় , আসল ব্যাপার হলো ,যে দেখছে তার মনটা । যেমন জীবনে একটা সময় সামান্য পার্থক্য ও খুব প্রকট লাগে । আবার এমনও সময় আসে ,যখন ডিফারেন্স গুলো খোঁজার দৃষ্টিটাই চলে যায় । তখন ভাল মন্দ সুন্দর কুৎসিত সব কিছুই মনে হয় এক রকম । জীবনের রংগুলো ও তখন আলাদা করা যায়না । এভরিথিং বিকামস গ্রে । ধূসর ।
ল আব্বু আর আম্মু ও আসবে এবার ।সাথে সেতু গিন্নী এলে ভালোই হবে । ওর একটা প্রপার কাউন্সেলিং দরকার । কী কষ্টটাই না সয়েছে মেয়েটা ? যতটা না শরীরে তার চেয়ে ঢের ঢের বেশী মনে । মেয়েরা কত আশা নিয়ে ঘর বাঁধে , স্বপ্ন ভঙ্গের অভিঘাত অন্তরাত্মাকে যে কীভাবে চুর চুর করে দেয় এটা সেতুর চেয়ে বেশী কেউই অনুভব করতে পারবে না । একটা মেয়ের জীবনে বিয়ের চেয় বড় বেশী জরুরী হলো নিজের পায়ে দাঁড়ানো । দিনশেষে মেয়েদের নিজের ঘর কোথায় ? নিজের একটা আইডেন্টিটি তৈরী না করতে পারলে সারাজীবনই তো তাকে আত্মপরিচয়ের সন্ধানে ছোটাছুটি করতে হয় । অমুকের বউ তমুকের মায়ের পরিচয়ে বাঁচার চেয়ে ঢের ভালো নিজের পরিচয় । নিজের স্বতন্ত্র আত্মপরিচিতি ।
মেজো আম্মু ,মেজো আব্বু , শান্তা ভাবী ,রুবেল ভাই কতটা ভালোবাসার ঝাঁপি খুলে অপেক্ষা করছেন তা আমার চেয়ে বেশী আর কে জানে । আহ মেজো আম্মুর হাতের পায়েস আমার চেয়ে বেশী কে মিস করে ?
আর একজন আছে আমার ছোট গিন্নি কুসুম ।বেচারী বোধহয় ক্যালেন্ডারের পাতায় দাগ কেটে কেটে অস্থির । যে কয়দিন থাকব সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকবে আর চলে আসার সময় কেঁদে কেটে একসার করবে । কুসুমের এক একটা মুহুর্ত এখন এক একটা দিন ।প্রতিটি মিনিট বছরের চেয়ে দীর্ঘ । ওকে এবার সাথে করে নিয়ে আসব ভাবছি । জীবনকে উপভোগ করার আগেই মেয়ে গুলোর জীবন কেন যে দূর্বিসহ হয়ে যায় ? আর আমার শ্যালক গুলো সব এক একটা হারামীর হাত বাকসো । জীবন গোছানোর আগেই সব বিয়ে করে বসে আছে । সব ভাবের চরকিতে লাট খাচ্ছে ।ওরা ভাবছে জীবন ব্লাডমেরির গ্লাসের বুদবুদের মতন । আহাম্মক সব ।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট