1. fauzursabit135@gmail.com : Fauzur Rahman Sabit : Fauzur Rahman Sabit
  2. sizulislam7@gmail.com : sizul islam : sizul islam
  3. mridha841@gmail.com : Sohel Khan : Sohel Khan
  4. multicare.net@gmail.com : অদেখা বিশ্ব :
বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৫:৫৭ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ :

ডা. মোজাহিদুল হক এর ধারাবাহিক গল্প ৪২

সাহিত্য ডেস্ক
  • প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২ জুন, ২০২২

জীবনের গল্প

-ডা.মোজাহিদুল হক

পর্ব-৪২

শহরের ত্বকে শেষ বিকালের নরম আলো । এ আলোয় যত না আবেশ ,বুঝি বা ততটাই বিষাদ । আলোটুকু মুখে মেখে চারুকলার গেটে এসে দাঁড়িয়ে আছি । চোখ চালিয়ে দেখছি নানান নাটকের পোস্টার , কত রকমের প্রতিবাদী পোস্টার ,ব্যানার । বাঁয়ে পুরনো বিল্ডিং এর দিকে খানিকটা বাতাস ভাসিয়ে দিলাম । বিল্ডিংটা টের পেল কি দীর্ঘশ্বাসটা ? সুর্য এখনো ডোবেনি পুরোপুরি , বাতি গুলো কেমন ফ্যাটফ্যাট করছে । তবে পরিবেশ টা বেশ । এই শহর কী দ্রুত বদলে যাচ্ছে । পায়ের তলায় শুকনো পাতা ভাঙছে মড়মড়। শুকনো পাতারাও কি বুঝল কিছু ? দুর , আমি নিজেই তো একটা শুকনো পাতা । জীবনের গাছ থেকে খসে পড়িনি ,এই যা । জীবনই যার দীর্ঘশ্বাসের খবর রাখে না ওই পুরনো বিল্ডিং কিংবা ঝরা পাতারা তার সমব্যথী হবে কেন ?  রোজ কত কিছু বদলে যাচ্ছে কেবল আমারই কোন বদল ঘটল না । একটা দম দেয়া ঘড়ির মধ্যে জীবনটা আটকে রইলো । চার পাশে কত রঙের খেলা ! একদিন অহনা বলেছিল ,জীবন তার নিজের পথেই চলে , শূন্যতা আপনাআপনি ভরাট হয়ে যায় । অহনা কি করে জানবে ,ভরাট তো হয় তবে চিহ্নটুকু তো মোছে না । পুরনো মূল্যবোধ আঁকড়ে থাকা এই আমি ক্রমশ বাতিলের তালিকায় চলে যাচ্ছি ।আজকাল মূল্যবোধ নাকি চলে না টাকাই সব । হাটতে হাটতেই কাটাবন মোড় পার হচ্ছি ।আকরাম ভাইয়ের অফিসে যাব ।

বাইরে একটা ফুরিয়ে আসা বিকেল । ম্লান সন্ধ্যা নামছে মন্থর পায়ে । মাঘ মাস শেষ হয়ে এল । বাতাসে বাষ্প নেই তেমন , এখনও হাওয়া কেমন শুকনো শুকনো । মানুষ খুব অসহায় বোধ করলে কোনও একটা আশ্রয় খোঁজে । দেহের ধকল ,শরীরপাত , এগুলো তাও দেখা যায় কিন্তু মনের ক্রমশ ক্ষয়ে যাওয়া কে দেখে ? সেদিন একজন বললো স্যার একটা গাড়ী কিনে ফেলুন । গাড়ী এ জনমে আর হয়তো হবেনা । আসলে কেনাটা বড় কথা নয় মেনটেইন করাটাই ঝামেলার । ড্রাইভারকেই তো খাইয়ে পরিয়ে পঁচিশ ত্রিশ দিতে হবে ,তারপর গ্যারেজ ভাড়া , গাড়ীর মেনটেইনেন্স , চোখ বন্ধ করে সত্তর আশি হাজার লাগবে ।তাও স্রেফ চেম্বারে আসা যাওয়ার জন্য । ছুটির দিনে বউ নিয়ে প্রমোদভ্রমনে যাব ,এমন শৌভাগ্য করে তো আসিনি আমি । মানুষের রোগ ছুটির দিনে একটু বেশীই মনে হয় বেড়ে যায় । কোথাও ঘুরতে যাব অম্নি চেম্বারে রোগী এসে বসে থাকবে ।বন্ধুরা শহরের উপকন্ঠে জায়গা জমি কিনছে । ভবিষ্যৎ গোছাচ্ছে আর আমি বর্তমান গোছাতেই কুল কিনারা পাচ্ছি না । আমারও ইদানিং সাধ হয় নদীর ধারে একটা বাড়ী হবে আমার । সূর্য যখন ডুবে তখন নদী কেমন লাল হয়ে যায় , ছাদে বসে সে লালে ডুবে থাকবে আমার চোখ ,আর সারাদিন জলের ছলাতছল শব্দ …, । নিরালায় , নির্জনে । দীর্ঘ ম্যারাথন দৌড়ের পর যেমন একটা বিরামভূমিতে পৌঁছাতে সাধ যায় মানুষের ,মাঝে মাঝে আমার দুচোখে ভাসে এক প্রশান্ত ছবি ।

গত সন্ধ্যায় এক ভদ্রমহিলা চেম্বারে আসলেন । মেজর ডিপ্রেসিভ ডিজিজ নিয়ে । ভদ্রমহিলার ডিপ্রেশনের কারন বের করতে চাইছিলাম । উনার বয়স আটত্রিশ । ভদ্রমহিলা যা বললেন তা পঁচে গলে যাওয়া সমাজের একটা স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি । ডাক্তার আমাদের সমাজ এখনও একা একটা মেয়েকে সুস্থভাবে বাঁচতে দেয় না । বাঁচতে যে সত্যি দেয়না তা আমি জানি । ভদ্রমহিলা বলেই যাচ্ছেন , হাজবেন্ড মারা যাওয়ার পর থেকেই ঘাড়ের কাছে বিন বিন করছে অজস্র হিতাকাঙ্খীর দল । আহা ,তোমার কি কষ্ট ! আহা , তোমার কথা ভেবে আমার রাতে ঘুম হয়না ! আহা ,চলো কোথাও বেড়িয়ে আসি রাত দুপুরে বাসার দরজায় টোকা পড়তে শুরু করল । সারারাত মেয়েকে জড়িয়ে কাঁটা হয়ে থাকতাম । শেষে বাসা পাল্টালাম । চলে এলাম  এই এলাকায় । শেয়াল কুকুরের উৎপাত হয়তো নেই তবে চিল শকুন উড়ছে প্রচুর । যখন তখন ডানা মেলে অফিসের বস নেমে আসছেন গায়ের কাছে ,ফিস ফিস করছেন । ষাট বছরের বুড়ো পাখিটা স্নেহ দেখানোর ছল করে টুকটাক ছুঁয়ে নিচ্ছে । তা উনি না হয় অনাত্মীয় আটত্রিশ বছরের আধাবেওয়ারিশ বিধবাকে নিয়ে এরা তো একটু ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাইবেই । কিন্তু নিজের আত্মীয়রা ! হঠাৎ হঠাৎ সন্ধ্যে বেলায় চলে আসছেন কেউ কেউ । বাসায় হাত -পা ছড়িয়ে বসে যাচ্ছেন । শতবার শোনা পারিবারিক ঘোঁট হাজার বার করে শুনিয়ে সময় পার করছেন । তারপর একসময় ঘড়ি দেখে বলছেন , এতোরাতে একা একা ফেরাটা কি উচিত হবে ? বরং আজ থেকেই যাই ! ভদ্রমহিলা কাঁদছেন ,আমি হতভম্বের মতো প্রেসক্রিপশন ফাইল নিয়ে বসে আছি ।কি লিখব ঔষধ ? প্রেসক্রিপশনের পাতাটা শূন্য পড়ে থাকে । হায়রে মানুষ !

আকাশে এখন অনেক তারা । চাঁদ ওঠেনি বলে তারারা যেন আরও বেশি চমক মারছে ।একটা সিগারেট ধরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি । অনেক রকম এতাল বেতাল চিন্তা ঘুরছে মাথায় ।বাসার পাশে একটা বড় সড় মেহগনি গাছ দাঁড়িয়ে আছে । ভীষণ ঘণ পাতা গাছটার । পাশেই পাঁচিল । নির্জনতাই নির্জনতা ওখানে । আমাদের গ্রামের বাড়ীর সামনে একটা বেশ বড় পুকুর আছে । ছোট বেলায় গ্রামের বাড়ীতে মন খারাপ হলে পুকুরের জলে নিজের মুখের ছায়া দেখতাম বসে বসে । কত দিন দেখা হয়না সে মুখ ! মাথাটা ধরে গেছে । একটু কফি খেলে মন্দ হতোনা । অহনা ঘুমিয়ে পড়েছে । রাতে বিছানায় শুয়ে বুকে অভিনব এক বোধ চারিয়ে যাচ্ছিল । কষ্ট নয় ,আনন্দ ও নয়,এ তার থেকেও গহীন অনুভূতি । যেন আমার শৈশব কৈশোর ফিরে আসছে আবার । যেন পুকুরের জলে পা ডুবিয়ে নিজের মুখের ছায়া দেখছি আমি । আমার ঘুম ভাঙার একটা নির্দিষ্ট সময় আছে । শয্যাত্যাগের পর নিদ্রার রেশ কাটাই মিনিট পাঁচ সাত । ইদানিং শরীরের মধ্যপ্রদেশে চর্বি জমতে শুরু করেছে , কিছুদিন ধরে ভোরে উঠে হাঁটার কথা ভাবছি । হয়ে উঠছেনা । গড়িমসি । আজ অহনা এখনো আসেনি । আধ ঘন্টার মধ্যেই পৌছাতে হবে চেম্বারে । বাইরে এক মনোরম সন্ধ্যে । দিনের তাপ মরে শিরশিরে বাতাস বইছে । কাঁপছে গাছের পাতারা ।বাসা থেকে চেম্বার একটু দুর তো আছেই , তার ওপর ট্রাফিক জ্যাম ।

দুপুরে অহনা চলে যাওয়ার পর নিজের ঘরে এসে শুয়েছি , চোখ বুজেছি ওমনি কত যে টুকরো টুকরো স্মৃতির ভিড় ! আসছে যাচ্ছে ,আসছে ,যাচ্ছে ।জীবন একটা রাসায়নিক বিক্রিয়া ।এক জায়গা থেকে শুরু হয় , একটা পয়েন্টে গিয়ে তার সমাপ্তি ঘটে । কত কত স্মৃতি । কলকাতার স্মৃতি , মুম্বাইয়ের স্মৃতি , কত স্থানের কত দেশের স্মৃতি । স্মৃতির জট  মস্তিষ্কের পরতে পরতে । দুপুরে লাঞ্চ সেরে অহনা যাবার পর ধুন্ধুমার জ্বর এলো ,চোখ বুজলেই জ্বলুনি হচ্ছে । অহনা যখন এলো তখন জ্বর ছিলনা । ব্যালকনির দরজা খোলা হু হু করে বাতাস শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে । উঠে বন্ধ করব সে শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই । হায় কপাল ! গা টা গুলোচ্ছে ,মাথাটাও বড্ড যন্ত্রণা হচ্ছে । জাপান থেকে ডা. শরীফ ফোন করলো । নানান কথা হলো । নিজের পিএইচডির টপিক নিয়ে অনেকক্ষণ কথা হলো । দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে কথা বললেন । জাপানের স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বললেন । দেশ নিয়ে ভাবনার কথা বললেন । দিনাজপুরের পার্বতীপুর্রের এক শিশুর কথা বললেন যাকে চার বছর বয়সে ধর্ষন করেছিল কিছু পাষন্ড । তার যৌনিপথ ব্লেড দিয়ে চিরে বড় করে রেপ করেছিল পাষন্ডরা ।এখন তার বয়স নয় বছর। শারীরিক প্রচুর সমস্যা নিয়ে বেঁচে আছে মেয়েটা । তার পাশে দাঁড়ানো নিয়ে কথা হলো । লাইন কেটে দেয়ার পর মনে হল উনাকে আমার একটা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা শেয়ার করা হয়নি । রাস্তাঘাটে ভবঘুরে পাগলের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে । অনাদর অবহেলায় বিনা চিকিৎসায় ঝরে পড়ছে হাজারও সম্ভাবনাময় জনশক্তি । এদের সঠিক চিকিৎসা ও পুর্ণবাসন নিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করতে চাই আমি । চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে এদের প্রশিক্ষিত করতে পারলে দেশ এগুবে । জানি না পারব কিনা তবে কাজটা আমি করতে চাই । মৃত্যুর আগে পাঁচজন মানুষকে সেবা দিয়ে চিকিৎসা দিয়ে দেশের জনশক্তিতে যোগ করে যেতে পারলেই আমি তৃপ্ত হতাম ।

উত্তরের জানালায় এক ফালি রোদ । কোত্থেকে যে এল আজ । দুপুর গড়ানো অব্দি তো একটা আবছায়া ভাব থাকে পশ্চিমমুখো এ ঘরটায় । আজ যেন আলো-আঁধারীটা নেই । চিলতে রৌদ্দুরই কি শুষে নিচ্ছে আবছায়া ?দেয়ালে ঝুলানো অহনার ছবি । আলো পড়ে রঙিন ছবি কেমন বিবর্ণ যেন ঝাপসা ঝাপসা ।হঠাৎ আব্বার মুখটা খুব মনে পড়ছে ।আব্বা মারা যাওয়ার আগে একদিন বিকালে কেন জানি বলেছিলেন ,একটা কথা বলি শোন , যতদিন বাঁচবি ততদিন সৎপথে টাকা রোজগার করবি । কালো পথে যা টাকা আসে তা অশান্তি বয়ে নিয়ে আসে । যতদিন বাঁচবি ততদিন অনেক মানুষের সংস্পর্শে আসবি । তাদের কারও কারও সঙ্গে তোর অনেকরকম সম্পর্ক তৈরী হবে ।কিন্তু নিঃশ্বার্থ হয়ে তোর সুখ চিন্তা করবে এমন মানুষ তাদের মধ্যে খুব কমই পাবি । আবার অনেকের জীবনে এমন মানুষ আসেই না । চোখ খুলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম । জানালার বাইরে তাকালাম ।সন্ধ্যে হয়ে গেছে চেম্বারে যাওয়া দরকার । এক অদ্ভুদ খারাপ লাগা থেকে কিছুতেই মুক্ত হতে পারছি না । এতো খারাপ কেন লাগছে ? জীবন কি ফুরিয়ে যাচ্ছে ? জীবন আর কত বড় ? কেবলই কি কিছু মাসের যোগফল ?

কিছু কিছু মানুষ হঠাৎ চমকে দেয়ার অপরিসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় । অহনা সে সমস্ত মানুষদের একজন ।কাল পহেলা ফাল্গুন । সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগেই অহনা অফিসে চলে গেল । সাড়ে ন’টায় ঘুম ভাঙলো । বিছানায় এপাশ ওপাশ করে নামতে যাব ওমনি দেখি একটা চিরকুট

– তুমি গ্রীষ্মের প্রখর রোদে হঠাৎ ভেসে আসা মৃদু বাতাস    ; তুমি বর্ষার মুষল ধারে বৃষ্টি পরার শব্দ

শরতের সাদা মেঘ , নীল আকাশের স্বচ্ছতা তুমি;

তুমি হেমন্তের মুগ্ধতা শিউলী ফুলের ঘ্রাণে ;

শীতের রোদে শিশির ভেজা ঘাস তুমি ; তুমি বসন্ত ।

চিরকুটের নীচে দু’জনের  জন্য ম্যাচিং করা শাড়ী আর পাঞ্জাবী । তক্ষুনি মনে হল বসন্ত এসে গেছে । শুভ পহেলা ফাল্গুন প্রিয় , শুভ পহেলা বসন্ত প্রিয় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

আরো সংবাদ পড়ুন

ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট

Theme Customized BY LatestNews