পর্ব-৫৬
একা থাকলেই মনে পড়ে জীবনের টুকরো টুকরো গল্প । লড়াই – সংগ্রাম – অভাব অনটনের উপাখ্যান । ছিঁড়ে যাওয়া সম্পর্ক ভেসে গিয়ে ডুবতে ডুবতে কূলে ভেড়ার কাহিনী। একটা বনেদি মানুষের দরিদ্র হয়ে গিয়েও ফের মাথা তুলে দাঁড়ানোর গল্প , সব মিলিয়ে যেন একটা আস্ত উপন্যাস । পর্বে পর্বে রোমাঞ্চ । গলার কাছে কোত্থেকে একটা ডেলা জমাট বাঁধছে । গত কয়েকদিন ধরে বাল্যবন্ধুরা একে একে জড়ো হচ্ছে । ওদের সাথে কথা বলতে বলতে যেন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম । আচমকা স্নায়ু টান । প্রথমটায় অনেক কে প্লেস করতে পারছিনা তবে ছবি দেখলেন ভেসে উঠছে ছোট বেলার স্মৃতি । হৃদয়ের চকিত উত্তেজনা দমন করতে পারছি না । বহু বছর বাদে দেখছি ওদের । দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার শেষে সিগাল পাখিকে দেখলে নাবিকের যেমন অনুভূতি হয় তেমনই অনুভূতি আমার । বেশ ক’বছর আগে একজন তো এসে চারখার করে দিয়ে গেল আমার সাজানো বাগান । পুরনো জ্বালা হঠাৎই ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো আঘাত করে মস্তিষ্কে । একটা জংলি রাগ ফুঁসে উঠতে চায় । কিন্তু ডাক্তার রিপন কে কি ওসব মানায় ? চোখ বুজলেই স্মৃতির মিছিল । যতই ঝাঁপ ফেলতে চাই মনের দরজায় ততই হু হু করে ছিদ্র পথে ঢুকে পড়ে স্মৃতি গুলো । একটা গরম বাতাস আলগা ভাবে বয়ে গেল বুকের ভেতর দিয়ে । জীবনে লাভ ক্ষতির হিসেব বড়ই জটিল । অবিমিশ্র ক্ষতি কেউই কারো করতে পারে না । তার পর আমার জীবনের গতিপথই তো বদলে গেছে । অহনা আমার জীবনে এসেছে আর্শীবাদ হয়ে । যে আমার ক্ষতি করতে চেয়েছে সে আমার জীবনের একটা পুরনো চ্যাপ্টার মাত্র । প্রায় রোজ রাতেই আমাদের ভিডিও কলে কথা হচ্ছে । সাফু , আরিফ , তাহের , বাশার , হান্নান , জয়ন্ত , বাকী , মফিজ , বশির , শ্যামল ঘন্টার পর ঘন্টা কথা হচ্ছে । রাত্রি একটা , দুটো বেজে যাচ্ছে টেরই পাচ্ছি না ।
ঠিক হলো চার তারিখ দেখা হচ্ছে সবার । অহনা প্রথমে নিমরাজি থাকলেও এখন ব্যাগ গোছাচ্ছে । তিন তারিখ সকাল সাতটায় বাসা থেকে বের হয়েছি । সবে সকাল হয়েছে শহরে । বৃহ্স্পতিবারের সকাল । লোক অফিসের জন্য ছুটছে । মুল রাস্তায় একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে , তার জানালায় ভাবলেশহীন মুখে বাইরে তাকিয়ে আছে একটা বৃদ্ধ । আমার মোটর সাইকেল পাশ কাটতেই আমার দিকে তাকাল । শহর পার হতেই ঢাকা চট্রগ্রাম হাইওয়ে ধরে এগুচ্ছি । মোটর সাইকেলের স্পিড কাঁটা সত্তরের ঘরে । একটা ছোট ব্রিজ টপকে গেলাম । লাঙ্গলবন্দ মনে হয় জায়গাটার নাম । আজ একদম জ্যাম নেই । স্বপ্ন স্বপ্ন বাতাস খেলে বেড়াচ্ছে । মেঘনা গোমতী সেতু পার হচ্ছি । এ সেতু পার হলেই নাকি ঢাকা শহরের মায়ার টান কমে যায় ।অহনা হেলমেটের কাঁচ ফেলে চুপটি করে বসে আছে । বয়ে যাচ্ছে মৌন মুহুর্ত । চাল্দিনায় এসে অহনা বলল, চা খাব । একটা ছোট টংয়ের চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছি আর মনে পড়ে যাচ্ছে রবিন আর আমি রোজ বুধবারে সলিমগঞ্জ যেতাম গৌরিপুর হয়ে । এই চান্দিনার ওপর দিয়েই । চা খেয়ে আবার ছুটছি , ছুটছে আমার মোটর সাইকেল , গাছপালা , মাঠ , নদী , বালির চর সব ছুটছে পেছনে আর আমি আর অহনা ছুটছি সামনে । হাতছানি দিয়ে ডাকছে পাহাড় , পাহড়ের বন্ধুরা । আমার আর অহনার বিয়ের পর তেমন কোথাও বেড়ানোও হয়নি । হয় কুষ্টিয়া না হয় গাজীপুর । তা ছাড়া অহনার কাজটাই এমন বেখাপ্পা , ওর ছুটি পাওয়াই দুষ্কর । এবার অনেক লড়ে টড়ে দু’দিনের ছুটি পেল । মোটর সাইকেলে যাচ্ছি কারণ পৃথিবীতে যে দুই বাহণে অহনা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তার একটা হলো রিকসা আর একটা মোটর সাইকেল । অহনার বাসে উঠতে হয়না বাসের টিকিট দেখলেই গা গুলায় , মাথা ঘোরে … যত সব ঝঞ্ঝাটিয়া উপসর্গ ।
কুয়াশার গুমোট আঁধার চিরে আলতো বাতাস বইছে । আজ রাস্তায় গাড়ী বড্ড কম কম মনে হচ্ছে । পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড পার হচ্ছি আর বুক চিরে বেরিয়ে যাচ্ছে একটা দীর্ঘশ্বাস । রবিবারের হাটে এখান থেকেই বাজার করতাম কুমিল্লায় থাকার সময়ে । কত স্মৃতি । রেল লাইনের ওপর উড়াল পুল হয়েছে , কত বদলে গেছে জায়গাটা । আগে এখানে একতলা সব দোকান ছিল এখন কিছুই নেই । তার জায়গায় উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রাক্ষুসে বহুতল অট্রালিকা । সব কিছুই কেমন অচেনা লাগছিল । একটাও চেনা মানুষ নজরে পড়ল না । চার লেন হয়েছে পুরো সড়কটাই । ওভারলোডের গাড়ী চলায় রাস্তায় চাকা বসে যাবার গর্ত তৈরী হয়েছে । শুয়াগাজী পার হচ্ছি , স্পিড বাড়ালাম গতির কাঁটা আশির ঘরে । অহনা চুপ করে বসে আছে । দুরে জমিনে হালকা কুয়াশার পরদা । ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস কেটে গাড়ী ছুটে চলেছে । পেছনে ফেলে যাচ্ছি কত পরিচিত সব জায়গা । জগন্নাথ দীঘির পাড়ে কিছু পুরনো হোটেল আছে , খুব ভালো রান্না করে । সকালের নাস্তা ওখানেই সেরে ফেলব ভাবছি । বিশাল দীঘি , টলটলে জল । আগের মতোই আছে । কৈশোরে আব্বা সুনামগঞ্জ থেকে চট্রগ্রাম বদলী হলেন , যাবার সময় এই খানেই ভোরে আমরা সবাই নাস্তা সেরেছিলাম । তারপর আর কখনো এদিকে আসা হয়নি । হোটেল গুলোতে একটু চাকচিক্য এসেছে । যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিকতা এসেছে । ঝাঁপি উঠানো বারান্দায় একটা টেবিল দখল করে বসেছি আমি আর অহনা । এখান থেকে পুরো দীঘিটা দেখা যাচ্ছে । বালি হাঁসের মাংস আর গরম গরম পরোটা সাথে সযত্নে বানানো সালাদ । বিকট শব্দ করে একটা লরি চলে গেল । আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছি । অহনা পিছে এসে দাঁড়ালো । রোদ উঠেছে তবে মরা মরা । কুয়াশার চাদর সরিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে পারছে না । হোটেলের সামনের ফুল গাছে জল দিচ্ছেন এক বুড়ো । গাছের গোড়াগুলি খোঁচাচ্ছেন কাঠি দিয়ে , আবার চেপে চেপে দিচ্ছেন মাটি । যত্ন করে । বারৈয়ার হাটের পরই গাড়ী চলছে দুলে দুলে । লেংচে লেংচে । ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে । রাস্তার হাল অকহতব্য , গাড়ীর নাচনে মাঝে মাঝেই কঁকিয়ে উঠছে অহনা । কোমরের বল বেয়ারিং খুলে যাবার জোগাড় । মাঘের বেলা গড়িয়েছে বেশ । সূর্য এখন মাথার ওপর , খানিকটা দক্ষিণ চেপে । অহনা রাস্তার দু’ধারের জনপদ দেখছে আর বলছে , আর কত দুর ?
নয়টিলায় যখন উঠছি তখন খুশিতে অহনার মন ফুরফুরে হয়ে গেল । মুগ্ধ হয়ে দেখছে চারপাশ । বিস্ময়ের চকিত ধাক্কায় কেমন যেন ঘোর লেগে গেল অহনার । অহনার চোখ স্থির । পাহাড়ী শীতলতার সঙ্গে এক মায়াময় আলোছায়া মিলে মিশে স্বপ্ন স্বপ্ন পরিবেশ চর্তুদিকে । সেই স্বপ্ন আলোতে আমরা সামনে ছুটে চলছি । দুহাজার আঠারো সালের রোজায় এক বন্ধুর আমন্ত্রণে এসেছিলাম , রাতের বেলায় গতি হারানো লরির কারনে রাস্তা পুরো বন্ধ হওয়ায় সে বন্ধু মোটর সাইকেলে নিয়ে গিয়েছিল বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে । এখন সে বন্ধুর সাথে সম্পর্ক ছেড়া সুতোর মতো আলগা । জায়গাটা পার হতে গিয়ে বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা চিনচিনে কষ্ট অনুভব করছি । সময় কি এভাবে অতীতকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করতে পারে ! কিছু পড়ে থাকে না ! কোনও নালিশ ? কোনও দীর্ঘশ্বাস ? পরিবেশ , অভ্যাস , সময় মনের গঠনটাকেই কেমন অন্যরকম করে দেয় । তখন অতীতকে সাময়িক আবেগ দিয়ে একটুক্ষণ শুধু ছুঁয়ে দেখতেই ভালো লাগে । এও এক ধরনের দুঃখ বিলাস । এ বিলাসিতার একটা নির্দ্দিষ্ট সীমাও থাকে । তার বাইরে যেতে হলে আবেগ অসহ্য হয়ে পড়ে । দুরের ছায়া ছায়া পাহাড় গুলো পেছনে পার হয়ে যাচ্ছে । অন্ধকার মাখা সার সার কালো পাহাড়গুলোর মাথায় , আকাশে লালচে ভাব । ওই পাহাড় গুলোর ওপার থেকেই ঝমঝম বৃষ্টি এগিয়ে আসে বর্ষাকালে । রাস্তার দুধারে শাল আর রাবার গাছের সারি । রাস্তার পর রাস্তা । পাহাড়ের পর পাহাড় । আমাকে জড়িয়ে বসে আছে অহনা । বাতাসে তার ক’গাছি চুল উড়ছে । বুক জুড়ে ডুব ডুব সুখ । রাস্তাঘাট বড় নির্জন । ফাঁকা ফাঁকা । সাফু কে ফোন দিলাম । ও বলল মুসলিমপাড়ায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে শিমুনাজ । ছোটবেলায় স্কুলে আমার যে মেয়ে বন্ধুদের গ্যাং ছিল তার একজন । সম্ভবত ক্লাস টেনের বছর তার বিয়ে হয়ে যায় আমাদেরই স্কুলের এক সিনিয়রের সঙ্গে । শিমুনাজের বাড়িটা খুবই মনোরম । খোলামেলা । চারপাশে ঘন সবুজ । ড্রয়িং হল , ডাইনিং ,বেড রুম সামনে টানা বারান্দা । বাদামি মখমলের মতো একটা নরম আলো ছড়িয়ে চারদিকে । দুপুরের খাবার আয়োজন দেখে আমার আর অহনার দু’জনেরই চোখ ছানাবড়া । মাছ , মাংস , সব্জী ভর্তা কি নেই ডাইনিংয়ে ? সবচেয়ে মজার কথা হলো অহনা এখানে পুরোপুরি জড়তাহীন ।
বিকেলের দিকে অহনাকে শিমুনাজের বাসায় রেখেই মাটিরাংগা বাজারের দিকে ছুটলাম । আমাদের স্কুল পার হচ্ছি আর মগজে কত স্মৃতি দোলা দিচ্ছে । বাজারে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সাফু তবলছড়ি মোড়ে । আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো । কিছুক্ষণ পর সেখানে একে একে জড়ো হলো মফিজ , তাহের , বশির , বেলাল , মিন্টু , জয়ন্ত ,আসাদ , জালাল , মনির , বাবলু সহ অনেকেই । জল পাহাড়ে বসে গেল স্কুল জীবনের মতো আড্ডা । পরের দিনের আয়োজনের বাবুর্চি কাটাকুটি করছে সব । আমরা হৈহল্লা করছি আর দেখছি । জল পাহাড়ের নীচে গোল মতো করে বসার জায়গা । সেখানে বন্ধুদের জমানো কত কথা ! সাফু আচমকা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে । যেভাবে পাহাড় তাকিয়ে থাকে মেঘের দিকে । কত কাল পর বন্ধুদের দেখছি । সবারই চেহারায় একটু আধটু পরিবর্তন হয়েছে । কৈশোরের টিঙটিঙে ভাব উধাও হয়ে খানিকটা মাংস আর চর্বি জমেছে অনেকের । কারো কারো চুল দাঁড়িতে পাকন ধরেছে । উচ্ছাস , বিরক্তি , সবই বড় পরিশীলিত কারো কারো । আমি ঠিক উল্টো । লাগাম ছেঁড়া । উদ্দাম । দল বেঁধে সবাই মিলে হোটেলে ঢুকে চা পরোটার ওপর হামলে পড়েছি । খেয়ে আবার জল পাহাড়ে । আমাদের কথা ফুরাচ্ছে না । অন্তর প্রোগ্রামের ব্যানার করে পাঠিয়েছে । সবাই তাই দেখছি আর জমিয়ে আড্ডা হচ্ছে । কয়েকজন সহপাঠী আমাদের আয়োজনে আসবে না । একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে । কাদের সাথে চলা ভালো ? যাদের আমরা ভালোবাসি , তাদের সঙে ? নাকি যারা সত্যি আমাদের ভালোবাসেনা কিন্তু নিয়ম রক্ষা করে তাদের সাথে ? ফয়সালা হয়ে গেল । দায়িত্বজ্ঞান , বাস্তববুদ্ধি আর বন্ধুদের জন্য সর্বগ্রাসী আকুলতা যাদের আছে তারাই আজ জড়ো হয়েছে । এর বেশী আর কি প্রয়োজন ? পৃথিবীতে কারও জন্যই কোথাও কিছু আটকায় না । রাত এগারোটার দিকে সবাই দলবেঁধে হানা দিল শিমুনাজের বাসায় । শিমুনাজের বর চমৎকার মানুষ । এতোটাই চমৎকার যে ভদ্রলোককে আমার খুব ভালো লেগে গেল । উনি ফোন করে সবাইকে দাওয়াত করলেন রাতের খাবার উনার বাসায় খাবার জন্য । মধ্যরাতে আড্ডা শেষে সবাই বিদায় নিল ।
মাঘের নীল রাত ভারী মনোরম এক শীতল বাতাস ছড়াচ্ছে । বাতাসটাকে বুক ভরে টানছি । বহু বছর পর । বন্ধ ঘরে এখন শুধুই এক হা হা শূন্যতা । অহনা ঘুমিয়ে পড়েছে , চিরচেনা সে ভঙ্গিতে । শুয়েই ঘুমিয়ে গেলাম , প্রশান্তির ঘুম । কতকাল পর । খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল । ভোরের হাওয়া বইছে । বাতাসে বুনো গন্ধ । আমি উঠে শিমুনাজের স্কুলের দিক থেকে হেঁটে এলাম । ভোরের পৃথিবী দর্শন করছি । অনেকটা নীচে পাহাড়ের নীচে সমতল জমি । ফিরে এসেছি ততক্ষণে নাস্তার টেবিলে শিমুনাজের সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে অহনা । এতো এতো নাস্তা টেবিলের কোথাও ফাঁকা নেই এক ফোঁটাও । নাস্তা শেষে চা এলো । গরম তরলে শরীরের শীতল ভাব কেটে গেল অনেকটা । মাটিরাংগা আসার পর থেকে সময় খুব দ্রুত দৌড়াচ্ছে । সময় বড় অদ্ভুত জিনিস । যখন মনে করব সময়টা দ্রুত চলুক , তখন দেখব শামুকের মত যাচ্ছে । আবার যখন সময়টাকে আটকে রাখতে চাইবো , তখন সে একেবারে জেটপ্লেনের গতিতে দৌড়াবে । বাইরে রোদ ঝলমল করছে । টিলার ওপর রোদ পড়ে মনে হচ্ছে সোনার পাহাড়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছি । শিমুনাজ বাড়ীর পাশে শিমের গাছ লাগিয়েছে ।হাজার হাজার সাদাটে বেগুনি ফুল ফুটে আছে সে গাছে । বহু বছর পর শিমের ফুল আর তার ঘ্রাণ ভেসে আসছে । ছোট বেলায় আম্মাও আমাদের বাংলোর পাশের জমিতে মাটিরাংগায় এমন শিমের গাছ লাগাতেন । থোকায় থোকায় ফুল আর শিম ধরতো সেখানে । সাড়ে নয়টায় জল পাহাড়ে পৌছালাম আমি আর অহনা । একে একে বন্ধুরা আসছে আর বুকে জড়িয়ে ধরছে কয়েকযুগ পর । আহা ! জলপাহাড়ের ওপর কাঠের সাঁকো মত কাঠামো পার হলেই সেখানে ডাইনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে । বাবুর্চী রান্না করছে সেখানে । সাফু আর মফিজ সে তদারকিতে ব্যস্ত । সাফু পারেও বটে ! সব বন্ধুদের খুঁজে সবার বাড়ী বাড়ী গিয়ে দাওয়াত করা থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানের বাজার করা , হল বুকিং , বাবুর্চি ঠিক করা সব বিদ্যুতের গতিতে করলো । ভালো অর্গানাইজার না হলে একার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয় । ওর প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে এল । সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগে থাকা আমার বন্ধু সাফুর মুখে রোদের আলো পড়ে ওকে প্রমিথিউসের মত লাগছে । দুপুরে জব্বর হলো খাওয়াটা । নিখুঁত আয়োজন । মুরগীর রোস্ট , হাঁসের মাংস ভুনা , মুরগীর গিলা কলিজার লটপটি , ইলিশ ভাজা , চিংড়ী দিয়ে সবজী , ছুরি শুটকী দিয়ে শীমের বীজ ,টমেটো ভর্তা , টাকি মাছের ভর্তা , শুটকীর ভর্তা ।এতো এতো খাওয়ার পরও খাবার বেঁচে গেল প্রচুর । বন্ধুরা সবাই পুলকিত ।
মাঘের সন্ধ্যা । ভারী মনোরম এক বাতাস ছড়াচ্ছে । বাতাসটাকে বুক ভরে টানছি আমি । মনশ্চক্ষে দেখছি কৈশোরের আমাকে । বাকী উল্লাহ আসার সময় কৈশোরের অনেক ছবি নিয়ে আসলো । প্রোগ্রাম শেষে দলবেঁধে ছোট ভাই বকরের দোকানে গেলাম অহনা আদিবাসী পোশাক নেবে ।বকর আর রনিকে নিয়ে মনি কুমারের নতুন দোকান দেখতে চৌধুরী পাড়ায় যাচ্ছি , হঠাৎ মনে হলো আরে তন্দ্রা তো চৌধুরী পাড়াতেই থাকে । পৃথিবীতে কিছু সম্পর্ক আছে বড় অদ্ভুদ ধরনের , আমার আর তন্দ্রার সম্পর্কও তাই । মিহি একটা সুতোর বন্ধন । স্কুলের ছোট বোন । বেশ কয়েকবার ফেসবুকে কথা হয়েছে । কিন্তু দেখা হলো এবারই প্রথম । তন্দ্রার মা কে দেখার পর মনে হয়েছে স্বয়ং লক্ষ্মী সামনে দাঁড়িয়ে আছেন । অহনারও উনাকে ভালো লেগে গেল । দুনিয়ার জলখাবার টেবিলে নিয়ে উপস্থিত ।তন্দ্রার বাবা ও আড্ডা দিতে এলেন । চমৎকার মানুষ । তন্দ্রাদের বাড়ী থেকে বের হয়েই টের পেলাম বাতাসে হিউমিডিটির মাত্রা ঝপ করে চড়ে গেছে । আকাশ ঈষৎ ঝুলবর্ণ । সাফু , মফিজ , জালাল , বেলাল , তাহের , জয়ন্ত , বশির , সহ সবাই মিষ্টির আয়োজন নিয়ে বসে আছে । আলুটিলায় গিয়ে অহনা আর বাশারের স্ত্রীর সৌজন্যে কফি এবং রাতে ডিনার পার্টি থ্রো করতে চাইছে ওরা । কিন্তু মেঘেদের সাজ গোজ দেখে ওতদুরে যেতে চাইছে না অহনা । শেষে তাহেরের বাসা ঘুরে অহনাকে রেখে এলাম শিমুনাজের বাসায় । বুদ্ধুং পাড়ায় আমার জন্য অপেক্ষায় আছে বন্ধু বুদ্ধজয় চাকমা । আমি আর বশির ছাড়া কেউ নেই । উঁচু নিচু পথে চমকে চমকে চলছে বশিরের গাড়ী । নির্জন পথে বাড়ছে বৃক্ষমিছিল । এ ধরনের পরিবেশে অনর্থক শব্দ বড় বেমানান । হয়তো বা সেজন্যই নীরবে গাড়ী চালিয়ে চলেছে বশির । বড় রাস্তা ফেলে এবার ডানদিকের আধকাঁচা রাস্তায় নেমেছে গাড়ী । দুধারে ঝোপঝাঁড় , আগাছা । এক আধটা মাটির ঘটের টুকরো , ছোট-বড় ইট ছড়িয়ে ছিটিয়ে এখানে সেখানে । বড় নিশুত , নিঝুম চারদিক । আমরা তিনবন্ধু পাশাপাশি হাঁটছি । হাঁটছি না , বুঝি ফিরতে চাইছি নিজেদের কৈশোরে । আজ তীব্র ভাঁটার টানে ভেসে চলার দিন । পথ জুড়ে ছড়িয়ে আছে শুকনো পাতা । তারই ওপর দিয়ে হেঁটে টিলা নেমে বশিরের গাড়ী অব্দি ফিরে এলাম । শিমুনাজের বাসায় নামিয়ে দিয়ে বশির চলে গেল । তার গাড়ীর যান্ত্রিক শব্দটা অনেকক্ষণ কানে লেগে রইলো ।
আমি আর অহনা ফিরে যাচ্ছি ঢাকায় । গতকাল সন্ধ্যা থেকে বাল্যবন্ধু মিজানের অন্তত গোটা বিশেক কল । রামগড়ে ওর ওখানে যেতেই হবে । আমরা এসেছি শুনে জরুরী কাজ ফেলে কুমিল্লা থেকে চলে এসেছে ও । রামগড় থেমে মিজানকে কল দিলাম । মিজান ছুটে এলো আমাদের দেখেই খুশীতে উথলে উঠল । শেষ মাঘের বেলা যদিও গম্ভীর , তবু এলোমেলো হাওয়া উঠছে হঠাৎ হঠাৎ । মিজানের বউ দুনিয়ার খাবারের আয়োজন করছে । কি নেই সে আয়োজনে ! পিঠাপুলি থেকে শুরু করে হাঁসের মাংশ , ডাবল ডিমের সুপি নুডলস , চিকেন তন্দুরি থেকে শুরু করে চিকেন পরোটা , মিষ্টি । আয়োজন দেখে আমার আর অহনার চোখ ছানাবড়া । খুব খাটিয়েছে বউটাকে শীতের সকালে । রামগড় টি স্টেটে কিছুসময় ব্যায় করে বহু কষ্টে বিদায় নিয়ে ফিরছি আমি আর অহনা । মুঠো মুঠো স্মৃতি নিয়ে । ইস বার বার যদি তোদের কাছে ফিরতে পারতাম এমন করে ? আমার মোটর সাইকেল এগিয়ে চলছে আর বুকের মাঝে ঢেঁকির পার পড়ছে । তা পড়ুক আরও কিছুক্ষণ । কিংবা অনন্তকাল ।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট