সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও অন্য নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বললেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব দলের সমর্থন ও অংশগ্রহণ প্রয়োজন। নির্বাচনে সব দল না এলে গ্রহণযোগ্য হবে না। বিশেষজ্ঞরা নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে জেলা প্রশাসকদের নিয়োগ না দিয়ে নির্বাচন কর্মকর্তাদের এ দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব রেখেছেন। সর্বশেষ সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা নির্বাচনে সেনা মোতায়েন না করার পরামর্শ দেন। অপর এক সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারের প্রস্তাব ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ ব্যবস্থার নির্বাচন। আর নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে প্রায় সবারই মত।
গতকাল রবিবার নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) আয়োজিত সংলাপে অংশ নিয়ে এসব মত দেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা, ঐকমত্য না থাকলে আমাদের পক্ষে নির্বাচন করা কষ্টকর হবে। নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব নয়। তিনি জানান, কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শিগগিরই সংলাপ শুরু করবে। এ ছাড়া সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে জবাবে তিনি কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের নির্বাচনী বিধি পরিপন্থী আচরণের বিষয়ে নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন।
সংলাপে সাবেক ২৮ জন সিইসি, ইসি ও ইসিসচিব, অতিরিক্ত সচিবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাঁদের মধ্যে মাত্র ১০ জন অংশ নেন।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের সিইসি এ টি এম শামসুল হুদা সংলাপে বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এনআইডির কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সেটা নিয়ে কেউ কথা বলে না। নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন। সামনে নির্বাচনে কী করব—ফান্ডামেন্টাল কিছু করতে যাইয়েন না। আইন-টাইন পরিবর্তন ইত্যাদি করে কিছুই করতে পারব না। আইনকানুন যা আছে, তা দিয়ে সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন করা সম্ভব। সেই দিয়েই আমরা তো সুষ্ঠু নির্বাচন করেছি। ’
শামসুল হুদা ডিসিদের পরিবর্তে ইসির কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের পরামর্শ দেন। এ ছাড়া বলেন, ‘এবার নির্বাচনে সব দল না এলে গ্রহণযোগ্য হবে না। তাদের কিভাবে আনবেন, কী অফার দেবেন সেটার ওপর বিষয়টি নির্ভর করবে। আমার সময়ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে ‘বিএনপি ওয়াজ প্রবলেমেটিক’ (সমস্যা ছিল)। আমার সময় অনেক সময় লেগেছে বিএনপির আত্মবিশ্বাস আনতে। এখন তারা যেসব কথাবার্তা বলছে, তাতে তো মনে হয়, তারা নির্বাচনে যেতে রাজি না। যে দেশে গণতন্ত্র আছে ও নির্বাচন আছে, সে দেশে রাজনৈতিক দল বেশি দিন নির্বাচনের বাইরে থাকতে পারে না। আমরা যদি পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারি তাহলে সব দল অবশ্যই নির্বাচনে আসবে। ’
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন বাহাত্তর সাল থেকে ধীরে ধীরে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সুসংহত করার চেষ্টা করছে। আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতি অন্য দেশের সঙ্গে মেলালে হবে না। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সময় শত শত লোক নিহত হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নষ্ট করা হয়েছে, পরিস্থিতি ব্যাপক সহিংস হয়েছে। সেই অবস্থার মধ্যেও কষ্ট করে নির্বাচন করতে হয়েছে। শামসুল হুদা সাহেবের সময় একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট ছিল। তখন রাজনৈতিক সরকার ছিল না। সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল। এখন যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে ছয় মাস সময় লেগে যায়। আমাদের সময় দুই বছর করোনার কারণে কাজই করতে পারিনি। অনেকগুলো সংস্কারের বিষয় ছিল হাত দিতে পারিনি। ’
নুরুল হুদা বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী বাংলাদেশের নির্বাচনে যেভাবে মোতায়েন করা হয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে তা বিরল। এখানে বন্দুক দিয়ে যুদ্ধের মতো অবস্থা হয়। এগুলোর আসলে প্রয়োজন নেই। সেনাবাহিনীর একেবারেই প্রয়োজন নেই। নির্বাচন পরিচালনায় তারা কাজে আসবে বলে মনে হয় না। সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত একটি বাহিনীকে নির্বাচনে দায়িত্ব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি আরো বলেন, নির্বাচনে ৭৫ শতাংশ অর্থ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পেছনে ব্যয় হয়। এখন আর্মি, এয়ার ফোর্স, র্যাব, বিজিবি নামে। একটা কেন্দ্রে যে পরিমাণ সশস্ত্র ফোর্স থাকে, তা একটা থানার সমান। সাবেক এই সিইসি ইভিএমে ভোট এবং রিটার্নিং অফিসার পদে নির্বাচন কর্মকর্তাদের নিয়োগের পক্ষে মত দেন।
সাবেক সিইসি বিচারপতি আব্দুর রউফ বলেন, ‘যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে প্রার্থীদের সোজা হিসাব—জাতীয় নির্বাচন এলেই ২০ কোটি টাকা খরচ করব, আর ভোটের পর ২০০ কোটি আয় করব। ’ তিনি সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা নির্বাচন প্রার্থীভিত্তিক না হয়ে দলভিত্তিক হওয়ার প্রয়োজন বলে জানান।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের একটাই চ্যালেঞ্জ, তা হলো সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করা। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হাফিজ বলেন, ‘সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে সবাই মনে করবে, নির্বাচন ভালো হয়েছে। যারা সরকারি দল, তারা চিন্তা করবে দলগুলোকে কিভাবে নির্বাচনে আনা যায়। ’
নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ‘যেকোনো মূল্যে সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। নির্বাচন কমিশন এটা করতে সক্ষম হলে ৮০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হবে। ’
কাজী হাবিবুল আউয়াল যা বললেন : সংলাপ শেষে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের জানান, ‘অতিথিরা বলেছেন, বর্তমানে যে সিস্টেম আছে, এখানে খুব বেশি ভালো করা সম্ভব নয়। এটা একটু কম বেশি কিছু হতে পারে। আমরা যদি দৃঢ় থাকি, আইন দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করি, তাহলে অনেকটা উন্নয়ন সম্ভব। প্রার্থী অনুযায়ী নয়, দলভিত্তিক নির্বাচনের কথাও উঠেছে। এ ধরনের একটা সিস্টেম অনেক দেশে আছে। তবে এটা আমাদের বিষয় নয়। এটি দলগুলোকেই দেখতে হবে।
সিইসি বলেন, ‘আমরা যে শপথ গ্রহণ করেছি, বর্তমান যে আইনি কাঠামো আছে, সাংবিধানিক কাঠামো আছে, এর মধ্যেই আমাদের নির্বাচন করতে হবে। কেউ কেউ বলেছেন একাধিক দিনে নির্বাচন করলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী মোতায়েন সহজ হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। কেউ কেউ বলেছেন এতে সমস্যাও হবে। এ নিয়ে কোনো ঐকমত্য হয়নি। কাজেই একাধিক দিন নির্বাচন করলে আমাদের জন্য অসুবিধাও হতে পারে। ওই ধরনের প্রস্তুতি আমাদের নেই। আমরা এখনো দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করিনি। সবাই বলেছেন নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। নির্বাচন যদি ইনক্লুসিভ না হয়, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাস্তব অর্থে থাকবে না।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। এই কালচারের মধ্যে কিছু ইতিবাচক গুণ আনতে হবে। দলগুলোর মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতা, ঐকমত্য যদি না থাকে, নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে খুব ভালো নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা, ঐকমত্য না থাকলে আমাদের পক্ষে নির্বাচন করা কষ্টকর হবে। এটা আমরা যেমন আগে বলেছি, উনারাও বলেছেন। ’
তিনি বলেন, ‘শিগগিরই দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করব। আমরা সাজেশন চাইব। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভালো আরো পদ্ধতিগত কী পরিবর্তন করা যেতে পারে সুন্দর সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তা চাইব। ’
কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনকে ভোটের এলাকা ছাড়ার চিঠি দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এ বিষয়ে সিইসি বলেন, ‘আমাদের কিছু আইনগত দিক আছে। কিছু ক্ষমতা আংশিক, কিছু পরিপূর্ণ। নির্বাচন আচরণবিধিতে বলা হয়েছে, সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারবেন না। মাননীয় সংসদ সদস্য এই আচরণবিধি ভঙ্গ করছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে, আমরা এলাকা ছাড়তে বলেছি। উনি এলাকা ছাড়েননি। উনি মামলা করেছেন, আমরা মামলার ফলাফল পাইনি। তিনি বলেন, একজন মাননীয় সংসদ সদস্যকে অনুরোধ জানানোটাই এনাফ। উনাকে যদি আমরা বলে থাকি কাইন্ডলি নির্বাচন আচরণবিধিতে এটা আছে, আপনি যদি একটু সরে থাকেন, তাহলে নির্বাচন ভালো হয়। সেই চিঠিটা আমরা প্রকাশ্যে দিয়েছি। যদি সেটাকে উনি অনার না করে থাকেন, আমাদের তেমন করার কিছু থাকে না। ’
সংলাপে অন্যান্যের মধ্যে সাবেক নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজ, সাবেক ইসিসচিব সাদিক ও অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী, মোখলেছুর রহমানসহ বর্তমান নির্বাচন কমিশনার ও ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট