পর্ব-৫৪
শীতে আকাল বৃষ্টি হলো । এরকম হলে তো গাঁয়ের চাষা ভিক্ষে করতে নামবে শহরে । বাজেটে এসি , ফ্রিজের দাম কমে কিন্তু চালের দাম কমে না । মেগা প্রজেক্ট আর ইন্ড্রাস্ট্রি দিয়ে কি হয় ? দেশের ইকনমি কৃষির ওপর দাঁড়িয়ে আছে , ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না কৃষক । চালের , ডালের দামে মানুষের নাভিশ্বাস আর বাজার ছেয়ে যাচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল গুডসে । বলদ দুয়ে দুধ পাওয়ার চেষ্টা ।কেউ অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে কথা বলে না । গত দু’ মাসে বেশ ক’বার অহনাদের গ্রামের বাড়ী যাওয়া হয়েছে । দেখেছি কিভাবে মধ্যসত্ত্বভোগীরা সিন্ডিকেট করে বাজারে বাড়িয়ে চলেছে নিত্যপণ্যের দাম । গত দু বছরের করোনা মহামারীতে বেকারে ভরে গেছে দেশ । বিদেশী নির্ভর শিল্প কারখানার উৎপাদন কমে এসেছে । ছাঁটাই হয়েছে শ্রমিক , লক আউট ও হয়েছে । সরকারের সেদিকে নজর নেই । সরকার শ্লোগান বানিয়েছে গ্রাম হবে শহর । গ্রাম থেকে সমস্ত মুলধণ জমা হচ্ছে শহরে । যার চোখ আছে সেই ই কেবল দেখতে পাচ্ছে , দেশের মেরুদন্ড হচ্ছে গ্রাম । তবু ও গ্রামে কিছুই নেই । গ্রামের কৃষি পন্য চলে আসছে শহরের বাজার ধরতে মধ্যসত্ত্বভোগীদের হাত ধরে । উল্টো দিনকে দিন কৃষক উৎপাদিত পণ্যের দাম না পেয়ে কৃষি কাজে উৎসাহ হারাচ্ছে । গ্রামের কুটির শিল্প গুলোকে তিলেতিলে হত্যা করা হয়েছে গত কয়েক দশকে । গ্রামীন বাংলাদেশকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কৃত্রিম এক অলীক অর্থনীতির দিকে । আগে শহর আর গ্রামে অর্থনৈতিক সমতা দরকার । যার জন্য দরকার কৃষি বিপ্লব । সরকার মেট্রোরেল বড় বড় সেতু আর মেগা প্রজেক্টের কথা শুনিয়ে যাচ্ছে , মাথাপিছু আয়ের গল্প শোনাচ্ছে , জিডিপির গল্প বলছে হরদম । পেটে ভাত না থাকলে এ সবই ওলটপালট লাগে এ কথা কি সরকারী লোকজন বোঝে না ? এইযে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হয়ে গেল , তাতে সরকার দল তো জায়গায় জায়গায় নাকালিচোবানি খাচ্ছে । এর কারন হলো শহরকে আধুনিকতার ছোঁয়া দিতে গিয়ে গ্রামের প্রতি যে বৈষম্য হচ্ছে তার জবাব ।
আকাশের রঙ পাঁশুটে । শীত বলেই বোধহয় আজকাল খুব ধূলো ওড়ে , শুকনো হাওয়া বইছে । ফাঁকা বারান্দায় গ্রিলে বসে কয়েকটা চড়ুই ঝগড়া করছে । আমাদের শোবার ঘরটা নির্জন , একটেরে । ওই ঘর নির্জনতা অহনা ছাড়া একাকীত্বে ভুগছে ?? মাঝে মাঝে দুপুরটা আমার একই রকম কাটে । শূন্য ঘরে , শুয়ে বসে । তখন আমি নিজের সাথে কথা বলি , হিসেব কষি । অহনা লাঞ্চে আসে , খেয়ে দেয়ে আবার চলে যায় । দুপুরে ঘুমিয়ে ছিলাম । ঠিক ঘুম নয় আধো ঘুম আধো জাগরণ । বাইরে কোথাও একটা শব্দ হলো । সেই শব্দেই ঘুম ভেঙ্গে গেল । গলা ভিজে গেছে ঘামে । চোখ খুলতেই টিভিতে নজর , চালু রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । সেখানেই শব্দ হয়েছিল । সেই শব্দেই ঘুম ভেঙ্গে গেল । ইউটিউবে নিজ থেকেই একটা ভৌতিক ছবি চলছে । আমার কোন কালেই ভূততুটে বিশ্বাস নেই । তবে দু’হাজার চার সালের দিকে আমার সাথে আমার জীবনের সবচেয়ে আনললভড মিস্ট্রি ঘটে গিয়েছিল । যার ব্যাখা আমার কাছে নেই । বিজ্ঞান , নিজের চিকিৎসাবিজ্ঞান সব মিলিয়ে দেখেও আজো তার হিসেব মেলানো তো দুর তার ধারে কাছে ও যেতে পারিনি ।সময়টা দু’হাজার চার সাল।তখন আমার পোস্টিং মুম্বাইয়ের সাইন ইস্টের লোকমান্য তিলক মিউনিসিপ্যাল মেডিকেল কলেজ ও সাইন হাসপাতালে। দেশে এসছিলাম ষোল দিনের ছুটিতে। ছুটি শেষ হলো চলে এলাম। কলকাতায় আসার আগেই মুম্নাইয়ের গীতাঞ্জলী এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকেট কেটে রেখেছিলাম। যাবার সময়ই। কলকাতায় এসে পৌছুতে দশটা বেজে যায়। মির্জা গালিব স্ট্রিট থেকেসোজা ট্যাক্সী নিয়ে ছুটলাম হাওড়ার পথে। সকাল আট টা থেকেই প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে কলকাতায়। বেশীর ভাগ সড়কেই হাঁটুর উপর জল। জল বাড়ার আগেই হাওড়ায় পৌছা দরকার। ড্রাইভার কে তাই কেবল তাগাদা দিচ্ছিলাম দ্রুত যাবার জন্য।
শিখ ভদ্রলোক আমাকে আপ ফিকার মাত কিজিয়ে, হাম জলদীহি পৌছ যায়েঙ্গে সাবজী, বার বার ই আশ্বস্ত করছেন আমায়। আমি বললাম লেকিন ইতনা বারিশ হো রাহা হে , রাস্তে মে ইতনা পানি বাড় রাহা হে আগার ফাস যায়েঙ্গে তো লাফড়া হো যায়েগা।
-নেহী সাবজী, ফিকার না কর আপ।
ট্যাক্সী থেকে নেমে অার্ধেক কাক ভেজা হয়ে কোন রকম দৌড়ে গিয়ে স্টেশনে ঢুকলাম।
আটাশ নাম্বার প্লাটফর্ম এ গীতাঞ্জলী এক্সপ্রেস থাকার কথা। আমি দ্রুত পায়ে সেদিকেই এগুচ্ছিলাম। আশ্চর্য এনাউন্চমেন্ট হচ্ছেনা কেন ট্রেনের কথা। একদম চুপচাপ। প্রতিক্ষনে ভিড় বাড়ছে।আমি আটাশ নাম্বার প্লাটফর্মে গিয়ে দেখি মুম্বাই গামী গীতাঞ্জলী প্লাটফর্মে আসেই নি। সব যাত্রীরা উদ্বিগ্ন হয়ে ইতি উতি দেখছে। আমি গিয়ে চা স্টলে ঢুকলাম। চা খাওয়া দরকার।বৃষ্টি থামার কোন লক্ষনই দেখা যাচ্ছে না। জলের মাত্রা বেড়েই চলেছে কেবল। সিডিউল বোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। গীতাঞ্জলী ছাড়বে দেখাচ্ছে বিকাল সাড়ে পাঁচটায়। বিরক্তি ধরে গেল। এতক্ষন এ স্টেশনে বসে বসে তো পাগল হয়ে যাব। প্রায় সকল ট্রেনই সিডিউল বিপর্যয়। চেন্নাই, দিল্লী, জয়পুর সব জায়গার, সব ট্রেন।যাত্রীদের চাপে প্লাটফর্মে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। আমি কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে হাঁটা দিলাম একটু ফাঁকা জায়গার সন্ধানে। মাইকে ঘন ঘন ঘোষনা দিচ্ছে ট্রেনের পরবর্তী সময়সূচী। ততক্ষনে টেক্সীস্টান্ড ও এক্সিট ওয়েতে ভীষন ভীড় শুরু হলো আমি দুরে দাঁড়িয়ে সেটাই দেখছি আর একটু স্বস্তি ও বোধ করছি কারন ভিড় কমছে। মানুষের দূর্ভোগের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৃষ্টির মাত্রা ও।
আমি প্লাটফর্ম ধরে সামনের বেঞ্চগুলো খালি পড়ে আছে। একটু বসা যাক। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা দুটো টন টন করছে।একটু দূরে একটা ফাঁকা বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম। চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসে আছি। সিগারেট খেতে মন চাইছে কিন্তু সিগারেট ধরালেই জরিমানা একহাজার টাকা। তাই ইচ্ছা টাকে দমন করে চোখ বুঁজে বসে রইলাম।কতক্ষন বসে ছিলাম জানি না। হঠাৎ নাকে কেমন যেন ফরেনসিক রুমে যেমন গন্ধ থাকে তেমন একটা গন্ধ পাচ্ছি। এখানে এই গন্ধ কোথা থেকে আসবে? আমি চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে নিলাম। আশে পাশে হঠাৎই যেন বেড়ে গেছে মাছির পরিমান। আমি বিরক্তির সাথে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। কিছুক্ষন পর মনে হল গন্ধটা আরো প্রকট হচ্ছে। বাতাস বইছে বৃষ্টির ছাট বাড়ছে ঝড় জলে এমন গন্ধ আসার কথা নয়। নাহ। আমি উঠে একটু স্টেশনের বাইরে যেতে চাইলাম। একটা সিগারেট না খেলেই নয় এবার।একটু কিছু খাওয়া ও দরকার। এতক্ষন পর ক্ষিধেটাও টের পাচ্ছি। আমি ডোসা খেলাম। চা খেলাম এক কাপ। সময় নিয়ে পর পর দু’বার সিগারেট খেলাম। শেষ সিগারেটের টুকরা টা ছুঁড়ে ফেলার সময় মনে হল কেউ একজন আমার দিকে খুব মায়া নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি আশে পাশে তাকালাম। দুর থেকে স্টেশনের ভেতরের দিক থেকে একজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
কিছু মানুষ আছে যাদের উপর চোখ পড়লে দৃষ্টি আটকে যায়। আমার দিকে যিনি তাকিয়ে আছেন তিনি সে রকম একজন। দুর থেকেও দেখতে পেলাম তার মুখটা তেলতেলে, চকচক করছে। মাথায় তেমন একটা চুল নেই খাবলা খাবলা চুল। মুখের তুলনায় চোখ অতিরিক্ত ছোট। দুর থেকে চোখের সাদা অংশ দেখা যাচ্ছে না। চোখের মনি ও চোখ পুরোটাই কালো। হঠাৎ দেখে মনে হচ্ছে লোকটার চোখ নেই।দৃষ্টি নামিয়ে সিগারেটের টুকরো ফেলে আবার তাকালাম কিন্তু সে লোকটাকে আর দেখা গেল না।
আমি আবার ও সেই বেঞ্চিটায় গিয়ে বসলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সেই লোকটা আমার পাশে এসে বসলো। লোকটার গা থেকে বাসি বাসি গন্ধ আসছে। কেমন টক টক গা গোলানো গন্ধ। আশে পাশে অনেক মাছি ভণভণ করছে।
-স্যার আপ ক্যাঁহা যায়েঙ্গে? লোকটার ঠোঁটটা একটু কেঁপে উঠলো। মনে হলো অন্য জগত থেকে আওয়াজ হলো।
-মুম্বাই।
-আপ ওহা পেঁ হি রেহতে হো ক্যায়া স্যর?
আমি মাথা নাড়লাম। লোকটার কালো চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো।
-মুম্বাইমে কাঁহা পর স্যার?
-গোরেগাঁও ওয়েস্ট। লেকিন কিঁউ।
-নেহি সাব মে ভী মুম্বাই কা সাব। মি মুম্বাইকর সাব।
-আপ ভী মুম্বাই যাও গে কেয়া?
-নেহী সাবজী ইজাজত নেহী হ্যয়।
-তো ফির স্টেশন মে কিঁউ?
-স্যার থোড়া মদদ করেঙ্গে মেরা?
-ক্যায়া মদদ চাহিয়ে আপকো? আমি পালটা প্রশ্ন করলাম।
-স্যর মেরা ঘর যোগেশ্বরী ইস্ট মে। স্টেশন কে বাহার যো তবেলা (মোষের খামার) হ্যয় উসকি বাজু মে সাঁই ধাম মেরা ঘর হ্যয় স্যার। আপ কৃপিয়া করকে মেরা ইয়ে ব্যাগ ওর থোড়া পেয়সা মেরা ঘরমে পৌছা দেঙ্গে? সাব বহুত মেহেরবানি হোগী।
-ব্যাগ মে কেয়া হ্যয়।
-স্যার মেরা আঁই (মা) কে লিয়ে বাঙ্গাল কি শাড়ী অর বেহেন কি লিয়ে চুড়িদার। অর ইয়ে লে জিয়ে দেখ লি জিয়ে।
-ও কে ঠিক হ্যায়।
আমি ওর শপিং ব্যাগ আমার ব্যাগে রাখলাম। এবার লোকটা হাত বাঁড়িয়ে আমাকে টাকা দিয়ে বললো, স্যার ইহাঁ পেঁ তেরাশো রুপিয়া হ্যা, ইয়ে পেয়সা মেরা মা কি হাত মে দে দে না সাব।
-আরে ইয়ার বাতো বাতো মে তুমহারা নাম পুচনা ভূল গেয়া ইয়ার।
-সূরেশ কারকারে।
আমি ওকে বললাম আচ্ছা সূরেশ মুঝে ইতনা ভরসা কিঁউ কর রাহে হো।
ও একটা সরল হাসি হাসলো, বিড়বিড়িয়ে বললো আপ আচ্ছা আদমী হো সাব।
লোকটা বিদায় নিয়ে চলে গেল।বেশ কিছু দিন পার হয়ে গেল। আমি ভূলেই গিয়েছিলাম। হাসপাতাল থেকে ফিরে একটু ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুমের মধ্যেই স্বপ্নে সূরেশ কে দেখলাম। খুব মিনতি করছে।আমি ধড়মড়িয়ে উঠলাম।
আমি বিছানায় ধড়মড়িয়ে উঠে ভাবতে লাগলাম, সুরেশের মা কে তার পাঠানো জিনিস গুলো দিয়ে আসা হলো না। আমি সাথে সাথে ফোন করলাম আমার বন্ধু ডা.জেফি সিং কে। জেফির বাসা বরিওলি ওয়েস্ট। মাঝখানে দুটো স্টেশন। কান্ধিওলী আর মালাড। জেফি বললো ওর আসতে ঘন্টা খানেক লাগবে। ইর্মাজেন্সী কিছু কিনা জিজ্ঞেস করলো। আমি বললাম, এমন কিছু নয় আগে তুই আয়।
আমি উঠে বাথরুমে গেলাম। টোস্টারে ব্রেড দিয়ে অমলেট করলাম। কফি চড়িয়ে আলমিরা থেকে সুরেশের ব্যাগটা বের করলাম। শাড়ী চুড়িদার, টাকা সবই ঠিকঠাক মতো আছে। আমি ওটা বিছানায় রাখলাম।নাস্তা সেরে, কফির মগ হাতে ব্যলকনিতে গিয়ে বসলাম। সিগারেট শেষ করার আগেই জেফি এলো।
-ক্যায়া হুয়া ইতনী ইমার্জেন্সী? ক্যায়া বাত হে? তু বহুত পেরেশান দিখরায়?
গড়গড়িয়ে প্রশ্ন গুলো করে গেল জেফি। নিউরোলজি রেসিডেন্স জেফি। একরোখা স্বভাব ওর। হারিয়ানা তে ওদের বাড়ী। আমি গিয়েছি দু’ তিন বার।আমি যথা সম্ভব অল্প ভাষায় জেফি কে ঘটনা টা বললাম ও বলল কই বাত নেহি হাম আজি পৌছা দেঙ্গে। ইতনা পেরেশান হোনে কি কই বাত নেহি। চল্ ইয়ার নিকাল তে হে।
জেফির গাড়ীতে করে যোগেশ্বরীর উদ্দেশ্যে ছুটলাম দুই বন্ধু। সূরেশের বাসার ঠিকানায় পৌছে গেলাম পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই। খুঁজে পেতে কষ্ট হলো না সাঁই ধাম। চার তলা এ্যাপার্টমেন্ট টাইপের বাড়ী। সমস্যা হলো কয়তলায় বাসা সেটাই তো বলেনি সুরেশ। জেফি তর তর করে উঠে গেল, আবার কিছুক্ষনের মধ্যেই নেমে এলো।
-চল ইয়ার মিল গেয়া। থার্ড ফ্লোর।
আমি ব্যাগটা হাতে নিয়ে উঠতে লাগলাম। কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল বুড়া এক লোক। আমাদের বসতে বলার ইঙ্গিত দিয়ে ভেতরে চলে গেল।
ঘরটা একটু অন্ধকার তবে ঘরের বাতি নেভানো। ঘরে টিভি চলছে। টিভির নীল আলোতে ঘরটা আলোকিত। তবে সে আলো উঠা নামা করছে।
কিছুক্ষনের মধ্যেই রুমে আলো জ্বলে উঠলো। এক তরুনী এসে দাঁড়ালো সাথে বৃদ্ধা আর সেই বুড়ো।
-আপলোগ কিসকে পাস আয়ে হো?
-জ্বি সুরেশ আপ কা ল্যাড়কা হ্যয়?
-হাঁ জি।
-জ্বি সুরেশ মুঝে ইয়ে পার্সেল দিয়া হ্যয় কলকাতা মে আপকো পৌছানে কি লিয়ে।
আমার এই কথা শোনার পর মনে হলো পুরো ঘরের মানুষ চমকে উঠল। মনে হল এর থেকে আজগুবি কথা বুঝি আর কিছু হতে পারে না।
-কিঁউ মজাক করতে হো ব্যাটা? ইয়ে ক্যায়সে হো সাকতে হ্যা।
-নেহী আন্টি উসনে মুঝে ইয়ে প্যকেট অর থোড়া পেয়সা দিয়া হ্য আপকো দেনে কি লিয়ে, ইয়ে দেখিয়ে। আমি প্যাকেট টা আর টাকা বাড়িয়ে দিলাম।ভদ্রমহিলা প্যাকেট টা হাতে নিয়ে দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। কিন্তু মেয়েটা আর বুড়ো লোকটি নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলো।নিরবতা ভেঙ্গে মেয়েটি যা বললো তার মানে দাঁড়ায় সূরেশ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ছিল। তার পোস্টিং ছিল কলকাতায়। ছয়মাস আগে সে ইলেকট্রিক শকে মারা যায়।আমার মনে হলো আমার পায়ের নিচ থেকে জমিন সরে যাচ্ছিল।
-হ্য তবে মারা যাবার আগে সুরেশ এই জিনিস গুলো বাড়ীতে পাঠাতে চেয়েছিল।
আমি কিভাবে ওখান থেকে কিভাবে নেমে এলাম, কিভাবে জেফি আমায় বাসায় পৌছে দিয়েছিল আমার মনে নেই। তবে আজো আমি কোন হিসেব মিলাতে পারি নি।
ডিকশনারীতে আত্মাকে বলা হচ্ছে, মানুষের শুদ্ধতম অংশ। যা মানুষের মৃত্যুর পর ও অবিনাশী। কিন্তু মৃত্যুর ছয়মাস পর তার অবিকল শরীর এটা কি করে সম্ভব?
আজো মিলেনি আমার সে হিসেব। এটা আমার জীবনের সমাধান করতে না পারা সবচেয়ে বড় রহস্য।
একটা উড়োজাহাজ উড়ে যাওয়ার শব্দ হচ্ছে । বন্ধ দরজা খুলে আমি ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াই । শীত-হাওয়া এসে লাগে । বাইরে কুয়াশা , সে কুয়াশায় চেয়ে আছি আমি । উড়োজাহাজ উড়ে যাচ্ছে , দুর থেকে দুরে । শব্দ তুলে । আবার ঘরের মধ্যে ফিরে আসি । কি করব ভেবে পাচ্ছি না । চেম্বারের জন্য বের হব ঘন্টা খানেকের মধ্যেই । এক সময় নিজেকে তৃপ্ত এবং কামনা বাসনা রহিত মানুষ মনে হতো । আমি জানি ঠিক তা নয় । খুব কাজ করা দরকার । খুব ব্যস্ত থাকা দরকার । নইলে শরীরে মেদ নামবে । একটু চর্বি বসেছে ঠিকই । উনুনের ওপর এক হাঁড়ি জল চাপালাম, গোসল করব । পাশে কফির জন্য জল । গোসলের শেষে অহনার গাল , কানের লতি , চিবুক আর নাকের আগা লাল হয়ে যায় । আমার হয় কিনা আমি জানি না । আয়নায় তেমন বোঝা যায় না । অহনার চোখে মুখে এখনো সংসারের ছাপ পড়েনি । ওর চোখে তাকালে মনে হয় এখনো স্বপ্নের বাসা । ঢাকা শহরের মানুষের মধ্যে তেমন কোন কৌতুহল নেই । কিন্তু অহনার চোখ এখনো সজীব উদ্ভিদের মতো , জীবনীশক্তির মতো এক আগ্রহ রয়ে গেছে । আমার মতো মানুষের সম্পর্কে এখনো ওর ক্লান্তি আসেনি । বাইরে ফিকে অন্ধকার , বাতাসে হিম , অল্প কুয়াশার আস্তরণ । জানালার বাইরে আলোজ্বলা ঢাকার আকাশ আবছা দেখাচ্ছে । সিগারেট টা বিস্বাদ লাগছে , ঠোঁটটা জ্বালা করছে ।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট