পর্ব-৪৮
অহনা বেরিয়ে গেলে ফ্ল্যাটখানা পলকে নিঝুম । ঘড়ির কাটা যেন চলতেই চায় না । আমি দিব্যি শুনশান ফ্ল্যাট খানায় ঘুরে বেড়াই এ ঘর ও ঘর কিংবা গড়াই বিছানায় , অথবা খানিকক্ষন বই- ম্যাগাজিন উলটাই , তাতেও মন না বসলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি ব্যালকনিতে । এক আধটা পদ রান্নাও করি মাঝে মাঝে । অহনা খুশী হয় কিনা বোঝা যায় না , তবে অখুশীও হয় না বোধ হয় । ব্যালকনিতে এলেই মন আমাকে যেন নিয়ে চলে যায় অনেক অনেক দুরে । দুরমনা আমি ভাসতে থাকি স্মৃতির বাতাসে । সুখ-দুঃখ , হাসি-কান্না , রাগ-অভিমান মেশানো কত যে ছবি সেখানে । ঘোড়ার ডিম মার্কা লক ডাউন চলছে । সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধের কথা বলছে অথচ করোনার হট স্পট রাজশাহীতে সিটি মেয়র শেখ কামালের জন্মবার্ষিকীতে হল ভর্তি মানুষ নিয়ে প্রোগ্রাম করছে । মুখ দিয়ে খিস্তি বের করতে গিয়েও করি না । নায়িকা মডেলদের বাড়ীতে বোতলকে বোতল বিদেশী মদ পাওয়া যাচ্ছে , কী যে ছাই উন্নতি হচ্ছে দেশের ! আসল কাহিনী লোক ঠিকই জানে । ক’দিন ধরে নাটক চলছে । দুপুরে লাঞ্চের আগেই আকাশ ঝুলকালো । তারপর ঝমঝমিয়ে জোর একপশলা বৃষ্টি । ব্যালকনিতে গেলেই মনটা বেজায় খারাপ হচ্ছে , ঈদে বাড়ী থেকে ফিরে দেখছি ব্যালকনিতে লাগানো অতবড় মাধবী লতার ঝাড় মরে শুকিয়ে আছে , শুকিয়ে আছে গোলাপ , রজনীগন্ধা আর অপরাজিতা ও । অহনার তো কান্নার জোগাড় । ব্যালকনিতে গেলেই খিঁচড়ে যায় মন । দশ বারোদিন জল না পেলে টবের গাছ এভাবে শুকিয়ে মরে যায় , জানাই ছিল না । দু তিন দিন তো জোর বৃষ্টি হলো তাও এমন কেন হলো ? অহনা গত দু’তিন দিন সকাল বিকাল পানি দিয়ে গাছ গুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে । কিন্তু সফলতার কোন লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না । অহনাদের বাড়ীর ঝোঁপে ঝাঁড়ে ঘুরে বেশ কিছু জংলী সুদর্শন ফুলের বীজ নিয়ে এসেছি । টব আর মাটি এনে সেসব লাগাতে হবে । ব্যালকনিতে স্থির দাঁড়িয়ে আছি । ছায়া ছায়া অন্ধকার কেটে একটু একটু করে আলো ফুটছে । সামনের আকাশ এতক্ষণ বর্ণহীন ছিল , এখন হালকা গোলাপি । এরপর লালের আভা লাগবে । নীচে রুদ্রপলাশের রং গাঢ় হচ্ছে ক্রমশ । গতিময় শহরটা জাগছে , জেগে উঠছে ।
জীবন বহতা নদী । কখনও মজা স্রোত , কখনও ঢেউ থইথই । লাইফ ইজ লাইফ । আ রানিং হুইল । কুষ্টিয়া ছেড়ে ঢাকা এসেছি চার দিন হলো কিন্তু কুষ্টিয়ার স্মৃতি ঘুরছে মগজ জুড়ে । রাতে খাওয়া দাওয়ার পর রোজ আড্ডা চলত আমাদের । তমালের ঘরে । এবার লোডশেডিং খুব জ্বালিয়েছে আমাদের। খুব ঘনঘন কারেন্ট যেত ওখানে । লোডশেডিং এ গোটা গ্রামটাই অন্ধকারে ডুবে যেত । যেন ভুত নগর । অহনাদের ওখানে থাকতে দুপুরটা নিস্তরঙ্গ লাগত । খেয়ে শুয়ে , গড়িয়ে গড়িয়ে । সন্ধ্যার পর হয় মেজ মা’দের ঘর নয়তো পিয়াস আর ইভার বাসায় নিত্যহানা । ইভার বাসা থেকে আসার পথে দেখতাম চাঁদ উঠলে পাতলা জ্যোৎস্না কেমন ছড়িয়ে যায় দশদিকে । পৃথিবী তখন সত্যিই মায়াময় । মিহি আলো মেখে রাস্তার ধারের পান বরজ গুলোকে অলৌকিক মনে হত । দিনের চেনা পান বরজ যেন এক অচিনপুরী । ঘরে যেতেই ইচ্ছে করত না । মাথার ওপর তারায় ছাওয়া আকাশ , এক কোণে ঝুলছে নৌকোর মতো চাঁদ , নিঝুম নিরালা রাতে হাওয়া বইছে শনশন … আহ্ বেঁচে থাকাটা কী সুখের । একরাতে তো আমি অহনা , তমাল আঁখি বারোটার দিকে ছুটলাম তারাবুনিয়ার দিকে । জ্যোৎস্না মাখা আকাশে তারার ফুল । পাঁই পাঁই ছুটে যাচ্ছি , রাতের বুক চিরে একটা পাখি যেন ডেকে উঠল । অত রাতে গিয়ে টুম্পার হাতের এককাপ চা খেয়ে মাঝরাতে আবার তাজপুর ফিরে এলাম । মোবাইল , টেলিফোন এসব না থাকলেই মনে হয় ভালো ছিল । এম্নিতে অহনাদের গ্রামে নেটওয়ার্কের সমস্যা তার ওপর বিদ্যুৎ বিভ্রাট মিলিয়ে সবার সাথে যোগাযোগ পুরোপুরি বিছিন্ন । শাপে বর হয়েছে । বেশ কিছুদিন ধরে চাইছিলাম সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাহাড়ী কোন নদীর ধারে ছোট্র একটা কুটিরে কাটিয়ে দেব দিন কয়েক । সঙ্গী থাকবে শীর্ষেন্দু ,সুনীলের বই আর অহনা । কয়েকদিন যোগাযোগের বাইরে থাকলাম বটে তবে পুরোপুরি পারলাম না । পরিচিত জন কিংবা সিরিয়াস রোগীর জন্য যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করতে পারলাম না । বাসায় থাকলে নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা যা হয় , তা হলো সবে বাথরুমের দরজা বন্ধ করেছি কিংবা মাঝরাতে সবে শুয়েছি অম্নি ঝনঝন করে বাজতে শুরু করবে মোবাইল । মাঝে তো মাঝরাতে , রাতের তিনটে চারটেয় আচমকা বেজে উঠত ফোন । শেষে একদিন অহনা রেগে মেগে বলল, তোমার এই ফোনের আওয়াজেই মাঝরাতে হয় আমার হার্ট এ্যাটাক হবে না হয় তোমার । লোকজন কি সেন্স সব ধুয়ে ফেলেছে নাকি ? তারপর থেকে রাতে সাইলেন্ট মুড অন করে দিয়েছি ।
সকাল থেকে আকাশ মেঘে ঢাকা । কোত্থেকে যে এ মেঘ জমা হলো কে জানে ! সূর্য তো প্রায় মুখই দেখাচ্ছিল না । অনেক বেলা করে যাও বা উঠল আবার ঢাকা পড়ে গেল মেঘেদের আড়ালেই । যেন আলো বিতরণের নৈমিত্তিক কর্তব্য পালনে আজ তার বড়ই অনীহা । অশান্ত পায়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম । এই ছ’তলার ফ্ল্যাট থেকে অনেকটা দুর অবধি দেখা যায় । উঁচু উঁচু অট্রালিকা , ছড়ানো আকাশ …। চোখ মেলে দিলে মনটা কেমন জুড়িয়ে যায় । আজ সবই যেন বিবর্ণ । প্রাতঃভ্রমণ শুরু করা দরকার আবার । একসময়ে অভ্যেসটা নিয়মিতই ছিল ।তখন শীত হোক , গ্রীষ্ম হোক , বৃষ্টি নামুক , কুয়াশা থাকুক উঠে পড়তাম কাকভোরে , সূর্য ওঠার ঢের আগেই নিজ হাতে বানানো এককাপ চা খেয়ে , জুতো- মোজা গলিয়ে সোজা রাস্তায় ।হাঁটতাম ও বেশ জোরে জোরে , লম্বা লম্বা পায়ে । মাত্র আড়াই বছরে ভেতর থেকে অনেকটাই ধসে গেছি । কথা নেই বার্তা নেই আচমকা ধাক্কা স্থবির করে দিয়েছে আমায় । সেজেগুজে সকালে বেরুনোর ইচ্ছেটাও মরে গিয়েছিল তখন থেকেই । কী এক তীব্র আলস্য যেন ভর করে আছে শরীরে । চোখ খুলতে ইচ্ছে করে না , বিছানা ছাড়তে ভালো লাগে না । জীবনের একটা নিজস্ব ছন্দ আছে । ভোরে উঠে একবার ডাকলেই অহনা উঠে পড়বে ,তবু ওকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করে না । মাঝে মাঝে দু’জনেই খুব ভোরে উঠে যাই , ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সকাল ফুটে ওঠা দেখি ।খুব কাছ দিয়ে উড়ে যাওয়া কাক দেখি , ঘুম ভাঙা চড়ুই দম্পতির কিচমিচ শুনি .. সব মিলিয়ে প্রতিটা ভোরেরই আলাদা সৌরভ আছে । মাঝে মাঝে গোলাপি ডানার ওপর কালো ছিটছিট দুটো প্রজাপতি আসে ব্যালকনির অলকানন্দ ফুলে ।সেন্টার টেবিলে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার গড়াগড়ি খাচ্ছে ।প্যাকেট থেকে একখানা সিগারেট বের করে নাড়াচাড়া করছি , এইমুহুর্তে তামাকের আমেজ গ্রহন করতে চাইছে মস্তিষ্ক । দু’হাতে দুখানা চায়ের মগ হাতে অহনা এসে দাঁড়িয়েছে । একটা বিকেল ফুরিয়ে যাচ্ছে । আরও একটা দিন খসে গেল জীবন থেকে ।
তুচ্ছ কথাতেও স্মৃতি যাদের আলোড়িত করে , বর্তমান তাদের সুখের নয় , আব্বা সব সময় এই কথাটা বলতেন। কথায় কথায় স্মৃতি আমায় আলেড়িত কখনোই করেনি । বারান্দার জানালার ধারে রাখা চেয়ারে শরীর ছেড়ে দিয়ে বড় বড় শ্বাস ফেললাম কয়েকটা । পশ্চিমের বারান্দায় এখন ছায়া । তিনটের দিকে হঠাৎ আকাশ ছেয়ে গেল মেঘে । বৃষ্টি পুরোপুরি নামেনি বটে তবে তার প্রস্তুতি খানিকটা যেন শীতল করে দিল পৃথিবীকে । পেছনের ছাদের কাঠ গোলাপের গাছে একটা পাখি ডেকে উঠল । ডাকছে , থামছে , আবার ডাকছে । ওই পাখির ডাক , ওই মেঘছায়া নির্জন অপরাহ্ন-টাকে মনমরা করে দিচ্ছিল । উঠে সামনের ঘর থেকে সিগারেট – লাইটার নিয়ে এলাম । টিভিতে প্রসেনজিতের একটা মুভি হচ্ছে একজন স্কুল মাষ্টার তার অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে বিনা পাসপোর্টে কলকাতায় যাচ্ছে … অন্য সময় হলে হয়তো মুভিটা দেখতাম , আজ দেখতে ইচ্ছা করল না । ফাঁকা চোখে তাকিয়ে আছি দেবদারু গাছটার দিকে । অহনার অফিস থেকে আসার সময় হয়েছে । বারান্দার শুকিয়ে যাওয়া সব গুলো গাছেই নতুন কুঁড়ি বের হয়েছে । কচি কচি সবুজ কুঁড়ি গুলো দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় । আহা এই বৃষ্টিতে অহনা কি করে আসবে ? ফোন করে ছাতা নিয়ে বের হব কিনা ভাবছি । মানুষের জীবনের প্রায় সব সম্পর্কই রক্তের সুত্রে পাওয়া । শুধু এই একটা সম্পর্কই গড়ে তুলতে হয় । এখানে একাত্মতার অনুভূতি একান্তই জরুরী । বৃষ্টির ছাঁট আজ পশ্চিম মুখী ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই দিচ্ছে না । ঘরে ফিরে এলাম । একটা গাঢ় নৈঃশব্দ্য ছেয়ে গেছে ঘরে । বাইরে বৃষ্টির ছাঁটে পুরো চরাচর অন্ধকার ।কমেছে ঘরের আলোও । ব্যালকনির দিকে জানালাটা খোলা , গ্রিল টপকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে অন্ধকার । আলো জ্বলে উঠল ঘরে । হাসি হাসি মুখ করে অহনা দাঁড়িয়ে আছে ।ওই হাসি মাখা মুখটাই আমার একমুঠো সুখ , অহনা জানে না ।
তিনদিন আগে তাহের কাকা মারা গেলেন । সোঁনারগাঁয়ের এই মানুষটা কেন যে এতো ভালোবাসতেন আমাকে ? খবরটা শোনার পর থেকে এক অদ্ভুত অপরাধবোধ ছোয়ে গেল বুকটা । সামনের ঘরে গিয়ে বসলাম । রাত কত হবে এখন ? আড়াইটে ? তিনটে ? ঢাকার রাত্রি কী ভীষণ নির্জন তখন । মেঘ সরে গিয়ে দুটো চারটে তারা ফুটেছে আকাশে , মলিন ভাবে জ্বলছে । কুকুরের পাল ডেকে ওঠছে থেকে থেকে , ছিঁড়ে খান খান হচ্ছে নির্জনতার ঘোর । আবার ঝিমোয় রাত । একা একা পায়চারি করতে করতে মনে হচ্ছিল এই রাত বুঝি অন্তহীন , সকাল আর আসবেই না । ভোর এসেছিল । ধুঁকতে ধুঁকতে । কাঁপতে কাঁপতে । আবার আলো । আবার শব্দ । মানুষ । ব্যস্ততা । কলরব । আহারে ! মানুষটা আর কখনো বলবেনা , বউ মা কে নিয়ে কবে আসবেন কাকা ? গত দু’দিন বৃষ্টি হয়নি তেমন ,আজ আবার সকাল সকাল আকাশ মুখ ভার করে আছে । বাতাস বইছে অল্প অল্প । শিরশিরে । ভেজা ভেজা । তাহের কাকার বাড়ী যাওয়া দরকার । পরক্ষনেই মনে হল , কোথায় যাব ? কেন যাব? শরীরে একটা অন্য অনুভূতি টের পাচ্ছিলাম । এ শোক নয , দুঃখ নয় , এ একেবারে অন্যরকম । বুকের কষ্টটা আরও বেড়ে গেল সহসা । অহনা আমাকে বোঝাচ্ছে , জীবন অনিত্য , কোনও মৃত্যুতেই ভেঙে পড়তে নেই । আমি আর অহনা একা বসে আছি । দুটো মানুষ পরস্পরের মুখোমুখি বসে থাকলেও খানিকটা কষ্ট লাঘব হয় । ব্যালকনিতে ডুবে যাওয়া সূর্য্যের দিকে তাকিয়ে ভাবছি জান্নাত নামের মেয়েটার কথা । আমার বন্ধুর শ্যালিকা , আমার স্কুলেরই ছোট বোন । শ্বশুরবাড়ীর লোকজন মেরে মুখে বিষ ঢেলে দিয়েছে । ছটফট করে রাত নয়টায় মেয়েটা মরে গেল । বাড়ীর দশ মিনিট দুরের হাসপাতাল রেখে দু ঘন্টা দুরের হাসপাতালে নিয়ে গেল তার শ্বশুরবাড়ীর লোকজন । মৃত্যু নিশ্চিত হল । আট বছর ধরে সংসার নামক সার্কাসে ব্যালেন্স করতে করতে দুটো সন্তান হয়েছে তার । পরী মনি নামের মেয়েটা ,যাকে নিয়ে ভোগবিলাসে ব্যস্ত ছিল সমাজের উঁচুস্তরের মানুষ , বোঝাপড়ায় উনিশ বিশ ব্যস টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে জেলে । রিমান্ডের পর রিমান্ড দেয়া হচ্ছে । কিন্তু ভোগবিলাসে ব্যস্ত রাখা মানুষজনের নাম আসছে না একটি বারের জন্যও । পুরুষ শাসিত সমাজে আবহমানকাল ধরে মেয়েদের দেখা হয়েছে ভোগের সামগ্রী হিসাবে , সন্তান জন্ম দেয়ার মেশিন হিসাবে , ঘর সাজানোর উপকরণ হিসাবে । পাছে তারা নিজেদের চিনতে শিখে যায় , তাই তাদের জন্য বিদ্যাশিক্ষাও তো নিষিদ্ধ ছিল এক সময় । কিন্তু সেই সব দিন তো অনেক কাল আগেই আমরা পেরিয়ে এসেছি তাহলে কেন আজ ও তাদের ভোগের বস্তু ভাবা হয় ? দোষটা কি শুধুই পুরুষ শাসিত সমাজের ? নাকি মেয়েদেরও কিছু দায় থেকেই যায় ? সামগ্রিকভাবে পুরুষদের হাতে অধিকারবোধের চাবিকাঠিটি এখনও আছে বটে , তবে এ যুগের মেয়েদের হীনদশার জন্য মেয়েরা নিজেরাই অনেকটা দায়ী । হ্যাঁ , মেয়েরা নিজেরাই । আরেকটু বিশদ ভাবে বললে , যে পরিবারে বধূ নির্যাতনের ঘটনা ঘটে , সে পরিবারের শাশুড়ী , ননদরা কি নিস্ক্রিয় থাকেন ? না । বরং তারাই বেশী নিষ্ঠুর উৎপীড়ক । এখনও ক’জন মহিলা বিধবা বিয়েকে সম্মানের চোখে দেখেন ? ছেলে একটি অল্প বয়স্ক বিধবা বিয়ে করছে , এইটুকুই বা কয়জন মা ভাল মনে মেনে নিতে পারেন ? মেয়েদের নিজেদের মধ্যে শিকড় গেড়ে থাকা দূর্বলতাই মেয়েদের পিছনে পড়ে থাকার অন্যতম কারন । তারা কখনই নিজেদের মানুষ হিসাবে ভাবতে শিখেনি । জান্নাত কিংবা পরীমনি আপনাদের কি মনে হচ্ছেনা আপনি এদের চেনেন ?
চেনেন বৈকি , আপনি দেখেছেন আপনার পাশের ফ্ল্যাটে , কি সামনের বাড়ীতে , কিংবা পাড়ায় , কিংবা আপনার দোতলায় অথবা একতলায় ? অথবা নিজেরই ঘরের চার দেয়ালে , নিজেরই মধ্যে ? দেখাটাই স্বাভাবিক । এরাই আমাদের সমাজের শতকরা আশিভাগ গৃহবধু , প্রতিদিনই তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে চাপা অপরাধ বোধের তুষের আগুনে ধিকিধিকি পুড়ছে এরা । রান্নাটা আজ স্বামীর মনমতো হলনা , তার জন্য অপরাধ বোধ , জ্বর হয়েছে শুয়ে আছেন স্বামী আর ছেলে পাউরুটি খেয়ে শুয়ে পড়েছে তার জন্য অপরাধবোধ । অফিস শেষে কলিগদের সাথে গল্পে গল্পে বাসায় ফিরতে একটু দেরী হলো , ফিরে দেখলেন স্বামী নিজ হাতে চা করে খাচ্ছে , তার জন্য অপরাধবোধ । প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে মাসে তিন চারটে দিন সহবাস করে স্বামীকে তৃপ্তি দিতে পারছেন না , তার জন্য অপরাধবোধ । আপাতদৃষ্টিতে এইসব অপরাধবোধগুলো যুক্তিবাদী চোখে যতই হাস্যকর মনে হোক এর শিকড় কিন্তু অনেক গভীরে , হৃদয়ের অন্তরালে । আসলে মেয়েরা নানারকম কমপ্লেক্স এর শিকার । নিজেরাই নিজেদের ছোট বলে ভাবতে ভালোবাসে । অকারণ হীণম্মন্যতায় ভূগে , সেই শৈশব থেকেই । একটা সংসারে তারাও যে পুরুষের সমান অংশীদার , তারা নেই তো সংসারও নেই , এই বোধটুকুই বেশির ভাগ মেয়েদের নেই । আশার কথা এতটুকু যে এখনকার ছেলে মেয়েদের মধ্যে এখন আড়ষ্টভাব নেই , তাদের বন্ধুত্ব এখন অনেক অনেক বেশি সহজ , সাবলীল । ঘি আগুন সম্পর্কের বাইরেও যে একটা সুস্থ স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকতে পারে তা কিন্তু আজকালকার ছেলেমেয়েরা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে । হ্যা , উচ্ছৃঙখল ছেলেমেয়ে আছে । আগেও ছিল , এখনও আছে ভবিষ্যতেও থাকবে । কেন তারা উচ্ছৃঙ্খল হয় , কী ধরনের পরিবেশ তাদের উচ্ছৃঙ্খল করে সেটা আগে অনসন্ধান করা দরকার । মূলে না গিয়ে শুধু আগা ছেঁটে গেলে প্রকৃত সমস্যার সমাধান কিন্তু হয়না ।
সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হল , রাত ক্রমে নিশুত । শব্দ কমে এল , তন্দ্রা নামছে শহরে , বেরিয়ে পড়ল নৈশপ্রহরী , হুইসেল বাজিয়ে টহল দিচ্ছে থেকে থেকে , রাত্রির নির্জনতা ছিঁড়ে হঠাৎ হঠাৎ ডেকে ওঠে কুকুরের পাল , কোথায় কোন ফ্ল্যাটে বাচ্চা কেঁদে উঠল … চোখে ঘুম নেই । কত রকম যে ভাবনার আনাগোনা ।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট