পর্ব-৫৫
শাল গায়ে জড়িয়ে চোখ রেখেছি জানালায় । কাঁচের ওপারে কুয়াশাচ্ছন্ন দিন । ঘরবাড়ি , মাঠ ঘাট সবই কেমন আবছা । কাচের ভিতর দিয়ে সকালটাকে কী ভীষণ ম্রিয়মাণ লাগছে । আকাশটাকে মনে হয় মেঘলা মেঘলা । সওয়া দশটা বাজে । প্রচন্ড কফি খেতে মন চাইছে । জানালার পাশ থেকে সরে গিয়ে আবার চোখ রাখি পুরু কাঁচে । মোটা কাচে ভেসে উঠছে আমারই প্রতিবিম্ব । ঝাপসা ঝাপসা । বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আসছে । কেমন যেন একটা দম বন্ধ ভাব । উঠে বাথরুমে গেলাম । বেরিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম । আরাম লাগছে । শ্বাস নিলাম জোরে জোরে । বুকের চাপ ভাবটা ফির আসছে । নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে । কেউ যেন চেপে ধরেছে নাক । নাকি এ আমার মনের ভুল ! দুরে কথাও শাহ্ আবদুল করিমের -আমার মাটির পিঞ্জিরায় সোনার ময়নারে / তোমারে পুষিলাম কত আদরে , গান বাজছে । কান পেতে শুনতে চেষ্টা করলাম । হাওর পাড়ের একটা মানুষ কী অসাধারণ সব গান লিখে গেছেন । মানুষের মন এক আজব জিনিস । কখন যে কোনদিকে ছুটে যায় বলা মুশকিল । আজকাল টের পাচ্ছি একটা হালকা বিষন্নতা যেন আমাকে জড়িয়ে আছে দিনভর । হেমন্তের বিকালের কুয়াশার মতো । অথচ আমার কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা নয় । যা যা আঁকড়ে একজন মাঝবয়েসি মানুষের সুখ বোধ সঞ্চারিত হয় , সবই তো আমার করায়ত্ত । দায়িত্ববান স্ত্রী , সাজানো -গোছানো সংসার , রোজ তেম্বারে যাচ্ছি আসছি , কতটুকুই বা পরিশ্রম ? তবুও ইদানিং মনে ভীষণ রকমের এক ভালো না লাগা । যেন ভালো না লাগার এক কঠিন আবর্তে ঢুকে বসে আছি । সকাল বেলা বিছানা ছাড়তে ভালো লাগেনা যদিও বা ছাড়ি কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না । বিরক্তি বোধ । বাইরে বেরুতে ইচ্ছে করেনা । বরং বাইরে বেরুতে হবে স্মরণে এলেই বুক শ্রাবণের মেঘে ছেয়ে যায় । বিচিত্র এক অবসাদে কষটে মেরে থাকে মন । কী যে হলো আমার ? দুর অতীত , কৈশোরের কথা মনে পড়ে । গত কয়েকদিন ধরে শৈশব কৈশোরের বন্ধু গোলাম মোস্তফা সাফু পাহাড়ে যাবার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে । নদী পাহাড়ের হাতছানি এড়ানো দায় ।
মস্তিষ্কে জোর ঝাঁকুনি । হৃদয়ের আয়নায় এ কার প্রতিবিম্ব ? আমার দাদীর ? গ্রামের বাড়ীর উঠোনে রোদে মোড়া পেতে বসে আছে আমার টুকটুকে ফর্সা ছোটখাটো মানুষ আমার দাদী । সামনে সাদা উঠোনে দাদীর ছোট পায়ের ছাপ । আম্মা বলে আমার চেহারা নাকি হুবহু দাদীর মতো । পৃথিবীতে বোধ হয় সবচেয়ে বেশী আমাকে ভালো বাসতেন দাদী । নানার মৃত্যুর পর আমরা গ্রামের বাড়ী চলে এলাম । আমাদের গ্রামের বাড়ীর নতুন বাড়ী তৈরী হচ্ছে । বড় বড় জানালা দরজায় পাল্লা নেই , হু হু করে হাওয়া আসে । এ ঘর থেকে ও ঘর একা একা ঘুরে বেড়াই । কথা বলি একা একা । আমার ফুফাতো বোন রাহেলা আপার স্বামী সিলেটের মানুষ দুলাভাই আমাদের বাড়ীর কাজ করেন । তার সঙ্গে আমার টুকটাক কথা হয় । তার চোখে সুর্মা , পরনে লুঙ্গি , হাতা গুটানো ইংলিশ কাফের রঙিন শার্ট । ওই মানুষটা আর দাদীই কেবল এটা ওটা খেতে দেয় । মিস্ত্রিরা দুপুরে খেতে বসে । এক মিস্ত্রি রসুন-মরিচের ভর্তা ভাত লাল করে মাখে ।আমার লোভী চোখ চকচক করে । সন্তর্পণে মুখ ফিরিয়ে ঢোঁক গিলি । সাঁঝ বাতির পরই দাদী খাটের মশারি ফেলে দেয় । ঝিঁ ঝিঁ ডাকে । আঁচলের তলায় লুকানো বাটি নিয়ে আসেন জেঠি মা । আমি পশ্চিমের ড্যালায় দাঁড়িয়ে হাই তুলতে তুলতে কচু পাতায় পেচ্ছাব করি । পেছনে কুঁপি বাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন পাশের পাড়ার হালিমা ফুফু । ঠিক সে সময়ে গাঁয়ে কলোরার মহামারি হলো । দলে দলে লোক মরে যাচ্ছে ।আতঙ্কিত মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে শুনতাম লোকেদের হাহাকার । তখন আমার খেলার সাথী আমার জেঠাতো বোন কুসুম । তার চেহারা ছিল ফর্সা, গোলগাল , নির্বোধ সুন্দর মুখ ছিল তার । রান্নাঘরের চালে সিমেন্ট শীট লাগানোর জন্য মিস্ত্রি রাখা হলো । ওরা চালে বসে বিড়ি টানে , কি সুন্দর নীলচে ধোঁয়া বের হয় নাক মুখ দিয়ে তাদের । অপার্থিব তৃপ্তি দেখতাম তাদের মুখে । একদিন তাদেরই একজনের বিড়ির প্যাকেট থেকে বিড়ি চুরি করলাম । একদিন দুপুরে আম্মা ভাত ঘুম ঘুমাচ্ছেন । আমার পিঠাপিঠি ভাই লিটনকে বললাম , বিড়ি খাবি ?
লিটন ভাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে – কোথায় পাবি ? বললাম আমার কাছে আছে । আমাদের বাড়ীর পেছনের কুয়ার পশ্চিম পাশে খাড়া পাড়ের আড়ালে নেমে আমরা মুখোমুখি বসে দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে বিড়ি টানি । আর কাশতে লাগলাম । টানের সাথে সাথে কাশছি আর চোখের জলে অবলুপ্ত হয়ে গেল চারপাশ । পৃথিবী সরে যেতে লাগলো আমার চেতনা থেকে ।
আমাদের বাড়ীর পেছনের দিকে বিশাল এক আম গাছ । বিকালে সেখানে লাল সুর্য চোখ ধাঁধানো আলো ফেলত গাছগাছালিতে । মাঝে মাঝে টুপ করে গাছ থেকে ঝরে পড়ত টকটকে লাল আম । একদিন সে আম তুলতে গিয়ে পায়ের আঙ্গুলে জ্বালা অনুভব করলাম । চেয়ে দেখি সেখানে কামড়ে ধরে আছে সবুজ রঙা এক সাপ । গাছের পাতার সবটুকু রঙ যেন সে চুরি করে নিয়েছে । আমি চেঁচিয়ে উঠলাম । ছুটে এলো সবাই । বড় আপা , বড় ভাই , আম্মা , হালিমা ফুফু , জেঠিমা সবাই । সাপ সাপ বলে আমি চেঁচাচ্ছি , কাঁদছি । সবুজ রঙের সেই সাপ তার দীর্ঘ শরীরের রঙ কিলবিল করে মেখে নিচ্ছে আমার পায়ে । সাপের দাঁতের দাগের জায়গা থেকে রক্ত ঝরছে । হাঁটুর ওপর পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধা হলো । পাশের গ্রাম থেকে ওঝা ডেকে আনা হলো । শুনেছিলাম সাপের কামড়ে লোক বাঁচে না । কিন্তু হঠাৎ কেবল মনে হল , এবার যদি বেঁচে যাই তবে আমি অনেকদিন বাঁচব । বড় হয়ে আব্বার মতো কোট টাই পড়বো । সে বার বেঁচে গিয়েছিলাম । আমার কিছুই হয়নি । সে ঘটনার পর থেকে আমার একা একা ঘুরাঘুরিতে নিষেধাজ্ঞা এলো , আর সবচেয়ে ভালো কাজ যেটা হলো পেছনের জংলা কেটে সাফসুতরো করা হলো । আমি বিকালে পশ্চিমের জানালায় দাঁড়িয়ে কুয়োর জলে রোদের সোনালী আভার গড়াগড়ি দেখতাম আর আমার ছোট উদাস মন রুপকথার জগতে ভেসে বেড়াত । আমাদের ভর্তি করানো হলো গাঁয়ের স্কুলে । সন্ধ্যায় আমরা পড়তে যেতাম স্কুলের হেডমাস্টারমশায় হানিফ স্যারের কাছে । রাতে স্যারের কাছ থেকে ছুটি পেয়ে স্কুল মাঠে ফুটফুটে জোস্নায় নেমে দেখতাম , ঘাসে শিশির পড়ে সে জোস্নায় মুক্তোর মতো জ্বলছে । সেই জোস্নায় স্কুল মাঠের সামনের ওপারে বটতলায় ছোট ঘর বানিয়ে সংসার পাতে একদল বেদে । সেই জোস্নায় তাদের চুলায় রান্না হয় আলু ছোট মাছের চচ্ছরি , ধনেপাতা ছড়ানো সে রান্নার গন্ধে আমার খুব ক্ষিধা লাগতো । ছুটি পেয়ে আমরা স্কুল মাঠের জোস্নায় হল্লা করতাম । হারিকেন হাতে আমাদের নিতে আসত জেঠাতো ভাই রিয়াজুল , এগিয়ে দিয়ে যেত মাদ্রাসার কোণা অব্দি । অনেক সময় হঠাৎ হঠাৎ মাথা গরম হয়ে যাওয়া আকতারুজ্জামান ঠ্যাটার বাড়ীর পাশ দিয়ে যেতে লাগলে তিনি আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠতেন কে! কে রে ! আমরা দুড়দাড় করে পালাতাম ।
সে সময় আমাদের সবচেয়ে আনন্দের জায়গা ছিল খালার বাড়ী “ বড় সাঙ্গিশ্বর “ । খালার বাড়ীর উঠোন জুড়ে কুলের গাছ । বড় বড় মিষ্টি কুলে ভরে থাকত সে গাছ । শীতে আম্মা নাইওর যেতেন সেখানে । সমবয়সী মামাতো খালাতো ভাই বোন ,মামা আর খালাদের লম্বা কাতার ছিল । একটু ফর্সা আর রোগা ছিলাম বলেই মামা খালারা একটু বেশীই আদর করতো । সে গাঁয়ে রাসেল মামা , হেমায়েত মামা , হোসেন মামা , রাসেল মামার বোন আমার সুমা খালা , হোসেন মামার বোন আমার শিল্পি খালা আমার পেছন ঘুরে ঘুরে আমায় আব্বা ডাকত । সে বয়সে খুব লজ্জা লাগত ওদের আব্বা ডাক শুনে । ছিলো নয়ন মামা , সয়ন মামা । ছিলো হেদায়াত নানা , বাশার নানা , মতি নানা যারা খুব আদর করতেন । মামা খালারা কার কাছে আমাকে রাখবে সে নিয়ে কাড়াকাড়ি করতো । আর ছিলে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসা নজরুল ভাই এবং মানু ভাই । বিশাল নানাবাড়ীর ভেতরেই তেরটার মতো পুকুর ছিল । আমরা গেলে সমস্ত পুকুরে জাল ফেলা হতো । খালা , আতিক মামা , মনোয়ারা খালা আর ফয়জুল্লা মামাদের বিশাল উঠোনে সে মাছ ভাগ হতো । সকাল থেকে লোক আসত । রিকশা , গরুরগাড়ী এসে থামতো মসজিদের পাশের পুকুর পাড়ে । আমি নিস্পৃহ চোখে চেয়ে দেখতাম । সমাগত আত্মীয়দের কেউ বা কাছে ডেকে বলতো তুমি বুঝি লতিফা বুবুর ছেলে ! বড় রোগা হয়েছ দেখছি ! কোন ক্লাশে পড়ো ? ভাসা ভাসা উত্তর দিয়ে রাসেল মামা আর হোসেন মামার হাত ধরে সরে আসি । খালাতো বোন শেফালি আপার কাছে আমি সাত রাজার ধন । সারাক্ষণ আগলে রাখেন । শেফালি আপা কোলে করে ছোটেন ছাড়াবাড়ির পুকুর পাড়ে জোড়া তালগাছ তলায় । পাশে সব্জী চাষ করতেন খালু । হরেক রকম সব্জী । তালগাছ তলায় শেফালী আপা আমায় নিয়ে বসেন । দুপুরের রোদ গায়ে এসে পড়ে , বাতাসে দোলে তালগাছের ডগায় ঝোলা বাবুই পাখির বাসা , তারা কিচির মিচির ডাকে । ফড়িং লাফিয়ে কাছে আসে , আবার দুরে যায় । বাতাসে ধনে ফুলের গন্ধ ভেসে বেড়ায় । যখন বেলা গড়ায় শেফালী আপা তার দলবল নিয়ে দাঁড়িয়াবান্ধা , বৌচি আর কাঁনামাছি খেলে আমি বসে বসে নিস্পৃহ চোখে দেখি । খালাদের উঠোনের পুব কোনে স্তুপ করে রাখা খড়ের গাদায় বসে সবার ছুটোছুটি দেখি । পশ্চিমের পগার পাড়ে একটি নিঃশব্দ অগ্নিগোলক ডুবে গিয়ে অসীমের দিকে চলে যেতে থাকে । ক্রমে সন্ধ্যা আসে , আসে রাত্রি । তখন নজরুল ভাই হ্যারিকেন হাতে পড়তে যেতো রুমা খালাদের বাসায় । আর তখন খালু সারাদিনের কাজ সেরে গোসন সেরে , ভেজা লুঙ্গি ছড়াতে ছড়াতে আমাকে দেখেন আর বলেন আমার আব্বা কি খাবে আজ ? আমি লজ্জায় চোখ নামাই ।
সবে সন্ধ্যে নেমেছে শহরে । আলোর সাজে সেজে উঠল রাস্তা ঘাট । আজ রাস্তাঘাট বড় বেশী নির্জন । ফাঁকা ফাঁকা ছুটির দিন বলেই হয়তো । একটু বেলা করেই আজ ঘুম থেকে উঠেছি আমি আর অহনা । অন্য দিন সাতটা না বাজতেই বেচারীকে বিছানা ছাড়তে হয় । ঝটপট তৈরী হয়ে ছোটো অফিস পানে । ছুটির দিন একটু গড়ানোর সুযোগ পায় বেচারী । গুব গুব কফির জল ফুটছে । দু’কাপ করে বেড রুমে এসে দেখি অহনা বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে । ওঠো , উঠে কফি খাও ফ্রেস লাগবে । অহনা আস্তে করে নিশ্বাস ছাড়ে । ব্যালকনির দরজা খুলতেই মনোরম এক বাতাস ছড়াচ্ছে । বাতাসের ঝাপটায় অহনা একটু কেঁপে উঠল বুঝি । অহনা উঠে বাথরুমে গেল । জলের ঝাপটা দিচ্ছে মুখে । দেয়ালের আয়নায় অহনার জলধোয়া মুখ । তীক্ষ্ন চোখে আমি তাকিয়ে আছি সেদিকে । আজ পৌষের শেষ দিন । আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ । একটা মলিন রোদ বিছিয়ে আছে শহরের গায়ে । বাতাসে শিরশিরে ভাব । চমৎকার একটা ছন্দে গড়াচ্ছে আজকের দিন টা । হঠাৎই মাথায় বিদ্যুতের ঝিলিক । অহনা চলো , বাইরে খেতে যাই তারপর তোমায় মোটরবাইকে বসিয়ে ঘুরব । কোথায় ঘুরব ? রঙিন প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে দেখি কোথায় যাওয়া যায় ? বাইরে আজ জব্বর ঠান্ডা । শুরুতে এবার শীত তেমন ছিল না । নতুন বছর পড়ার পর ঝুপ করে নেমে গেছে তাপমাত্রা । উত্তুরে হাওয়াও আজ যথেষ্ট প্রবল । এদিকটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা , বাতাস ও তাই বুঝি হাড় কাঁপানো । আঁকাবাঁকা পর ধরে ছুটছি আমরা রুপগঞ্জের গাজী সেতুর দিকে । অহনার চোখে বিস্ময় ! কখনো এদিকে আসেনি অহনা । সোয়েটারের ওপর শাল জড়িয়েছে তবু ওর কাঁপুনি টের পাচ্ছি । গাজী সেতুতে পৌছতে চারটা বেজে গেল । ভেবেছিলাম একটু আগে পৌছাবো কিন্তু রাস্তায় যানজটে সময় লেগে গেল । সেতুর গোড়ায় আগে একখানা খাপরার ঘর ছিল এখন সারি সারি দোকান । লোক জন প্রচুর আসে বোধ হয় । আমি সেতুতে উঠেই যুতসই একটা জায়গায় দাঁড়ালাম । অনেকক্ষণ পর ফুসফুস নিকোটিনের অভাব অনুভব করছে । অহনা অপরুপ শীতলক্ষ্যার ছবি তুলছে । নীচে ভেসে যাচ্ছে নৌকা , ট্রলার , কার্গো ।
তুলাদন্ডের দু’ প্রান্তের ভার কখনও সমান হয় না , কোন ও না কোন ও দিকে সে হেলবেই । এই যে আমার তুলাদন্ড গত দু’ মাস ধরে কেবল অভাবের দিকেই হেলে আছে । তাতে আমার অত দুঃখ নেই । কখনো জীবন কি সমান্তরাল চলে কারো ? চড়াই উৎরাই ই তো জীবন । তাই নিয়ে কপাল চাপড়ালে মনোকষ্টই বাড়ে শুধু । জীবনের অজস্র জটিলতা তো আমাকে ঢের দুঃখ দিয়েছে , নতুন করে বেদনা বাড়িয়ে কী লাভ ! শুধু দেয়া নেয়া আর টাকাপয়সার সম্পর্ক গুলো আজকাল এড়িয়ে চলতে চাইছি ।
একখানা সিগারেট উড়িয়ে টিভি দেখতে বসেছি । তেমন কিছুই দেখার নেই । নারায়ণগঞ্জে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন চলছে । কেমন নির্বাচন হচ্ছে তা দেখতে বসা । আজকাল তো যাচ্ছেতাই নির্বাচন হচ্ছে , রাতেই ভোটের বাক্স ভরিয়ে ফেলা হচ্ছে । প্রশাসন ভোটের ফল পাল্টে দিচ্ছে । জনমতের কোন বালাই নেই । লম্বা ভোটের কাতার তবে ভোট গ্রহণ হচ্ছে ধীরগতিতে । এ চ্যানেল ওই চ্যানেল দেখছি । কী করে যে ঘন্টাখানেক কেটে গেল ,টেরই পেলাম না । চোখে এবার চাপ পড়ছে , মাথাও চিনচিন । বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম । বাইরেটা পশ্চিম , অনেকটা দুর অবধি খোলা । তার অদুরে আবার অট্রালিকা । একসঙ্গে অনেকগুলো । আধো তন্দ্রায় অহনার ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম মনে হল । বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না । মাঘ মাস শুরু হয়েছে । এখন ভালোই ঠান্ডা পড়ে । চোখ খুলে ঘড়ির দিকে তাকাতেই আমার চোখ ছানাবড় , একি ! পৌনে ছয়টা বাজে । চেম্বারে যেতে হবে । অনিচ্ছা সত্ত্বেও কম্বল সরিয়ে উঠতে হলো । আঁধার নেমে গেছে অনেকক্ষণ । সরকার নাকি এবছর বইমেলায় করোনার চুতোয় বাধসাধছে । কী আজব দেশ মাইরি ! বানিজ্য মেলায় লোক কিলবিল করছে সেটা বন্ধ করার কোন চিন্তা নেই কিন্তু বই মেলা বন্ধ করতে হবে । এমনিতে এদেশের শিল্প-সাহিত্যের যে সর্বনাশ হয়েছে গত কয়েক বছরে এখন কেবল শেষ পেরেক মারা বাকি । এখনকার বাচ্ছা কাচ্ছাদের জ্ঞানপিপাসার ও বালিহারি যাই । তাদের চোখে তো ফেভিকলের মতো সেঁটে আছে মোবাইল । আগামী দশকে ঘাঁড় সোজা কোন লোক বোধহয় পাওয়া যাবে না । মানুষের কোন বিকার নাই , বই মেলা বন্ধ হবার সংবাদে । বিকার থাকবে কিভাবে ? যে জাতি পাঁচশো টাকার গাড়ী ভাড়া দিয়ে বানিজ্য মেলায় গিয়ে তিরিশ টাকার প্লাস্টিকের বাটি কিনে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে সে জাতির কাছে বইমেলা মানে তো কাগজের গাদা ছাড়া আর কোন কিছুই মনে হবার কথা নয় । এই ধরনের সংস্কৃতি ধ্বংশ করা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেয়া লোকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হওয়া দরকার ।
ক্ষমতাগর্বী কিংবা হিংসুটে মানুষদের চিরকালই আমার চরম অপছন্দ । হিপোক্রেসি করা মানুষ আরো বেশী অপছন্দ আমার । মানুষের বুদ্ধিভ্রংশ না হলে এমন সিদ্ধান্ত মানুষ নেয় কি করে ? হাসপাতালের পাশের গলিতে দাঁড়িয়ে চা সিগারেট খাচ্ছি । পাশে দুই ভদ্রলোক তারস্বরে তর্ক জুড়ে দিয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে সরকারী দলের গো – হারা নিয়ে । একজন দারুন উল্লসিত , অন্যজন চটে আছেন বেজায় । আমি অবাক হয়ে দু’ জনের বাকযুদ্ধ শুনছি । রাজনীতি নিয়ে এরা কেবল অলিগলি চায়ের দোকানেই কচকচ করে , এতেই এদের সুখ । বাসায় গিয়ে দেরী করে ফেরার জন্য গিন্নির খিস্তি শুনে এরাই বেড়ালের মত মিঁউ মিঁউ করে ।
অন্যায়ের প্রতিবাদ হওয়া উচিত । বিবেক অনুযায়ী কালচারাল ফিল্ডের সকলের প্রতিবাদ করা উচিত । আমার তো মনে হয় লেখক , শিল্পী , কালচারাল এক্টিভিস্ট শুড বি অলওয়েজ ইন দ্যা সাইড অফ প্রোটেস্ট এগেনস্ট এনি ফর্ম অব ইনজাস্টিস ।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট