1. fauzursabit135@gmail.com : Fauzur Rahman Sabit : Fauzur Rahman Sabit
  2. sizulislam7@gmail.com : sizul islam : sizul islam
  3. mridha841@gmail.com : Sohel Khan : Sohel Khan
  4. multicare.net@gmail.com : অদেখা বিশ্ব :
শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:০৩ পূর্বাহ্ন

ডা. মোজাহিদুল হকের ধারাবাহিক গল্প ৪৩

সাহিত্য ডেস্ক
  • প্রকাশিত: বুধবার, ৮ জুন, ২০২২

জীবনের গল্প

-ডা. মোজাহিদুল হক

পর্ব-৪৩

কিছু কিছু দৃশ্য, কিছু কিছু ছবি বুকে গেঁথে যায় চিরদিনের মতো। দাঁতে দাঁত চেপে ভুলতে চাইলে ও আচমকা চোখের সামনে এসে অস্তিত্বের মূল পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়ে যায়।

কিছু কিছু দৃশ্য প্রতিটি মানুষের মনে জমা থাকে। মানুষ হাজার মোছার চেষ্টা করলেও বাস্তবে তা হওয়ার নয়। অবচেতন মনে ছবি রয়েই যায়। সামান্য সুক্ষ্ণ ইঙ্গিতে, অবচেতনের পর্দা সরে গিয়ে, ছবিটা জ্যান্ত হয়ে চোখের সামনে নড়াচড়া করতে থাকে।

কলকাতার মেজ মামার  মুখচ্ছবি টা ও আমার কাছে তাই ই। ঘুম ভাঙার  পর অনেকক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম। কাল রাত থেকে মেজ মামার মুখচ্ছবি টা বড্ড ধরা দিচ্ছে আমার মগজ জুড়ে।

হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে আজকাল নিজেকে বড্ড অচেনা লাগে। পুরো ঘরটা নিঝুম। এত নিঝুম যে নিজের নিশ্বাসের শব্দও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। আমার ঘরটা এমনিতেই অন্ধকার। পাশের বিল্ডিং এর চাপায় আলো প্রবেশ করার কোন উপায় নেই ঘরটায়।

আমাদের ফ্ল্যাটটা একটু ছোট বলেই অতো ঘুছিয়ে রাখতে পারিনা ঘরটা। বড্ড অগোছালো, বিশৃঙ্খল একটা ঘর।

আকাশ দেখে মনে হচ্ছে আজ সারাটা দিন  সূর্যদেবের উঠার কোন লক্ষন নেই। পেঁজা তুলোর মতো হালকা আবছা আকাশ জুড়ে। গভীর আলস্য নিয়ে আমি ছাদে উঠলাম। আজই প্রথম ছাদে উঠলাম বাসাটা নেয়ার পর। শীতল হাওয়া বইছে। চারপাশ একটু শীতেল। ছাদের কিনারায় ছাদ বাগানে অচেনা ফুল। সিরসিরে হাওয়ায় একটু কেঁপে উঠলাম আমি। তখনই পুরোপুরি চোখে ভেসে উঠল মেজ মামার মুখাবয়ব । আমার শীত করছে। শীতেল হাওয়া পাঁজরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। আমি এক নিঃশ্বাসে সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামতে থাকি। দরজায় দাঁড়িয়েছি যতক্ষণে ততক্ষণে আমার ঘন ঘন নিঃশ্বাস।

সকাল বেলার লন্ডভন্ড ঘরখানা ফাঁকা, শুনশান। চর্তুদিকের দেওয়াল জুড়ে বোবা যন্ত্রনার মতো শুধুই অজস্র কালশিটে। ভোরের পৃথিবী সম্পুর্ণ নিস্তব্দ। এ সময় পৃথিবীর সব কিছুই যেন বড় নিষ্পাপ, বড় পবিত্র।

আমরা প্রথম যখন কলকাতায় নানু বাড়ী যাই তখন মেজ মামার ব্যবসার খুব খারাপ অবস্থা । মেজ মামা ব্যবসা করেন । ব্যবসা হচ্ছে তারের ওপর হাঁটা । সবাই লক্ষ্য রাখে মানুষ কখন টলছে , পড়ো পড়ো অবস্থা , কখন পা সঠিক জায়গায় । লক্ষ্য রেখেছিল মামার প্রতিদ্বন্ধীরা ।মেজ মামা বুঝতে পারেন নি । মানুষের পতনের কোনও শব্দ হয়না , তবু আশে পাশের লোক কেমন করে যেন টের পায়। যে এই লোকটার দিন শেষ হয়ে এসেছে । মেজ মামার আসে পাশে থাকা সুখের মাছি গুলো একে একে কেটে পড়তে লাগলো । মেজ মামা ও হয়ে গেলেন নিঃসঙ্গ । একা । আব্বার চিকিৎসার জন্য আমরা তখন মুম্বাইয়ের নায়ার হাসপাতালে । একদিন রাতে বিনা নোটিশে মেজ মামা মুম্বাই এসে উপস্থিত হলেন । মামা কে দেখে মনে হলো কাকের পাখার মত অবসাদ তার শরীর জুড়ে ।মনে মনে মেজ মামার যেমন একটা ছবি সাজিয়ে রেখেছি মেজ মামার , অবিকল তেমন , মুখে অপ্রতিভ হাসি । আহা তারপর মামা ভাগ্নে মিলে পুরো মুম্বাই চষে বেড়িয়েছি । কত কালের পুরনো এক রক্তস্রোত আর এক রক্তস্রোতের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায় । আম্মার মুখে শোনা নানা বাড়ীর সব খবর মেজ মামাকে জিজ্ঞেস করি । নানাদের আকিলপুরের বাড়ীর পাশে মস্ত একটা দীঘি নাকি ছিল ।তার এপার ওপার দেখা যায় না , তার কালো জল খুব গভীর , বড় বড় মাছ ছিল , দীঘির পাড়ে একটা ডিঙি নৌকো বাঁধা থাকত । মামা কেবল হাসেন  বলে ,তুই অত জানলি কি করে ? আমি হাসি । তখন আমার বাবরি চুল ।মেজ মামা চুলে পিঠে মাথায় হাত বুলান । তুই গেলেই দেখতে পাবি রে ।

পঞাশ বছর পর আম্মা -আব্বা আর মেজ মামার সাথে হুগলির ধনিয়াখালির চকসুলতানের নানা বাড়ী যাচ্ছি গীতাঞ্জলি ট্রেনে চেপে । মুম্বাই থেকে বত্রিশ ঘন্টার যাত্রা । এক একটি ঘন্টা রাস্তা এগুচ্ছে আর আমার বুকের ভেতর হাতুড়ীর ঘা পড়ছে জোরে জোরে । পুরো রাস্তায় মেজ মামাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছি আর মামা তার জবাব দিয়ে যাচ্ছেন ।মেজ মামার প্রেমে পড়ে গেলাম । হাওড়ায় যখন নেমেছি তখন লোকে লোকারণ্য হাওড়া , পৃথিবীর ব্যস্ততম আর অন্যতম বড় স্টেশনে নেমে আমি দেখছি জনস্রোত । হাওড়া ব্রীজ রাতের আলোয় ঝলমল করছে । আমি চোখ বুজলে এখনো হাওড়া ব্রীজের ঝলমলে আলো দেখতে পাই । কানে ভাসে মেজ মামার যন্ত্রণাময় কত কথা ।সে কথা গুলোকে পাশ কাটাতেই কিনা আমি চট করে বাথরুমে ঢুকে পড়লাম। অন্ধকারেই। বালতির জলে হাত দিতেই মনে হল সেখানেও ঠান্ডা সেঁদিয়েছে। জল এত ঠান্ডা। ওই ঠান্ডা ঠান্ডা জলই চোখে মুখে ছিটিয়ে আমি বেরিয়ে আসি। মগজ জুড়ে তখনো মেজ মামার মুখচ্ছবি। রবিউলের মোটর বাইকে করে ফিরছি , বাতাসে সিগারেট ধরাতে পারছিনা ।কত দুর পর্যন্ত কী ভীষণ জোস্না !সব দেখা যাচ্ছে । জোস্নায় শহরটাকে কি যে মুগ্ধ দেখাচ্ছে ।বাতাসে বৃক্ষ নড়ছে ।চোখ বুজে আমি দেখি ধনেখালি বাজারের শেষ প্রান্তে মেজ মামার গদীঘর । পাশে সারি সারি সবুজ জমি । সে জমিতে বর্ষার সময় জল জমে , সে জলে চাঁদের আলোর ঝিকিমিকি ।

