একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুটপাটসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় হবিগঞ্জের লাখাইয়ের এক রাজাকারকে ফাঁসি ও তিন রাজাকারকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। আজ বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যদের ট্রাইব্যুনাল এই রায় দেন। মামলার পাঁচ আসামির মধ্যে আসামি সাব্বির আহমেদকে খালাস দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া রাজাকার মো. শফি উদ্দিন মাওলানা পলাতক।
আমৃত্যু কারাদণ্ড পাওয়া রাজাকার মো. জাহেদ মিয়া ওরফে জাহিদ মিয়া, মো. সালেক মিয়া ওরফে সায়েক মিয়া ও তাজুল ইসলাম ওরফে ফোকন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে শফি উদ্দিনের মৃত্যু কার্যকর করতে বলা হয়েছে রায়ে। আর আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ প্রাপ্তদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের কারাভোগ করতে হবে।
শফি উদ্দিন আত্মসমর্পণ করলে অথবা তাকে গ্রেপ্তার করার পর তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর নির্দেশ দিয়ে রায়ে আরো বলা হয়েছে, দণ্ড বা রায় ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে যদি শফি উদ্দিন মাওলানাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয় অথবা তিনি যদি আত্মসমর্পণ করেন তবে বিনা মূল্যে তার কাছে রায়ের অনুলিপি সরবরাহ করতে হবে।
মামলার দুটি অভিযোগের মধ্যে প্রথম অভিযোগে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় চার আসমিকে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড এবং দ্বিতীয় অভিযোগে শফি উদ্দিন মাওলানাকে মৃত্যুদণ্ড এবং তিন আসামিকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
২০১৬ সালের ২২ মার্চ তদন্ত শুরু করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। ২০১৭ সালের ২২ নভেম্বর এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। পরে তিন আসামি জাহেদ মিয়া ওরফে জাহিদ মিয়া, সালেক মিয়া ওরফে সায়েক মিয়া এবং তাজুল ইসলাম ওরফে ফোকনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ২০১৮ সালের ৪ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। পরে যাচাই-বাছাইয়ের পর একই বছরের ৬ আগস্ট পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। এরপর ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে এ মামলার অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১৯ সালের ২৪ মার্চ এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে গত ১৮ জানুয়ারি শেষ হয়। তদন্ত কর্মকর্তাসহ এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন ৯ জন সাক্ষী। সাক্ষ্যগ্রহণ ও মামলার যুক্তিতর্ক শেষে গত ১৭ মে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষায় রাখার পর বৃহস্পতিবার রায় দেন ট্রাইব্যুনাল।
রায়ের পর প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সিমন সাংবাদিকদের বলেন, ‘রায়ের অনুলিপি পাওয়ার পর পর্যালোচনা করে খালাস এবং আমৃত্যু কারদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার চিন্তা করব। ’
জাহেদ মিয়াসহ চার আসামির পক্ষের আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান বলেন, ‘২০১০ সালে সৈয়দ কায়সারের মামলা চলছিল, তখন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা হবিগঞ্জ জেলার রাজাকারদের একটি তালিকা তৈরি করেছিল। সে তালিকায় এ আসামিদের নাম ছিল না। পরে ২০১৭ সালের আরেকটি তালিকা তৈরি করে আমার আসামিদের নাম ঢোকানো হয়। ’
এই আইনজীবী বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের রায়ে আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব। আশা করি আপিলে তারা খালাস পাবেন। ’
পলাতক সাব্বির আহমেদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিমের ভাষ্য, ট্রাইব্যুনালের রায়ে তার মক্কেল ন্যায়বিচার পেয়েছেন।
প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৩১ অক্টোবর রাত ২টায় আসামি মো. শফি উদ্দিন মাওলানা সহযোগী রাজাকার ও পাকিস্তানি আর্মিদের সঙ্গে নিয়ে লাখাইয়ের মুড়িয়াউক গ্রামে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এমএনএ মোস্তফা আলীর বাড়িসহ আশপাশের আরো ১০-১২টি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে স্বর্ণালংকার, টাকা-পয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করেন এবং গানপাউডার ছিটিয়ে বাড়িগুলো পুড়িয়ে দেন।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৩১ অক্টোবর রাত ৩টার দিকে আসামি মো. শফি উদ্দিন মাওলানাসহ অন্যান্য রাজাকার ও একদল পাকিস্তানি আর্মি নিয়ে লাখাইয়ের মুড়িয়াউক গ্রামে যান। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা মো. ইলিয়াস কামালের বাবা মো. ইদ্রিস মিয়া ও মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহজাহানের বাবা আব্দুল জব্বারকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যা করা হয়।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট