সাপের ডিম থেকে দোয়েল পাখি আশা করতে পারি না৷ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ভয়ানকভাবেই একেকটা শিক্ষার্থীকে মৌলবাদী মূর্খে পরিণত করছে ৷ তারা হয়ে উঠছে তীব্র প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক৷ কেন?
সভ্য দুনিয়া মিথ্যার বেশাতি থেকে মুক্ত হয়েছে৷ ফ্রান্স শিক্ষার্থীদের গৃহে পড়ানো নিষিদ্ধ করেছে৷ আমেরিকাসহ সভ্য দেশগুলোতে স্কুলে ধর্ম পড়ানো নিষিদ্ধ৷ বিজ্ঞানবিরোধী কিছু পড়ানো যায় না৷ সভ্যদেশে সবচেয়ে মেধাবীরাই শিক্ষকতা করে৷ আর আমাদের দেশে?
পুরোটাই উল্টো৷ এদেশে মাধ্যমিক হয়ে উঠেছে কোথাও চাকরি না-পাওয়াদের আস্তানা৷ বাংলাদেশের বড় বড় স্কুলে আড়াই/তিন হাজার ছাত্রের বিপরীতে মাত্র ১৫/১৭ জন এমপিওভূক্ত শিক্ষক৷ বিপরীতে ৪০/৫০ জন খণ্ডকালীন শিক্ষক থাকে৷ এমপিওভূক্তরা অধিকাংশই নিম্ন মেধার এবং খণ্ডকালীনরা ব্যতিক্রম ছাড়া বিংলা ইংরেজি ঠিকমতো পড়তেও পারে না৷ বিজ্ঞান-গণিত বুঝে এমন শিক্ষক আরো কম৷ খণ্ডকালীনদের মাসিক বেতন দেয় ২/১০ হাজার টাকা৷ একজন প্রাথমিক পাশ দোকান কর্মচারীও এর চেয়ে বেশি বেতন পান৷ ফলে এখানে মিনিমাম যোগ্যতা নিয়েও কেউ আসেন না৷ তারা নিজেরাই ধর্মান্ধতায় নিমজ্জিত৷ অলৌকিক ক্ষমতা ছাড়া পড়াশোনা না-জানারা কিভাবে শিক্ষক হয়ে বসতে পারে? তাই শিক্ষকরাও হয়ে থাকে অলৌকিক শক্তির পূজারী৷
এটা একটা মারাত্মক দুষ্টুচক্র৷ পরিবারে মৌলবাদী পিতা-মাতা জন্মের পরেই শিশুটিকে মৌলবাদী বানাতে বদ্ধ পরিকর হয়ে উঠে৷ মৌলবাদী সমাজও তাকে বিকাশহীন করে রাখে৷ মুক্তির পথ হতে পারতো হাই স্কুলগুলো৷ কিন্তু সেটা হয়ে উঠেছে মৌলবাদের আখড়া৷ মেধাহীনরা ওখানে কোন মেধাবীকে ঢুকতে বা টিকতে দেয় না৷ ওরা হাইস্কুল থেকে নজরুল-রবীন্দ্র জয়ন্তী, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, গান, আবৃত্তিসহ যাবতীয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিতে পেরেছে৷ ওরা শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতাকে সরিয়ে দিতে পেরেছে৷
আমরা গতবছর আমাদের স্কুলে একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজন করেছিলাম৷ আমার ও আব্দুর রহমানের বিতর্ক করার অভিজ্ঞতা ও আমার প্রশিক্ষণ থাকায় সফলভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছি৷ কিন্তু কতিপয় মূর্খ মৌলবাদী বিতর্ককে নাস্তিকতা আখ্যা দিয়ে প্রচারণা চালায়৷ ওরা মৌলবাদী, মাদক ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসী একাকার হয়ে উঠে৷ ওদের মূল আপত্তি- আমাদের কর্মকাণ্ড ওদের অপকর্মে নাকি বিঘ্নতা তৈরি করে৷
বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা চালু করতে না পারলে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা বন্ধ হবে না৷ সাম্প্রতিক মৌলবাদী হামলাগুলোতে দেখলাম, হামলার শিকার শিক্ষকগণ অপেক্ষাকৃত মেধাবী, ভাল শিক্ষক, প্রগতিমনা ও হিন্দু৷ হামলাকারীরা অধিকাংশই ছাত্র ও মুসলিম মৌলবাদী৷ স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, মৌলবাদী চেতনার শিক্ষার্থীরা সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার কারণে প্রগতিমনা হিন্দু শিক্ষকদের উপর হামলা চালিয়েছে৷
স্কুলগুলো বিষধর সাপ হয়ে ডিম পেরে তা দিচ্ছি আর জন্ম দিচ্ছে বিষধর সাপ৷ আমরা ওইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে গানের পাখি জন্ম নিবে আশা করছি৷ তাই দাবি করছি-
১) মাধ্যমিকের শিক্ষক কাঠামো পরিবর্তন করে এমপিওভূক্ত শিক্ষক বাড়াতে হবে৷ মাধ্যমিকের শিক্ষদের বেতন বাড়াতে হবে৷ শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা আরো বাড়াতে হবে৷
২) বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা দিতে হবে এবং অবৈজ্ঞানিক বিষয় পড়ানো বাদ দিতে হবে৷ শিক্ষার্থীদের মানবিক ও সামাজিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিতে হবে৷
৩) স্কুলে নিয়মিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালাতে হবে, পাঠ্য বইর বাইরে যাতে শিক্ষার্থীরা অন্যান্য বই পড়তে বাধ্য হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে৷ লাইব্রেরিয়ানদের দিয়ে ক্লাস নেওয়া নিষিদ্ধ করতে হবে৷ অযোগ্য খণ্ডকালীনদের দিয়ে পাঠদান নিষিদ্ধ করতে হবে৷ খণ্ডকালীন শিক্ষক হওয়ার মানদণ্ড নির্ধারণ করতে হবে৷
৪) মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে আক্রমন ও লাঞ্ছিত করাকে বড় অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে৷ শিক্ষকদের বিজ্ঞানবিরোধী কথা বলা, যৌন হয়রাণী করা ও দুর্নীতি করাকে অযোগ্যতা হিসেবে গণ্য করে বরখাস্ত করতে হবে৷ বিজ্ঞানবিরোধী ও যৌন হয়রাণীমূলক কথা বলা ছাড়া ক্লাসে শিক্ষকদের কথা বলাকে দায়মুক্তি দিতে হবে৷
স্কুলগুলোতে বিষধর সাপের ডিমে তা দেয়া বন্ধ করান৷ দেশও সভ্য ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে৷