সাতচল্লিশের দেশভাগ আমাদের আর মামাদের মাঝে টেনে দিল এক বিভাজন রেখা ।ছোট বেলায় একবার ভারত বাংলাদেশের মেঘালয় বর্ডারে গিয়েছিলাম আব্বার সাথে ।আব্বা তখন সিলেটে চাকরী করতেন ।আব্বা নদীর ওপারে হাত দিয়ে ইশারা দিয়ে দেখিয়ে বলেছিলেন ওপারে তোর নানার দেশ ।আমার চোখ তখন নদীর ওপারে , সবুজ মাঠের ওপারে সাদা মেঘ ধোঁয়ার মতো দেখা যায় ।হুস হুস করে বাতাস বয়ে যাচ্ছিল আমার শিশু মন তখন বুঝতে পারছিলনা সে বাতাস কোন দেশের ।  আমি দেখছিলাম সাদা পাল তুলে মন্থর নৌকো যাচ্ছে কোন এক স্বপ্নের দেশে।আমি রোজ রাতে স্বপ্নে সেই মানুষ গুলোর কাছে ঘুরে আসি ।তার কয়েকমাস পরেই আমার মাসী আর মেসতুতো ভাই নজরুল ঘুরে আসে সে স্বপ্নের দেশ থেকে । সেবছর শীতের শেষে বসন্তের গোড়ার দিকে নজরুল ভাই আর মাসী বেড়াতে আসেন । আমরা তখন সুনামগঞ্জে। বিকালের দিকে বাইরের শানবাঁধানো পুকুর ঘাটলায় বসে হুগলীর নানু বাড়ীর গল্প শুনি ।মামা মামী রোজ সকালে সন্দেশ খেতে দেয়।বড় বড় সব রসগোল্লা ভেতরে এলাচ দানা দেয়া ।বলে ওখানকার সব মাঠ ঘাট নদী আকাশ সব এখানকার মতো ।সেখানেও আছে গাছপালা ,মায়াবী আলো -ছায়া , দিগন্ত জোড়া ক্ষেত ,আর এখানকার মতোই মানুষ । তবে সে মানুষ গুলোর আমাদের জন্য আছে বুক ভরা ভালোবাসা । আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি কর্ড লাইনের ট্রেন চেপে হাওড়া থেকে নানু বাড়ী যেতে নামতে হয় সিপাহীচন্ডী স্টেশন । সে স্টেশনের বাইরে টং দোকানে লেড়ো বিস্কুট পাওয়া যায় , চায়ে ডুবিয়ে সে লেড়ো বিস্কুট নাকি অমৃত ।

রাতে সরকারী বাংলোর ছাদে বসে মাসীর মুখে নানু বাড়ীর গল্প শুনতাম ।মাসী বলতেন মামাদের কাজকর্মে উদ্যোগী করার জন্য বড় মামা , মেজ মামা আর টাবলু মামাকে নাকি অল্প বয়সে বিয়ে করিয়েছেন । অবিবাহিত বাবলু মামা নাকি ধবধবে সাদা জামা প্যান্ট সাথে ম্যাচিং জুতো পড়ে বোম্বের নায়কদের মতো ঘুরে বেড়াতো ।মাসীরা চলে যাবার পর আমি মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে মামাদের মুখচ্ছবি ভেসে উঠত আর একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চের মত আমার বুক খামচে ধরত ।তখন আমার চারদিকে এক অলৌকিক অনুভব করতাম ।মামাদের গায়ের ঘ্রাণ পেতাম । সে ঘ্রাণেও কেবল মা মা গন্ধ থাকত ।কাউকে কিছু বলতে পারতাম না । কেন না সেইসব অনুভূতি ছিল আমার সম্পূর্ণ একার । কাউকেই বলে তা বোঝাতে পারতাম না ।আশে পাশের সবাই নানা বাড়ী যেত , যেতাম না কেবল আমরা । মা বলতেন সেখানে যেতে পাসপোর্ট ভিসা লাগে । অভিমান করে বলতাম আব্বা রোজ এতকিছু নিয়ে আসে পাসপোর্ট ভিসা আনতে পারেনা । আমার শিশু মন বুঝতেই চাইত না আমার মামাদের কাছে যেতে কেন ওসব লাগবে ! কই আর লোকের তো লাগেনা । বড় হয়ে বুঝেছি দেশ ভাগ আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে নানা বাড়ী ,ছিনিয়ে নিয়েছে মামাদের আর আমার মাসীদের ।

দেশ ভাগ শব্দটাতেই এক ধরনের বিতৃষ্ণা আছে আমার।এলোমেলো পায়ে আমি এসে বসি আমার বসার ঘরের সোফায় ।মামাদের কথা ভাবতেই পুরনো অভিমানটা সারা বুক ছেয়ে গেল আমার। সেই পুরনো পাথর চাপা অভিমান। জমাট। শীতল। ঘরের ভেতর কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে আজ আমার। একটু খোলা হাওয়ার জন্য মনটা হাঁসফাঁস করে। নির্জন ভোরে আমি পায়ে পায়ে গায়ে চাদর জড়িয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে বাইরে বেরিয়ে আসি। গাঢ় মেঘের মতো কুয়াশা চারদিক। ছাদে গিয়ে অতটা মনে হয়নি। কুয়াশা জড়িয়ে ঘুমিয়ে রাস্তাঘাট। একটু দুরের সব কিছুই কেমন অস্পষ্ট। অত ভোরে ঢাকা শহরের ফাঁকা রাস্তায় কোন মানুষ বের হয় এটা আমার অজানা। সূর্যের কোন চিহ্ন নেই কোথথাও।মাথার ওপরের ধূসর আকাশটার ছায়া।

প্রিয় সম্পদ হারিয়ে ফেলার পর তার অভাব কয়েক গুন হয়ে বাজতে থাকে বুকে। মাঝে মাঝে মামাদের ,মাসীদের অভাব বোধটা প্রচন্ড নাড়া দেয় আমাকে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

আরো সংবাদ পড়ুন

ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট

Theme Customized BY LatestNews