পর্ব-৪৪
বিছানায় উঠে বসে দু-হাতে চোখ ঘসলাম ভালো করে। জোরে জোরে শ্বাস টানলাম। রোজকার মতোই রাতভর বিছানায় এপাশ- ওপাশ করে কখন যেন ভোরের মুখে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ঘুম ভাব। অনিদ্রার ক্লান্তি এখনো ছড়িয়ে আছে চোখের পাতায়। শরীর নতুন করে বিছানায় গড়িয়ে পড়তে চাইছে। পূবের জানালা দিয়ে ওই যে শৈশবের মতো নিষ্পাপ নতুন সকালটা এক মুঠো নরম আলো ছড়িয়ে হামা টানছে ঘরের মেঝেতে। ওই আলো প্রবীন হওয়ার আগেই রেডি হওয়া দরকার। বলা যায়না ভোরের ইচ্ছে বেলা বাড়লে হয়তো ফুরিয়ে যেতে পারে। ধীর পায়ে মুখ-চোখ ধুয়ে এলাম বাথরুম থেকে। কি অদ্ভুদ নিরবতা ঘরটা জুড়ে। ভুতুড়ে রকমের থমথমে। একটু চা খেলে মন্দ হতো না।
সিগারেট টা ছাড়ব ছাড়ব করে ও ছাড়া হচ্ছে না তবে কমিয়ে দিয়েছি। আজকাল অকারনে মনটা হু হু করে। মনটা অকারনে ভারী হয়। কে’ই বা কবে আমার জন্য কিছু করেছে? যারা আমার জীবনটা এলোমেলো করলো তারা হয়তো ভালো আছে তাদের ছেলে, তাদের মেয়ে, তাদের নিজস্ব সুখ দুখ নিয়ে হয়তো ভালোই আছে।
আমার এ নিয়ে কারো উপর কোন অভিমান আর অভিযোগ নেই। উলটো একটা জেদ ছিল। তাদের থেকেও ভালো থাকবো। আমার জীবনটা এমনই। সবার জন্য প্রানপনে খেটে যাওয়া। আমার শরীর, শরীর নয়। মনটাও মন নয়। এ নিয়ে আমার আপসোস নেই। তবুও কেন যে ইদানিং বুকের ভেতর একটা গোপন কান্না দানা বাঁধতে চায়। বড় অর্থহীন মনে হয় সবকিছু। কার জন্য? কীসের জন্য খেটে মরলাম এতগুলো বছর?
বৃথাই মানুষ ভাবতে ভালোবাসে তাকে ঘিরেই পৃথিবী চলছে। তার জন্যই সূর্য উঠছে। চাঁদ ডুবছে। তার জন্যই বেঁচে আছে প্রিয় পরিজন। ভুল ভুল। এ এক ভয়ানক নিষ্ঠুর ভ্রান্তি!
কারো জীবনে আমার জায়গা কি ছিল? জায়গা কি আদৌ ছিল? সংসারে? বাইরে? নিজের টুকিটাকির দিকে তাকালে বুকটা হু হু করে। সব গেল। এখন আর কেউ তেমন মনে করেনা। এরকমই তবে হয়। এভাবেই সময়ের সাথে সাথে বিস্মৃত হয় সব কিছু। নিজেদের বিশেষ বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া আজকাল আমাকে কারো মনে পড়েনা। এই যে যাদের সাথে এতো কালের বসবাস, সুখ দুঃখ হাসি কান্না ভাগ করে নিয়েছিলাম নিজের মতো করে। যাদের ছাড়া আর কাউকেও কখনো ভাবতে চাইনি। তারাই তো সবার আগে নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে কেটে পড়লো। মাঝে মাঝে বুক জুড়ে হাল্কা কুয়াশার মতো ভেসে বেড়ায় শূন্যতা। সব কিছু কেমন নিবে গেল এক ফুঁয়ে।গত কিছুদিন আগেও আমি এক অন্য আবেগে আচ্ছন্ন ছিলাম। সে আচ্ছন্নতায় শূন্যতাবোধ ছিল। শূন্যতাবোধ? নাকি হাহাকার? হারিয়ে যাওয়ার। ফুরিয়ে যাওয়ার। বাতিল হয়ে যাওয়ার। আজকাল কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না। এই যা বলি দু একটা। না বলা কথারা কি দুমড়ে মুচড়ে ওই দুই একটা কথা হয়ে যায়? না কি যে কথা না বলা থেকে যায়, সে কথা নিজে নিজেই মরে যায় একদিন?
কী জানি???
বৃষ্টির কোন লক্ষন নেই এই শহরে । কড়া রোদ্দুরেও বাতাস রীতিমতো আদ্র । হাওয়ার ঝাপটাতেও একটা ঘামে থসথস ভাব যাচ্ছে না কিছুতেই । দায়সারা গোছের লক ডাউন চলছে করোনার জন্য । বাসা পাল্টেছি দিন পনের হলো । নতুন বাসার নাম কপোতাক্ষ । কপোতাক্ষ তো নদীর নাম , বাড়ীর নাম কপোতাক্ষ কেন ? হয়তো বাড়ী মালিকের কপোতাক্ষ নদীটা পছন্দের তাই । হবে হয়তো । ছয়তলায় আমাদের ফ্ল্যাট ,সারাক্ষন আলো-বাতাসের হুড়োহুড়ি । সকালের রোড বিছানায় গড়াগড়ি খায় । মাঝে মাঝে দুএক দিন বৃষ্টি পড়েছিল ঝির ঝির । এখন মনে হচ্ছে বরুনদেব বিশ্রামে গেছেন । বেডরুমের বিছানায় শুয়েই আকাশ দেখা যায় । যেন হাত বাড়ালেই ছোয়া যাবে প্যাঁজা তুলোর মত মেঘ । এ বাসার আশে পাশে গাছগাছালি নেই । পাশের কম্পাউন্ডের ভেতর দুটো বেশ বড়সড় আমগাছ তাতেই দু চারটা পাখির কিচিরমিচির শোনা যায় । অহনার একটা কথা বলা ময়না পোষার খুব শখ । কোথায় যেন একটা বউ কথা কও পাখি ডেকে উঠলো । ওমা ঢাকা শহরে বউ কথা কও ? আশে পাশের কোন বাড়ীতে পুষল নাকি ? পুষতেও পারে , কত রকমের খেয়াল যে থাকে মানুষের ! কী যে ছাই হচ্ছে, আবহাওয়ার কোন ছিরিছাঁদ নেই।এত যে গরম গা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। গোটা পৃথিবীরই নাকি উঞ্চতা বাড়ছে। এবার তো কংক্রিটের জঙ্গলে টেরই পাইনি বসন্ত কে। তেলে ধূলোয় মলিন গাছে দু,চারটে ফুল ফুটেছিল বটে, ব্যস ওই পর্যন্তই। আমাদের পুরনো ফ্লাটের পেছন দিকটার ব্যালকনিতে দাঁড়ালে খুব প্রশান্তি লাগত ।কংক্রিটের জঙ্গলে এক টুকরো সবুজের ছোঁয়া ছিল ।কয়েকটা নাম না জানা পাখিও ডেকে যেত মাঝে সাঝে। দখিনা বাতাস যদিও বা আসত এদিকে ঠেকে ঠেকে ইট লোহায় ঠোক্কর খেতে খেতে।
সূর্য ডুবছে। শেষ বিকালের আকাশ এখন প্রায় বর্ণহীন। যে রকম বাসা হারিয়েছি ঠিক সে রকম বাসা ফিরে পেলাম আবার তবে তিন বছর পর । আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি অহনার দিকে। তির তির সুখ কাঁপছে অহনার দু-চোখ। ওই কাঁপন ছড়িয়ে পড়ছে আমার বুকে। শিরায়। উপশিরায়। প্রাণপনে শুধু নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছি, কিছুতেই যেন কেঁদে না ফেলি। তিন বছর আগের সেই কান্নাটা কি এখনও রয়েছে বুকের ভেতর? গলার কাছে তবে এত বাষ্প জমেছে কেন? ঢোঁক গিলতে কষ্ট হচ্ছে। নতুন বাসা গুছানো শেষ করলাম নিজেদের মতো করে । আমার আর অহনার পছন্দের মিশেলে । পছন্দের ফুল দিয়ে দুটো ব্যালকনির একটা সাজানো হলো । সব গোছানো শেষ করার পর অহনা এক দুষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার মুখপানে।
একটু এগিয়ে এসো তো? আমি তাকিয়ে দেখি ওই স্থির তাকিয়ে থাকা মুখ যেন একদম অপরিচিত ।
-কী হলো এসো!
মনে হল কোন নারী কন্ঠ নয়। সাপুড়ের বাঁশি ডাকছে যেন সাপিনীকে। পায়ের তলায় ছড়িয়ে যাচ্ছে স্পন্দন। সব ওলটপালট হয়ে গেল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে চলেছি। চর্তুদিক আবছা হয়ে এল। বিশ্বসংসার, আমার কষ্ট বেদনা আর একাকীত্ব সব ভেসে গেল। অহনা টুপ করে জড়িয়ে ধরলো আমায়। শরীরের সমস্ত রোমকুপ যেন খুলে গেল। লক্ষ কোটি সরোদ বেজে উঠল শিরা -উপশিরায়।
নিষ্পলক দৃষ্টি আমারই চোখে স্থির। চেতনা ক্রমে অবশ হয়ে আসছে। সম্বিত ফিরতে মনে হল পৃথিবীর বয়স বেড়ে গেল কয়েক হাজার বছর। অথবা কয়েক মুহুর্ত মাত্র। আমিও দুহাত বাড়িয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিলাম অহনাকে। প্রবল ভূমিকম্পের পর মাটি শান্ত হচ্ছে যেন। রাত এখন বড় মায়াময়। চাঁদের বুড়ি রুপোলী সুতো কেটে চলেছে চরকায়। সেই সুতোয় বোনা মসলিন এখন ভাসছে চরাচরে। রুপোলী সর মেখে ছুটছে অলৌকিক গাছপালা, ছুটছে মাঠ, ছুটছে নদী, ছুটছে বালির চর। জোস্না মেখে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর অহনা। আলতো বাতাস বইছে। সে বাতাসে ভেসে রইল অহনার গলা, ভালোবাসি ভালোবাসি এই সুরে …..
জৈষ্ঠের আকাশে মেঘ ,ভালই মেঘ ,কিন্তু বৃষ্টির নামগন্ধ নেই।সবে সোওয়াসএগারোটা বাজে এরই মধ্যে মেঘের আড়াল থেকে বিশ্রী তাপ ছড়াচ্ছে সূর্য ।চিটচিটে গরমে জ্বালা করছে গা । লক ডাউনের মধ্যেও অহনার অফিস চলছে দশটা – চারটা ।বৃষ্টি ঝরছে ঝির ঝির । একটানা নয় অবশ্য , থামছে মাঝে মাঝে । গরম কিন্তু মোটেই কমেনি , উলটে বাতাসের প্যাচপেচে ভাব যেন বাড়ছে । ছাড়া ছাড়া বৃষ্টিটাকে দেখছি । ঘ্রাণ নিচ্ছি ভিজে ভিজে হাওয়ার । ব্যালকনি থেকে । বারান্দায় বসার জন্য দুটো বেতের চেয়ার কিনব ভাবছি ।সে চেয়ারে বসে চাঁদনী রাতে গরম কফি মগ হাতে অহনাকে পাশে বসিয়ে , জীবনকে বলব আর কিছু চাইনে আমার । নতুন বাসায় আসার পর থেকে অহনার ভেতর একটা গিন্নী গিন্নী ভাব এসেছে । আগে সারাক্ষনই ওকে প্রেমিকা প্রেমিকা মনে হতো ।ইদানিং অল্প বিস্তর শাসনও করছে অহনা ।বিয়ে ব্যাপারটা সত্যিই মেয়েদের অনেক বদলে দেয় । এদেশে বাড়ীর মেয়ে-বউরা, বিশেষত বউ, যে চাকরীই করুক, যত উঁচু পদেই করুক, যত উঁচু পদেই থাকুক, তার কাজটাকে কি যথোচিত মর্যাদা দেয়া হয় আজও?? এটা কি সংস্কার? নাকি এক ধরনের হীনমন্যতা? নাকি দুটোই? আদ্যিকালের ধ্যান ধারনা গুলো এখনও ঘুচল না। এদেশের মানুষের মনের কোন গভীরে যে গেড়ে আছে শিকড় টা ? আর কত বছর যে লাগবে পুরোপুরি উপড়াতে ? এদের ধারনার শিকড় যেমন উপড়াতে হবে তেমনি শেষ পর্যন্ত মেয়েরা যদি লড়াই করে কোথাও একটা পৌছাতে পারে, তখন সবাই তাকে কুর্নিশ করবে। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত বাধা দেবে প্রাণপন। মনে আছে, বোধি লাভের আগে বুদ্ধকে কেমন ঘিরে রেখেছিল মারেরা? আমাদের দেশের মেয়েদের ওই মারের উপদ্রব সইতে হয় খুব। যারা নারীর পোশাক আশাক বা চলাফেরা নিয়ে টিপ্পনি কেটে নিজেরা পার পেতে চায় তারা কি দেখেনা দেড় দু’বছরের শিশুটাও তো নিগৃহীত হচ্ছে তাহলে তার কি অপরাধ? আসলে আমাদের মনে ভিড় করে আছে মানুষত্বহীনতার নোংরা কীটপতঙ্গ, সারাক্ষণ কিলবিল করছে। ওই নোংরা কীটপতঙ্গ গুলোকে পিষে মেরে ফেলতে দরকার সমাজ সংস্কার।
সেদিন একজন নিজের সংসার নিয়ে টিপ্পনী কাটলো আমি শুনে হাসি, আসলে সংসারের মুল রসায়ন হলো বোঝাপড়া। আর সেটা হয় সমানে সমানে। সেখানে দুপক্ষকেই কিছুটা করে ছাড়তে হয়। তা না হলে সম্পর্কটাই তো এবড়োখেবড়ো। ডমিনিটিং মানসিকতার পুরুষ মানুষ গুলো যেমন এক চুল ছাড় দিতে রাজী নয় তেমনি আত্মদহন নিয়ে ধরাবাঁধা গার্হস্থ্য জীবন করে যাচ্ছে নারী। এক ছাদের নীচে, এক বিছানায় শুয়ে ও তাদের নীরব যুদ্ধ চলছে আজীবন। সংসারের সকল কর্তব্যই হয়তো করে যাচ্ছে কিন্তু স্বামী নামের পুরুষ কে কখনো মনে প্রানে ভালোই বাসতে পারে নি। এভাবেও তো জীবন চলে, নয় কি? এসংসার গুলো এক একটা ডিনামাইট কখন যে বিস্ফোরিত হবে কেউ জানে না। বিস্ফোরিত হলে লোক জানতে পারে নয়তো চাপা পড়ে থাকে দহন গুলো। নয়তো অন্তরের কোন অন্তঃস্থলে তুষের আগুন গুলো সংগোপনে চাপা দিয়ে চোয়ালে চোয়াল কষে খুঁজে প্রতিশোধের রাস্তা। তাইতো অসংগতি। পুরুষ কে কতৃত্বপরায়ন না হয়ে কেয়ারিং হতে হবে, তবেই নারী পুরুষের সম্পর্ক টা হবে সুখ সাগরে ভাসার মতো। সংসার ভারী আজব জায়গা। এ চেরাপুঞ্জি নয়, যে স্যাঁতস্যাতে হয়ে থাকবে সর্বক্ষন। আবার গোবি সাহারাও নয়, যে এখানে মেঘের আর্বিভাব একান্তই অপ্রত্যাশিত। এ মরুপ্রদেশ ও নয় নিরক্ষীয় অঞ্চল ও নয়। অন্তত শৈত্য বা ধরাবাঁধা বৃষ্টির আবর্তে আটকে থাকেনা চিরকাল। এখানে ছয় ঋতুই বাস করে একত্রে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, বসন্ত কে যে কখন দখল নেবে সংসারের আগাম ঠাহর করা দায়। অবশ্য কোন ঋতুই সংসারে পাকাপাকি গেঁড়ে বসতে পারে না। তবে প্রত্যেকেরই ছাপ রয়ে যায় সংসারে। কোথাও না কোথাও।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট