পর্ব-৫১
আকাশে চাঁদ উঠেছে । চাঁদ ওঠার পর অন্ধকার অনেক মিহি । দুরে , নীচে কয়েকটা আলোর ফুটকি । জেগে আছে কেউ আমার মত । হিম বাতাসে অপরাজিতা আর জবার ডাল পাতা কাঁপছে । তিনদিন ধরে খুব জ্বর । রাতে ঘুম নেই বললেই চলে । অহনার মন খারাপ হয়ে আছে । কে কার বৌ কে নতুন মোবাইল , কে কার বউকে নতুন গহনা দিয়েছে এসব নিয়ে নাকি লোক সামাজিক মাধ্যমে ফলাও করে স্ট্যাটাস দেয় । সেসব দেখে অহনার মন খারাপ হয় । অহনার জন্য হঠাৎই বড় কষ্ট হয় আমার । বুকের ভেতর শুয়োপোকা নড়াচড়া করে । নড়ছে , নড়েই চলছে । সৎ পথে এসব সম্ভব না । আব্বা ছোট বেলায় একটা গল্প বলতো , গভীর অরণ্যে এক সন্ন্যাসী দস্যু রত্নাকরকে বলেছিলেন , ডাকাতি তো করছো ; তোমার পাপের ভাগী কে হবে ? বউ? ছেলে ? মেয়ে ? বাবা ? মা ? ভাই ? বোন ? কেউ না । রত্নাকর যাচাই করতে গিয়ে দেখেছিল সেটাই সত্যি । নিজের পাপের ভাগীদার নিজেকেই হতে হয় । সমাজের কিছু পারফেক্ট নাটবল্টুর সাথে বসবাস আমার । এরা একটা চাকরি জোগাড় করবে তারপর এনরমাস ঘুষ খাবে , জোচ্ছুরি করবে তারপর পঞ্চাশের পর থেকে প্রেশার আর সুগারের ঔষুধ খাবে , ষাটে অক্কা । ততদিনে ছেলেও বাবার মত পারফেক্ট নাট বল্টু হবে , সমাজ সংসার নোংরা অচ্চুত করে যাবে । এরা সবাই আমার সাময়িক সঙ্গী হতে পারে ;বন্ধু নয় । এদের সকলেরই স্বভাবে কোন না কোন রকম হ্যাংলামি রয়েছে । কিছু কিছু মানুষের জন্য পৃথিবীটাই আর বসবাস যোগ্য থাকবে না । জ্বরের জন্য রাতে ঘুম হচ্ছে না । সোফায় শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছি সারারাত । তা নিয়ে দুপুরে খেতে এসে অহনার অভিযোগের শেষ নেই । বেচারী একা একা বিছানায় ঘুমাতে অস্বস্তি বোধ করে । রাতে একবার উঠে এল অহনা , এক নজর দেখেই আবার চলে গেল । শেষ রাতের দিকে নিজেকে আচমকা ভীষন বিচ্ছিন্ন মনে হলো । সম্পূর্ণ একা । উত্তাল সমুদ্রে কম্পাসবিহীন দিক্-ভ্রান্ত জাহাজের মতো । হাতের আঙ্গুল গুলি মৃদু কাঁপছে । আজকাল সামান্য মানসিক উত্তেজনাতেও এই এক নতুন উপসর্গ হয়েছে । পীরগঞ্জে লোকদের কান্না আর হাহাকার শুনেও এমন হয়েছিল । রাত্রিতে গাছে হাত দিতে নেই , তবু বাহারি মানিপ্ল্যান্টের পাতা গুলোতে আলতো হাত বোলালাম ।
সূর্য্য হেলে পড়েছে । প্রথম বিকালের সাদাটে সূর্য্য । ক্রমশ তাপ ফুরিয়ে আসছে । তবুও শেষবারের মতো ভাস্বর । সেলুনের ভেতর ফ্লোরে সে আলোর গড়াগড়ি । রাস্তায় অবিশ্রান্ত পথচারীদের আসা যাওয়া । শ্যাওড়াপাড়া নিজস্ব নিয়মে শব্দময় । এত আলো এত শব্দ সবই নিষ্প্রভ মনে হচ্ছে আমার কাছে । চুল কাটাব বলে বসে আছি । আজকাল মানুষের সময় জ্ঞান খুব কম । এক লোক শরীর মাথা ম্যাসাজ করাচ্ছে আধঘন্টা জুড়ে । ওঠার নামই নেই । অদ্ভুত ! বিরক্তি আর ক্রোধ কমানোর জন্য সিগারেট ধরালাম একটা । বুক ভরে ধোঁয়া নিতেই কিছুটা রাগ কমছে । তমালের বউ আঁখি এসেছে পরশু । অহনার আম্মা বস্তা ভর্তি শীতের সব্জী দিয়েছে । কাঁচকলা ,পেঁপে ,কাঁচা লংকা কিছুই বাদ পড়েনি । অহনার মেজ মা নিজের বাগানের টাটকা তাজা সব্জী পাঠিয়েছেন । ভালোবাসা খুব অদ্ভুদ এক রাসায়নিক বিক্রিয়া । সন্ধ্যা নামল শহরে । রাস্তার বাতিগুলো সব একে একে জ্বলে উঠেছে । হেমন্ত চলছে । শরৎ আর শীতের মাঝে হেমন্ত ঋতুটা যেন কেমনতর । কখন যে একটা পাতলা কুয়াশায় মুখ লুকিয়ে চুপিসাড়ে এসে যায় ।তারপর যেন কাটতেই চায় না । বাতাস শুকনো হয়ে আসে ,চামড়ায় টান ধরে , এক হিমঋতুর পদধ্বনি শোনা যায় দুরে । কিন্তু আসে না শীত । তখনও যেন শরতের গন্ধ লেগে থাকে বাতাসে । উচ্ছল শরৎ আর হাড়- কাঁপানো শীত , মাঝের সময়টা বড় নিশ্চেতন । প্রলম্বিত । ছোট ছোট অগুন্তি কালো পিঁপড়ে লাইন দিয়ে দেয়াল বেয়ে উঠছে । কী যেন সাদা সাদা গুঁড়ো মুখে করে নিয়ে চলেছে সকলে । যেন এক সাদা ফুটকীওয়ালা কালো সুতো ঝুলছে দেয়ালে । কাঁপছে মৃদু মৃদু । ভারী সুশৃঙ্খল এক পদযাত্রা । শীতের প্রস্তুতি । দু’তিনদিন ধরে অহনা সাড়ে এগারোটার আগেই বিছানায় আসার তাড়া দিতে থাকে – রাতে না ঘুমিয়ে না ঘুমিয়ে শরীরের কী হাল করেছ জানো তুমি ? আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখছ ? বয়স হচ্ছেনা ? রোগে পড়লে আমি কোথায় যাব ? আমি বলি ধুস্ বয়স ? বয়স তো একটা মেন্টাল ফিক্সেশান । বয়স টয়স বলে কিচ্ছু নেই ।গজগজ করতে করতে বেডরুমে পা বাড়ায় অহনা ।আমিও গম্ভীর মুখে সিগারেট ধরিয়ে ওর পিছু পিছু । আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল অহনা ,আমার ঘুম আসে না । জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকি , ঘুম আসে না । রাতটা ঠান্ডা হয়ে এল , আমার ঘুম আসে না । ক্লান্তিতে চোখ জড়িয়ে আসছে , ঘুম আসে না । মস্তিষ্ক অদৃশ্য আঁকিবুকি কেটে চলেছে শূন্যে ।
অগ্রহায়ন চলছে । বিকেল হলেই মিহি কুয়াশা এমন ছড়িয়ে পড়ে মনে হয় ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে চারধার । প্যাকেটে একটাই সিগারেট ছিল । আশে পাশে অ্যাশট্রে নেই , উঠতে ইচ্ছে করছে না , ফাঁকা প্যাকেটেই ছাই ঝাড়ছি । অনেকক্ষণ পর সুখটান , মস্তিষ্কে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে ধোঁয়া । বাইরে হিম পড়ছে । বাতাসে শিরশিরে ভাব ।কয়েকদিন ধরেই বিকেল নামতে না নামতেই মশার জ্বালাতন বেড়েছে । আরো শীত পড়লে হয়তো ভনভনানি কমবে । শুকনো বাতাসে টান ধরছে চামড়ায় তেলোয় ক্রিম ঘষতে হবে । পাঁচটা না বাজতেই অন্ধকার নেমে যাচ্ছে আজকাল । জানালা দিয়ে কিছুই প্রায় আর দেখা যায় না , ধোঁয়া ধোঁয়া অন্ধকার ছাড়া । ঢাকার ওপর আমার তেমন কোন ও মায়া নেই,বরং এখন একরকম অপছন্দই করি শহরটাকে। কী দিয়েছে আমাকে এই শহর? শুধু কাঁড়িখানেক অস্বস্তিকর স্মৃতি ছাড়া? আমার সব তো কেড়ে নিল এই শহর, এই শহরে বাস করা কিছু মানুষ। ঠিক তিন বছর আগের এই সময়টাতেই একেবারে নিঃস্ব করে দিয়েছে আমাকে। এই শহরে তো লকলকে জিভ আর সর্বগ্রাসী পাকস্থলী ছাড়া কিছু নেই।
অহনা না থাকলে আমার জীবন কবেই এই শহর থেকে বোকাট্টা হয়ে যেতো । আসলে আমার জীবনটা এক পাহাড়ি নদীর মতো, মাটি পাথর ভেঙে সে করে নিচ্ছে নিজের রাস্তা। কখনও ছুটছে লাফাতে লাফাতে, কখনও বিপদজনকভাবে আছড়ে পড়ছে, কখনও বা বইছে তিরতির করে। ইদানিং খুব উদ্বেগে দিন কাটছে। উদ্বেগের ও প্রাণ আছে, প্রাণীদের মতো তার রুপভেদ ও অজস্র। কখন ও সে তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলে। কখনও বা একছিটে মেঘ হয়ে দেখা দেয় মনের আকাশে, ক্রমশ দখল করে নেয় হৃদয় গগন। আবার কখনও বা নিজের ফুঁয়েই নিজে হাওয়া ভরা বেলুনের মতো আতিকায় হয়ে ওঠে। আব্বা সব সময় বলতো সৎ পথে খেটে খাবি। মরে গেলেও চুরি জোচ্চুরি করে পকেট ভরাস না, দেখবি পেট আপনিই চলে যাবে। সত্যি বলতে কি একজন বিবাহিত পুরুষ সৎ থাকবে কি অসৎ হবে তার বেশীটাই নির্ভর করে তার স্ত্রীর ওপর । এদিক থেকে অহনার কৃতিত্ব অনেক । এইযে খেয়ে পরে সম্মানের সাথে চলে যাচ্ছে আমাদের দিন এতেই সে সুখী । আমার সততা তার কাছে অলংকার ।
যুগে যুগে অবৈধ উপার্জনের কত রকম নাম হয়েছে , কখনো উপরি কামাই সেটাই আবার পরে ঘুষ পরে কমিশন এখন সেটার নতুন নাম প্রপিট শেয়ারিং । আমি কোন কালেই লুকোছাপার মানুষ নই । নিজের মতো করেই বাঁচি । অহনা ও আমার মতো চাহিদা বড্ড কম । দিনশেষে ওর অফিসে কি হলো সে নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই আবার আমার হাসপাতালে কি হলো সে নিয়েও অহনার মাথা ব্যাথা নেই । উই বিলিভ ইন অ্যাবসোলিউট প্রাইভেসি । একে অন্যের প্রফেশনাল স্ফিয়ারে নাক গলাই না । এবং সেই জন্যই বোধহয় আর আট- দশটা কাপল থেকে আমাদের রিলেশনটা বেশী মধুর এবং মজবুত । খুব জরুরী না হলে সরাসরি ফোন খুব কমই করে অহনা । না হলে মেসেজ দিয়ে রাখে । প্রাচুর্য কখনোই মানুষকে সুখী করে না । আজ এইযে আমি ঘুরে দাঁড়িয়েছি , যেটুকু সাফল্য , যতটুকু সচছলতা , তার পিছনে তো ওই একজনই , অহনা । আঠারো সালের অতল গহ্বর থেকে আমাকে উদ্ধার করলো যে নারী সে তো অহনাই । আমাদের বিয়ের পর অহনাকে কতজন কতরকমের টিজ করেছে । চাকরি করবেন নাকি ছেড়ে দেবেন ? এতবড় ডাক্তারের বউ চাকরি কি শখে করবেন ? এখন তো বেতন পেলেও চলবে না পেলেও চলবে । কথাটা মিথ্যে নয় আবার পুরোপুরি সত্যিও নয় । চাকরি না করলে অহনা অসুবিধায় পড়বে না , এটা যেমন সত্যি , আবার প্রতি পদে পদে স্বামীর কাছে কিংবা বাবা মায়ের কাছে হাত পাততে বাধো বাধো ঠেকবে , এটাও তো সমান সত্যি । রোজগার যত সামান্যই হোক , চাকরিটা অহনার কাছে আত্মনির্ভরতার একমাত্র উপায় ও তো বটে । গত কয়েকদিন ধরে বাস ভাড়া হাফ করার দাবীতে ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করছে আজ দেখলাম ঢাকা কলেজের সামনে আন্দোলন করা ছাত্রদের ওপর “জয় বাংলা “ ধ্বনি দিয়ে হামলা করলো ছাত্রলীগ । হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হলো । এ কোন ছাত্রলীগ ? এরা ছাত্রদের দাবী নিয়ে না লড়ে , তাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে । অথচ জানুয়ারী ১৯৬৯ সালে ছাত্ররা যে এগারো দফা দাবী পেশ করেছিল তার এক নাম্বার দফার (ঢ) দফায় স্পষ্ট দাবী ছিল , ট্রেনে , স্টিমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের আইডেন্টিটি কার্ড দেখাইয়া শতকরা পঞ্চাশ ভাগ কন্সেসনে টিকেট দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে । মাসিক টিকেটেও এই কন্সেসন দিতে হইবে । পশ্চিম পাকিস্থানের মতো বাসে ১০ পয়সার ভাড়ায় শহরের যে কোন স্থানে যাতায়াতের ব্যবস্থা করিতে হইবে । দূরবর্তী অঞ্চলে বাস যাতায়াতেও শতকরা ৫০ ভাগ কন্সেসন দিতে হইবে । ছাত্রীদের স্কুল- কলেজে যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা করিতে হইবে । সরকারী ও আধা-সরকারী উদ্যোগে আয়োজিত খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছাত্রদের শতকরা ৫০ ভাগ কল্সেসন দিতে হইবে । আপসোস এ দাবীটা তখন পরাধীন বাংলাদেশের ছাত্রদের পক্ষ থেকে স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারকে করা হয়েছিল । অথচ আজ স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্রদের ন্যায্য দাবীর বিপরীতে বাংলাদেশের মানুষের প্রানের শ্লোগান “জয় বাংলা “ ব্যবহার করে সরকার দলীয় সন্ত্রাসীরা ছাত্রদের উপর হামলা করছে । লজ্জা হচ্ছে । এই এগারো দফার আন্দোলনে শহীদ হয়েছিল আসাদুজ্জামান । গত কয়েকদিন বাংলাদেশ পাকিস্তান ম্যাচে পাকিস্তানের জার্সি গায়ে বাংলাদেশীদের উল্লাস দেখে প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছি ।
ঘড়িতে চোখ পড়তেই চমকে ওঠার জোগাড় । এই আটটা বেজেছিল, দেখলাম অহনা রেডি হচ্ছে এরই মধ্যে বারোটা ? সময় সত্যি বড় দ্রুতগামী ঘোড়া । আমার এক বন্ধু ফোন করলো মিইয়ে যাওয়া আমতা আমতা ভাব নিয়ে নিজের পারিবারিক সমস্যার কথা বলছে । এই বন্ধুর মিইয়ে যাওয়া আমতা আমতা ভাবটায় ভারী মজা পাই আমি । তিন বছর আগে আমার বিপদের দিনে কথায় কি চাকচিক্য ছিল মানুষটার । সপ্রতিভ চালচলন । চকচকা শার্ট প্যান্ট পরে তত্ত্ব কথার ফুলঝুরি । আর আমি তখন নেহাতই দীনহীন , উদ্বাস্তু , পরগাছা । একটা দিনের জন্য তার আশ্রয়ে রাখেনি । অথচ আজ ! যোগ্যতা যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কত ভাবে মানুষের অবস্থান বদলে দেয় ! যোগ্যতা নাকি জেদ ? নাকি লক্ষ্যে অবিচল থাকার ক্ষমতা ? অত বড় ঘটনার পর জেদ না থাকলে কি ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম ? দীনহীন সে জীবনে প্রত্যেকটা দিন আমার রোখ বাড়িয়ে দিয়েছে , আমাকে আরও শক্তপোক্ত করেছে , নয় কী ?? কপাল-টপালে আমার বিশ্বাস নেই । কপাল মানুষ নিজে বানায় । টিভি দেখতে দেখতে কি করে আরো একঘন্টা কেটেগেল , টেরই পেলাম না । চোখে এবার চাপ পড়ছে । একটা সিগারেট ধরিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম । বাইরেটা পশ্চিম , অনেকটা দুর অবধি খোলা । অনেকটা দুরে গগণ রোধ করে অট্রালিকা । আধো তন্দ্রায় মনে হল অহনার ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম । বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করল না । শীত তেমন না পড়লেও , ঘুরন্ত পাখার নীচে কম্বল জড়িয়ে পড়ে থাকতে বেশ লাগছিল । কাল সারারাত জাগা , মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা লেখার প্লট নিয়ে মগজে ঘষাঘষি চালাচ্ছিলাম , ব্যস ঘুমের বারোটা বেজে গেল । সাড়ে পাঁচটা বাজে । অনিচ্ছা সত্ত্বেও কম্বল হঠিয়ে উঠে বসলাম । কোথায় অহনা ! অবচেতন মনে হয়তো মনে হয়েছে । হাসপাতালে যেতে হবে তো । রান্নাঘরে গিয়ে চুলা জ্বালিয় পানি বসালাম । কফি খাব । ছুটির দিনেই দু’জনের যা একটু গুছিয়ে খাওয়ার ফুরসত মেলে আমাদের ।
আজ পরিমল দা’র মৃত্যুদিন নভম্বরের চব্বিশ তারিখ । নভেম্বরের চব্বিশ তারিখেই তো সেই বিফল অক্ষম হেরে যাওয়া মানুষটা বিষ খেয়ে মরেছিল । কত বছর আগে যেন ? পাঁচ বছর নাকি ছয় বছর ? মাথায় আর থাকেনা ঠিকঠাক । কেন যে থাকে না ? মরার বেশ কয়েক মাস আগেই রাগ করে আমার সাথে কথা বন্ধ করে দিয়েছিল বলে ? নাকি সামনে তাকাতে গেলে পিছনের দুঃস্বপ্নকে ভূলে থাকতে হয় ? মনটা কি ক্রমশ মরে যাচ্ছে আমার ? হয়তো বা । মনের আর দোষ কী , যা উৎপীড়ন চলেছে মনের ওপর গত কয়েক বছর । সকাল সাড়ে পাঁচটা বাজে । হেমন্তের ভোর সবে পা ফেলছে । প্রায় নির্জন ফ্ল্যাট টা ঝিম মেরে পড়ে আছে । শব্দহীন । ছায়ামলিন ।চোখ কুঁচকে আমাকে একবার দেখে আবার গুটিসুটি ঘুমিয়ে পড়লো অহনা । সকালের জল খাবার নিজেই বানিয়েছি । সাদামাঠা নাস্তা । বাটারটোস্ট , ডিম অমলেট আর গরম গরম এক মগ কফি । টিভি সেটের সামনে বসে বাটার টোস্টে কামড় বসাচ্ছি নিউজ দেখছি । ঢংয়ের কোন নিউজ নয় বরং এদেশের প্রধান দুই দলের কামড়াকামড়ির খবর । ইউপি নির্বাচন নিয়েও যে লাশ পড়তে পারে আমার ধারনা ছিল না । গত কয়েক দফার নির্বাচনে শুনতে পাচ্ছিলাম সরকার দলের ইউপি চেয়ারম্যান মনোনয়ন বাগাতে ৫০ লাখ থেকে এককোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে । শুনে তো আমার অজ্ঞান হবার যোগাড় । আওয়ামী লীগ খুব চমৎকার ভাবে এদেশের নির্বাচন করার প্রক্রিয়াটাকে হত্যা করেছে । সাংবিধানিক কাঠামো গুলো যতদিন যাচ্ছে ধ্বসে পড়ছে । জনগন দিশেহারা । এই শীতের মৌসুমেও সব্জীর দাম সাধারন মানুষের নাগালের বাইরে । পরশু চেম্বার থেকে যাবার সময় এক সব্জীর ঠেলার পাশে দাঁড়ালাম বেগুন ,ফুলকপি নেব বলে । এক ভদ্রলোক একটা বাঁধাকপি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন , দোকানীর দাম শুনে একবার কপির দিকে তাকাচ্ছেন আবার পকেট হাতড়াচ্ছেন । আমার খুব মায়া হচ্ছিল । আহারে মধ্যবিত্ত ! ভাবছেন পঞ্চাশ টাকায় বাঁধাকপি নিয়ে হয়তো একবেলাতেই হবে না তাহলে পরে কি হবে ?? আমার ইচ্ছে হচ্ছিল ভদ্রলোক কে একটা কপি কিনে দেই , কিনে দিলে ভদ্রলোক হয়তো রেগে যাবেন তাই চুপচাপ দেখতে থাকলাম । এই মধ্যবিত্ত সমাজটার আর কিছু থাক বা না থাক প্রেস্টিজটা খুব কড়কড়ে থাকে । মধ্যবিত্ত সমাজ টা ভ্যানিস হতে আর বোধহয় বাকি নেই , নিম্নবিত্তের কাতারে নামতে এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা ।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট