পর্ব-৪১
পশ্চিমের জানালার পেলমেট থেকে ঝোলা ভারী পর্দা দুটোর গায়ে ,বন্ধ কাচের শার্সিতে প্রভাতী আলোর আভাস । মন কেমন করা স্মৃতির মতো ।মনোরম কিন্তু বিষন্ন । অহনা অফিস চলে গেছে । গোটা বাড়ীটা নিঝুম । আজ দু’দিন শীতটা বেশ ঝাঁকিয়ে পড়ছে । হিম বাতাস ঢুকবে বলেই হয়তো অহনা ব্যালকনির দরজা লাগিয়ে দিয়ে গেছে । তাতে ঘরটা আরো বেশী নিঝুম লাগছে । চর্তুদিক চাপা বলেই হয়তো ঘরটায় আলো কম । আধো আলো আধো ছায়া ঘরময় । আবছা আলো , দেয়ালের ছবি , নীল পর্দা সব মিলিয়ে পুরো দৃশ্যটার একটা আলাদা আকর্ষণ আছে । দেয়ালে ঝোলানো শাড়ী পরা অহনার ছবিটা রোজ ঘুম ভাঙলে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকি । জীবনের সব রুপ রস বর্ণ গন্ধে ভরা ,একটা সম্পূর্ণ নারীর ছবি । আয়েস করে একটা সিগারেট ধরিয়েছি । আআহ। ধোঁয়াগুলো মাথায় ঢুকে কারুকার্য শুরু করে দিয়েছে । ক্রমে মাথার ভেতরটা কি আশ্চর্য রকমের হালকা । রোজ রোজ লোকের দাম্পত্য কলহের গল্প শুনছি । দেখে শুনে আমার কেন জানি মনে হয় , রোমিও জুলিয়েটের বিয়ে হলেও শেষ পর্যন্ত কলহ হতো । দেখা যেতো জুলিয়েট কৌটো ছুঁড়ছে , বাসন ভাঙছে ; রোমিও রাগে গরগর করতে করতে হিংস্র নেকড়ের মতো গোটা বাড়ি দাপাচ্ছে । আর শহরের লোক তালি দিয়ে মজা দেখছে । হায়রে প্রেম ।
বারান্দায় এক চিলতে সূর্যের আলো টেরচাভাবে এসে পড়েছে ,আলোটুকু ছাড়া বারান্দার আর কিছুই স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান নয় । রোজই দেখছি বারান্দায় কিছুক্ষণ ওই আলোটা থাকে তারপর উধাও হয়ে যায় । ওটা মনে হয় আমার ভাগের আলো । পৃথিবীতে সবার ভাগেই বোধ হয় ওরকম পৃথক পৃথক আলোর টুকরা থাকে । বাদবাকি সবটাই স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার । ওই আলোটুকুর জন্যই তো বেঁচে থাকে মানুষ ।তাহলে অহনার আলোটুকু কী ও অফিস যাবার সময় নিয়ে যায় ? ওর অফিসের জানালা দিয়ে সে আলো ওর ভাগেরটা দিয়ে যায় ? অহনাকে একদিন জিজ্ঞেস করতে হবে । অহনা হয়তো সে আলোর কথা জানেই না । সবাইকে সব জানতেই হবে তার কোন মানে নেই । কয়েকদিন ধরে মন খারাপ । কিছু পরকীয়ার গল্প , কিছু মন ভাঙার গল্প শুনছি । কিছু পুরুষ আছে বউকে মানুষ বলেই গণ্য করেনা । তাদের শুধু শো-কেসে রাখার জন্য একটা বউয়ের দরকার হয় । দরকার মত চাবি খুলে তাক থেকে নামিয়ে আদর -ফাদর করে আবার তাকে তুলে রাখবে । আর তারা ঘরে না থাকলে পুতুল তাক থেকে নেমে তাদের ঘরদোর সামলাবে । কি আজব মেন্টালিটি মাইরি । আবার বউ গুলোও কেমন দম দেয়া ঘড়ির মতো । আসল ব্যাপারটা হলো ফিলিংস । অনুভূতি । তুমি কিভাবে তোমার চারদিক দেখবে ,সে দেখার রঙ কিরকম , রুপ কিরকম , সবটাই তোমার নিজের ব্যাপার । তুমি কেন আরেক জনের ইচ্ছা অনিচ্ছার বলি হবে ?
কোন ঘটনাটা যে আকস্মিক ,সেটার বোধ হয় সঠিক সংজ্ঞা হয়না । ইমোশনাল হয়ে কোন সম্পর্কে জড়ানোটাও কোন কাজের কথা হয় না । দীর্ঘদিনের অনভ্যাস নিকটতম সম্পর্কেও মরচে ধরিয়ে দেয় । জানুয়ারি শেষের দিকে । অতিথি শিল্পীর ভূমিকায় শীত এখন ঢাকায় তার স্বল্পকালীন দাপট দেখাচ্ছে ।অহনাদের বাড়ীর সবাই বেশ শীত কাতুরে তবে আমার শীতবোধ একটু কম । সারা বছরই আমার ফ্রিজের পানি খেতে হয় । রাস্তায় নামতেই মনটা ভালো হয়ে গেল । চমৎকার এক ঝকঝকে দিন ফুটে আছে বাইরে । শীতের রোদের রঙ এত নরম ,এত সোনালী হয় ! এ রকম দিনে মন খারাপ করে থাকাই যায় না । সূর্য হেলে পড়েছে । প্রথম বিকালের সাদাটে সূর্য । ক্রমশ তাপ ফুরিয়ে আসছে । তবু শেষবারের মত ভাস্বর । আমার মুখে সেই পড়ন্ত বেলার রোদ । উল্টোদিকের ফুটপাতে ভিখারি পরিবারের শিশুরা উদ্দাম ছোটাছুটি করছে । রাস্তায় অবিশ্রান্ত পথচারীদের আসা যাওয়া । আসাদগেট নিজস্ব নিয়মে শব্দময় । শীতের সেলের বাজার গমগম করছে দুদিকের ফুটপাতে । যার সাথেই দেখা হচ্ছে বলছে -ইউ আর লুকিং সিক । টেক সাম রেস্ট ।
আমার বিশ্রাম ? আমার বিশ্রাম কোথায় ? বিশ্রাম ,অবসর শব্দ গুলো কবেই তো মুছে গেছে আমার অভিধান থেকে । সেই গোয়ালপট্রির চেম্বার দিয়ে শুরু ছাব্বিশ বছর বয়সে । তারপর আর কোনদিন দাঁড়াবার সময় পেলাম কোথায় ? আমি কোনদিনই স্রোতের মানুষ হতে চাইনি । স্রোতের মানুষ ভাসতে ভাসতে চড়ায় আটকে গেলে আটকেই থাকে । স্রোতের সঙ্গে নয় আমি চেয়েছি আমি যেদিকে যাব স্রোতকেও নিয়ে যাব সেদিকে । হায় রে মানুষের স্পর্ধা !
যতই এগিয়ে যেতে চাইছি লোক পেছনে টেনে ধরছে । কোন মানুষই শুধু স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকতে পারেনা । নিজের মত করে আরেকবার জীবনটাকে গড়ে তুলতে চাওয়া অন্যায় ? অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে সারা জীবন আপস করে চলতে হলে তার পরিণতি কি হয় আমি জানি । দু’ বছর আগে আমাকে সর্বশান্ত আর নিঃস্ব করে দিয়েছিল একদল মানুষ ,তাদের লোভ লালসা চাপিয়ে দিয়ে আমাকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছিল । আমি তো সেই পুরনো দুঃখ আঁকড়ে ধরে বসে থাকিনি । একটাই তো মানুষের জীবন । সেটাও যদি অন্যের অপরাধের বিচার করতে গিয়ে , প্রতিশোধ নিতে গিয়ে শেষ করে ফেলি তবে আমার রইলো কি ? সুক্ষ্ম সর্ষে দানার মত কষ্ট বুকে নিয়ে ফিরছি ,চলছি আর বেঁচে আছি । কি ভয়ানক এক অন্তর্দাহের পাহাড় বুকে নিয়ে আমি চলছি সে কেবল আমি জানি । প্রতিটি মানুষই কোন এক নির্দ্দিষ্ট বিন্দুতে এসে নিজের কাছেই অসহায় ।জীবন তো একটাই । সেই জীবন কে কত ভাবেই না ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে মানুষ । জীবনের মানে খুঁজছে । নিজেদের মতো করে । জীবনে যাদের কেই বেশী প্রায়রিটি দিয়েছি তারাই ঠকিয়েছে আমাকে । এখন যারা ঠকাচ্ছে তাদের ও প্রাওরিটি দিয়েছি । আমার ঠকা অবশ্য এমন নতুন কিছু নয় । ওরা আমায় ঠকাচ্ছে না বরং নিজেরাই ঠকছে ।
এ জগতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে সততার সাথে কাজ করা । চেষ্টা করে যাচ্ছি কিন্তু পারছি কি ? লোক টেনে হিচড়ে অসততার পঙ্কিল পথে ঠেলে দিতে চাইছে । টিকে থাকতে পারছি কই ? অহনা আসতে এখনো ঘন্টা দেড়েক বাকি । ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম । দাঁড়িয়ে আছি দাঁড়িয়েই আছি । পৃথিবী শীতল হচ্ছে ক্রমশ । বায়ুমন্ডলে পাতলা কুয়াশার পর্দা । কম্পাউন্ডের বাইরে অত্যুজ্জ্বল রাস্তার বাতি , দুর থেকে তাও যেন ধোঁয়া ধোঁয়া । অহনা সত্যিই বড় সাদা মনের মানুষ । মালিন্যহীন । সংকীর্ণতাবিহীন । এ বয়সে একটা নিজের ঘর নিজের গাড়ী নেই বলে কোন আপসোস নেই বরং পাঁচ জনের কাছে নিজের স্বামীর কথা গর্ব করে বলতে ও ছাড়ে না । চিত্ত বিক্ষেপ ঘটলে মানুষ অনেক সাধারণ জিনিসও ভুলে যায় । রবিনের শ্রাবণে যাওয়ার কথা ছিল আমি ভুলেই বসে আছি ।
সকালে খবরের কাগজ দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভয়ঙ্কর বীভৎস এক খবর । মীম নামের ছোট এক কিশোরী টি এস সি শহীদ মিনারের আশে পাশে ফুল বিক্রি করতো । ওইতো কয়েকদিন আগেও অহনা আমি স্বপন ভাইয়ের দোকানে বসে অপেক্ষা করছি আকরাম ভাইয়ের জন্য ,মেয়েটা এসে বলল মামা একটা ফুল দেই ? সেদিন নেইনি ফুল , বলেছি আজকে নিব না রে । একটা হাসি দিয়ে আস্তে আস্তে চলে গিয়েছিল মীম ।আজ নাকি শহীদ মিনারের পেছনে তার বিবস্ত্র লাশ পাওয়া গেছে ! মেয়েটার মুখটা ভেবে প্রচন্ড বিমর্ষ বোধ করছি । গভীর রাতে পুলিশ তার দেহ উদ্ধার করেছে । আর কত ? আলজাজিরা একটা ডকুমেন্টরী করেছে সেনা প্রধান আর তার ভাইদের নিয়ে সেটা নিয়ে দেশজুড়ে কানাকানি চলছে । পক্ষে বিপক্ষে সোস্যাল মিডিয়ায় গমগম করছে মতামত ।আমার কোন মন্তব্য নেই ,কারণ বিষয় গুলো এমন নয় যে হুট করে কিছু ঘটেছে । এগুলো তো ওপেন সিক্রেট ,এ তো নতুন বোতলে পুরাতন মদ বিক্রির মতো , মাল ও আগের কোম্পানিও আগের কেবল বোতলটা নতুন । গ্রামের চায়ের দোকানের কালু চাচা কিংবা জসিমুদ্দিরা আল জাজিরার চেয়ে বেশি জানে ।গত বারো বছরে এর চেয়ে চটকদার আরো অনেক গল্প লোক জানে । সবচেয়ে বড় গল্প তো তাহাজ্জুদের পরে ভোট ।
কত রকমের অসংগতি ! মানুষের জীবনের গল্প গুলো কত অদ্ভূত ধরনের ।বেশ অভিজাত ঘরের একজন রোগী আসলেন , ভদ্রমহিলা এক সময় লেখালেখি করতেন ।সন্তান সন্ততি না হওয়ায় বেশ আগেই ভদ্রমহিলার সাথে স্বামীর ডিভোর্স হয়ে যায় । ভদ্রমহিলার বয়স পঁয়শট্রি ।নিজের বোনের ছেলেকে একরকম নিজের সন্তানের মতই মানুষ করেছেন । এখন ছেলে চাকরী করছে আলাদা থাকতে হচ্ছে। ভদ্রমহিলা একাকীত্বের হতাশায় এলোমেলো আচরণ করছেন । কার্ডিয়াক কিছু কম্প্লিকেশন আছে তাই স্বজনরা নিয়ে এসেছেন । উনার গল্প শুনছি ,বেশ মায়া অনুভব করছি ।একাকীত্ব আসলেই মানুষকে কুরে কুরে খায় ।মস্তিষ্কে চিন্তার জট পাকিয়ে যায় হয়তো ।ভদ্রমহিলার স্মৃতিতে আচ্ছন্নতা ,চারপাশের আলোতে ও হয়তো ।উনি বললেন উনার মাথা জুড়ে দাপাদাপি করে নিঃশব্দ শব্দরা ।ভদ্রমহিলা চলে গেলেন । আমি ঝিম ধরে বসে আছি ।এই মুহূর্তে এই মুহূর্তটি ছাড়া আর কিছু নেই ।স্মৃতি নেই , আলো কিংবা অন্ধকার ও নেই । ভবিষ্যৎ ও নেই । কিংবা সমস্তই আছে শরীরের সংস্পর্শে ।অনুভূতির ভিতরে ।এখনও যারা জীবিত কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো কেউ কেউ মৃত হয়ে যাবে । কেউ কেউ হয়তো নিশ্চিত সংবাদও হবে ,হয়তো নয় । মীমের মৃত্যুর মতোই হয়তো কোন মূল্য থাকবে না কোন কোন মৃত্যু।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট