‘যত মত তত পথ’ কথাটি কালী সাধক রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের৷ এর ব্যাখ্যাও তিনি বিভিন্ন সময় দিয়েছেন— ‘আমার মত ঠিক আর অপরের মত ভুল— এমন ধারণা ঠিক নয়৷ ভিন্ন ভিন্ন রাস্তায় সবাইতো একজনের কাছেই পৌঁছাবে৷ তাই যে পথেই ডাকো মন-প্রাণ ভরে ডাকো৷’ এই কথাটিও বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল তবে শুধু বাক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ঠিক— যত মত আসবে সমাধানের পথও তত সঠিকভাবে গ্রহণ করা যাবে৷ রামকৃষ্ণ হিন্দু ধর্মের হাজারটা মত ও পরমাত্মার সাথে মিলনের পথের কথাই বলেছেন৷ অর্থাৎ যে মতাদর্শীই হও মন দিয়ে ঈশ্বরের আরাধনা করলেই হল৷ কিন্তু এমন ভাবনা কেউ আর মানে না, তার ভক্ত ছাড়া অন্যরা মানেনি৷ বিজ্ঞানমনষ্ক মুক্তচিন্তার মানুষেরাতো ননই৷
ঢাকার তাঁতীবাজার শাঁখারী বাজার এলাকা দিয়ে হেঁটে গেলেই টের পাবেন- পথে দেখা হলে, নমস্কার/আদাবের পরিবর্তে কেউ বলছে, ‘জয় গুরু’ কেউ বলছে ‘হরেকৃষ্ণ’। জয়গুরু যারা বলছে, তারা অনুকূল ঠাকুরের অনুসারী আর হরেকৃষ্ণ বলছে ইসকন সম্প্রদায়। ইসকনরা শুধু শ্রীকৃষ্ণের অনুসারী। এখানে বৈষ্ণব থেকে চার্বাক (মূলত নাস্তিক), কালী-দুর্গা থেকে বাসুদেব-জগন্নাথ সব মতাদর্শী পাবেন। এক দুর্গার বহুরূপের পূজা করা হয় এখানে— অষ্টভূজা, বিপদনাসিনী, দ্বিভূজা দুর্গতিনাশিনী, কাত্যায়নী ইত্যাদি। কালী পূজা আছে বহু রকমের। পদার্থবিদ্যার এক অধ্যাপকের সাথে দেখতে গিয়েছিলাম রক্ষাকালীর মন্দির। তিনি কালীসাধক। জানতে চাই, পদার্থ বিজ্ঞান কিভাবে কালীর সাথে মিলে? ওনি বলেন, দুটোই শক্তি, তাহলে এক হল না! হিন্দু প্রধান এ দুই এলাকায় বহু রকম মন্দির রয়েছে— জগন্নাথ, বাসুদেব, কালী, শনি, সুধারাম, রাজেশ্বরী..। আর পূজা-পার্বন লেগেই থাকে। একই দিনে তিন চার জায়গায় ভিন্নভিন্ন পূজা হচ্ছে ভিন্নভিন্ন দেবদেবীর। খোঁজ নিলাম, বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কিশোরী ভজনা সম্প্রদায় আছে কিনা? একজন বললেন, আছে! বৈষ্ণবদের কয়েকশ বছর আগে জাগরণ ঘটে। চতুবর্ণ প্রথা না থাকায়, নিম্নবর্ণের হিন্দু জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতা পায়। কিশোরী ভজনা সম্প্রদায় আমাদের বিক্রমপুরে ছিল। এরা সারারাত একটি কিশোরীকে সামনে বসিয়ে গান-বাজনার মাধ্যমে ভজন করতো। বিক্রমপুরে এখনো ওরা আছে।
এই যে এতো মত যার যার মতো পালন করছে তাতে কোন আপত্তি নেই তবু রামকৃষ্ণের ভক্ত হওয়া যাবে এবং তাদের আত্মা পরমাত্মার সাথে মিলিয়ে দিবেন তিনি৷ রামকৃষ্ণের ‘যত মত তত পথ’ অন্যরা আবার তাদের মতো করে ব্যাখ্যা দেয়৷ অনেকে আবার এই মত মানছে না৷ মৌলবাদী হিন্দুরা আবার মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদীদের আরাধনা মানবে না৷ তারা বলবে- রামকৃষ্ণ সেমিটিকদের কথা বলেননি৷ আবার মাংসভোজী তাদের ক্ষেত্রে ইশকনরা কি বলছে? তারা বলছে— মাংশ খাওয়াদেরও পথ রয়েছে৷ সেই পথ হল পরজন্মে তারা শৃগাল বা বক বা হায়েনার যোনীতে জন্ম নিবে৷
যারা বেদান্তবাদী তাদেরও বক্তব্য আছে৷ তারা বলছে, বেদে ঈশ্বর পাওয়ার বিভিন্ন পথ রয়েছে৷ সেই বিভিন্ন মতের পথের কথাই বলা হয়েছে৷ আবার যারা খাঁটি বৈষ্ণব তারা বলছে, কৃষ্ণ প্রেমে না মজলে কোন মতই পথের দিশা দিবে না৷ বিপরীতে সেমিটিকরা যার যার মতো বলবে, ‘তাদের নবীর প্রদর্শিত পথ ছাড়া সব মতই দোজখের পথ দেখাবে৷ দেবদেবীর আরাধনা করলে শিরক হবে৷ সব পাপের মাপ হলেও শিরক করার মাফ নাই!
গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে রামকৃষ্ণ মাত্র ৫০ বছর বয়সেই পরমাত্মার সাথে মিলে যান৷ তিনি যখন গলার ক্যান্সারে খেতে পারছিলেন না, মারাত্মক রোগযন্ত্রণা ভোগ করছিলেন তখন ভক্তরা এসে ধরলেন, ‘বাবা আপনি মা কালীকে বলেন যাতে আপনার ক্যান্সার দূর করে দেয়৷ আপনার কষ্ট আমাদের সহ্য হয় না’৷ কিন্তু রামকৃষ্ণ নিজের কথা কিভাবে বলেন! ভক্তদের নিত্য দাবিতে একদিন জানালেন, ‘আমি বলেছিলাম কিন্তু মা কালী বলেছেন তোর চেয়েও বেশি সমস্যা বহু মানুষের রয়েছে৷ আমি ভীষণ লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলাম’৷
আমরা সব ধর্মের কত রকম কথা শুনি৷ একেক ধর্মে একেক মতের কথা শুনি৷ ৪৩০০ ধর্মে আরো বহু রকমের মত৷ কোন মতটি পথে দেখাবে? কোন গ্রন্থটি নির্ভুল? সেই গ্রন্থের ধর্মটিইতো সঠিক! আপনিতো জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্মটিকেই সঠিক বলছেন? পড়ে দেখেছেন? ভুলে পূর্ণ কি? তাহলে পথ পাবেন কিভাবে?