1. fauzursabit135@gmail.com : Fauzur Rahman Sabit : Fauzur Rahman Sabit
  2. sizulislam7@gmail.com : sizul islam : sizul islam
  3. mridha841@gmail.com : Sohel Khan : Sohel Khan
  4. multicare.net@gmail.com : অদেখা বিশ্ব :
শুক্রবার, ২৮ মার্চ ২০২৫, ০৬:৪৬ অপরাহ্ন

পাহাড়পুর বিহার আজ ভগ্নদশায় বিদ্যমান

মোঃ মোজাম্মেল হক
  • প্রকাশিত: শনিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২
পাহাড়পুর (প্রত্নতাত্ত্বিক) নওগাঁ জেলা এবং বদলগাছী থানার অধীনস্থ পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল। পাকা সড়কের মাধ্যমে গ্রামটির নিকটস্থ রেলস্টেশন জামালগঞ্জ এবং নওগাঁ জয়পুরহাট জেলা শহরের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা রয়েছে। এ প্রত্নস্থল উত্তরবঙ্গের প্লাবনভূমিতে অবস্থিত। বিস্তীর্ণ একটানা সমভূমির মাঝে এক সুউচ্চ (পার্শ্ববর্তী ভূমি থেকে প্রায় ২৪ মিটার উঁচু) প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ স্বভাবতই একে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। স্থানীয়ভাবে পাহাড় নামে পরিচিত এ ধ্বংসাবশেষের অবস্থান থেকে পাহাড়পুর নামের উৎপত্তি হয়েছে।
পূর্বভারতে জরিপ কাজ পরিচালনাকালে ১৮০৭ ও ১৮১২ সালে বুকানন হ্যামিল্টন সর্ব প্রথম প্রত্নস্থলটি পরিদর্শন করেন। পরবর্তীকালে ওয়েস্টম্যাকট পাহাড়পুর পরিভ্রমণে আসেন। স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৭৯ সালে এ স্থান পরিদর্শন করেন ও এই ঢিবিতে ব্যাপক খনন করতে চান। কিন্তু বলিহারের জমিদার কর্তৃক তিনি বাধাপ্রাপ্ত হন। ফলে বিহার এলাকার সামান্য অংশে এবং কেন্দ্রীয় ঢিবির শীর্ষভাগে সীমিত আকারে খননের কাজ চালিয়েই তাঁকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। শেষোক্ত এলাকায় তিনি চারপাশে উদ্গত অংশযুক্ত ২২ ফুট বর্গাকার একটি ইমারত আবিষ্কার করেন। প্রত্নস্থলটি ১৯০৪ সালের পুরাকীর্তি আইনের আওতায় ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ কর্তৃক ১৯১৯ সালে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষিত হয়।
ভূমি নকশা, পাহাড়পুর মহাবিহার
ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ, বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটিএবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক যৌথভাবে ১৯২৩ সালে সর্বপ্রথম এখানে ব্যাপক আকারে খনন শুরু হয়। এ যৌথ কার্যক্রম প্রথমে দিঘাপতিয়ার জমিদার বংশের কুমার শরৎ কুমার রায়-এর অর্থানুকূল্যে এবং ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের পশ্চিম অঞ্চলের প্রাক্তন সুপারিনটেনডেন্ট প্রফেসর ডি.আর ভান্ডারকরের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। এ সময়ে খনন কাজ বিহারের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের কয়েকটি ভিক্ষু কক্ষে এবং পার্শ্ববর্তী প্রাঙ্গনে সীমাবদ্ধ থাকে। পরে ১৯২৫-২৬ সালে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কেন্দ্রীয় ঢিবির উত্তরাংশে খনন করেন। পরবর্তী মৌসুম (১৯২৬-২৭) থেকে ১৯৩৩-৩৪ সাল পর্যন্ত কে.এন দীক্ষিত-এর নেতৃত্বে পাহাড়পুরে খনন কাজ অব্যাহত থাকে। তবে মধ্যবর্তী দুই মৌসুমে (১৯৩০-৩২) জি.সি চন্দ্র খনন পরিচালনা করেন। সর্বশেষ মৌসুম দুটিতে (১৯৩২-৩৪) কেন্দ্রীয় মন্দির থেকে ৩৬৪ মিটার পূর্বে সত্যপীর ভিটায় খনন করা হয়
স্বাধীনতাত্তোরকালে বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ পাহাড়পুরে পুনরায় খনন কাজ পরিচালনা করে। কয়েক পর্বের এ খননের ১ম পর্ব ১৯৮১-৮২ মৌসুমে শুরু হয় এবং ১৯৮৪-৮৫ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। বিরতিসহ দ্বিতীয় পর্বের খনন কাজ ১৯৮৮-৮৯ থেকে ১৯৯০-৯১ পর্যন্ত চালু থাকে। প্রথম পর্যায়ের খননের উদ্দেশ্য ছিল দীক্ষিতের প্রতিবেদনে বর্ণিত বিহারের ভিক্ষু কক্ষে তিনটি নির্মাণ যুগের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া এবং প্রত্নস্থলের পূর্বের স্তরসমূহ আবিষ্কার করা।
স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ স্বাধীনতা-পূর্ব যুগের খননের ফলে সোমপুর মহাবিহার নামে উত্তর-দক্ষিণে ২৭৪.১৫ মিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে ২৭৩.৭০ মিটার পরিমাপ বিশিষ্ট বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রকান্ড এই স্থাপনার চতুর্দিকের ১৭৭টি বসবাস উপযোগী কক্ষ, বিস্তৃত প্রবেশপথ, অসংখ্য নিবেদন-স্তূপ, ছোট ছোট মন্দির, পুকুর ও সংলগ্ন অন্যান্য নিদর্শন ছাড়িয়ে রয়েছে, মাঝে স্থাপত্য-বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সুউচ্চ একটি মন্দির। ধাপবিশিষ্ট এ মন্দির ক্রুশাকৃতি ভূমিপরিকল্পনায় নির্মিত। ক্রুশের প্রতি দুই বাহুর মধ্যবর্তী স্থানে উদ্গত অংশ কৌণিকভাবে বিন্যস্ত। মন্দিরের দেয়ালে গাত্রের কুলুঙ্গিতে পোড়ামাটির ফলক এবং প্রস্তর ভাস্কর্য দ্বারা সুশোভিত।
পাহাড়পুর মহাবিহার
বিহার এক বিরাট চতুষ্কোণ ক্ষেত্র জুড়ে পাহাড়পুর বিহার আজ ভগ্নদশায় বিদ্যমান। বর্তমানে এর চারদিক ৫ মিটার চওড়া এবং ৩.৬-৪.৪ মিটার উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দেয়ালটি যদিও বেশি উঁচু না; কিন্তু এর পুরুত্ব এবং সংলগ কক্ষগুলোর বিশালতা থেকে ধারণা করা যায় যে, সুউচ্চ কেন্দ্রীয় মন্দিরের সাথে সঙ্গতি রেখে সম্ভবত এগুলি বহুতল বিশিষ্ট ছিল। ভূমি পরিকল্পনায় কক্ষসমূহ শ্রেণীবদ্ধভাবে বিন্যাস করা হয়েছে। প্রতিটি কক্ষের অভ্যন্তরীণ পরিমাপ ৪.২৬ মি দ্ধ ৪.১১মি। এগুলির সামনে আছে ২.৪৩-২.৭৪ মিটার প্রশস্ত টানা বারান্দা এবং ভেতরের অঙ্গনের সাথে চারবাহুর প্রতিটি বারান্দার মধ্যবর্তীস্থান সিঁড়ি দিয়ে যুক্ত।
প্রতিবাহুর মধ্যবর্তী স্থানের কক্ষগুলি ব্যতীত বিহারের ৪ বাহুতে মোট ১৭৭টি কক্ষ আছে। উত্তর বাহুতে ৪৫টি এবং অপর তিন বাহুর প্রতিটিতে ৪৪টি করে কক্ষ রয়েছে। পূর্ব, পশ্চিম এবং দক্ষিণ বাহুর মধ্যবর্তী স্থান বরাবর বহির্দেওয়ালে উদ্গত অংশ রয়েছে এবং অভ্যন্তরভাগে অঙ্গনের দিকে চতুর্দিকে পথসহ পাশাপাশি তিনটি কক্ষ এবং উত্তর বাহুতে একটি বিশাল আয়তনের হলঘর আছে। ৯৬ নং কক্ষে তিনটি মেঝে আবিষ্কৃত হয়েছে। তন্মধ্যে সর্বশেষ (উপরের) মেঝেটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩০ সেমি, দ্বিতীয়টি ১মি এবং সর্বনিম্নটি ৩মি নিচে উন্মুক্ত হয়েছে।
ধারণা করা হয় যে, মেঝেত্রয়ের এই অনুক্রম বিহারের সকল কক্ষেই বজায় রাখা হয়েছে। খননের পর সর্বোচ্চ মেঝেটি অপসারণ করে দ্বিতীয় মেঝেটি সংরক্ষণ করা হয়। উল্লেখ্য যে, বিহারের ৯২টি কক্ষে এই মেঝের উপর অলংকৃত বেদি নির্মিত হয়। মূলত কক্ষগুলি ভিক্ষুদের আবাসকক্ষ হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু এত বেশি সংখ্যক বেদির অবস্থান থেকে ধারণা করা যায় যে, শেষ যুগে কক্ষগুলি পূজা বা প্রার্থনার জন্য ব্যবহূত হতো। উত্তরদিকে প্রধান তোরণ ছাড়াও এ বাহুর পূর্ব অংশে অপর একটি অপ্রশস্ত আয়তাকার প্রবেশপথ ছিল। পশ্চিম ও দক্ষিণ বাহুতে অনুরূপ কোন পথের ব্যবস্থা না থাকলেও সম্ভবত পূর্ব বাহুর মধ্যস্থল বরাবর একটি ক্ষুদ্রাকার প্রবেশপথ ছিল। কেন্দ্রীয় মন্দির ছাড়াও বিহারের উম্মুক্ত অঙ্গনে আরও অনেক ক্ষুদ্রাকার ইমারতাদির ধ্বংসাবশেষ আছে, যেগুলি বিভিন্ন সময়ে নির্মিত হয়েছিল। তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিভিন্ন আকার ও আয়তনের বেশ কিছু নিবেদন স্তূপ, কেন্দ্রীয় মন্দিরের প্রতিকৃতি, পঞ্চ মন্দির, রন্ধনশালা ও ভোজনশালা, পাকা নর্দমা এবং কূপ। কেন্দ্রীয় মন্দিরের ক্ষুদ্রাকৃতির প্রতিকৃতি বিহারের পূর্ব বাহুর দক্ষিণ অংশে অবস্থিত। এ প্রতিকৃতিতে মন্দির পরিকল্পনাকে আরও নিখুঁত এবং সুসমঞ্জস করা হয়েছে। এ এলাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হলো একটি সোপান শ্রেণি। পূর্ব বাহুর কেন্দ্রস্থলে ৪ মিটার প্রশস্ত এ সোপান শ্রেণি ৯.৭৫ মিটার পর্যন্ত অঙ্গনের দিকে বিস্তৃত। এর শেষের ছয়টি সিঁড়ি পাথরের তৈরি। অঙ্গনের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে কক্ষ নং ৭৩ এবং ৭৪ এর সম্মুখে বিভিন্ন আকৃতির ৫টি মন্দির দেখা যায়। মন্দিরগুলির উপরিভাগ বিশেষভাবে অলংকৃত এবং ভিত্তিবেদিতেও অলঙ্কৃত প্রক্ষেপণযুক্ত অর্ধবৃত্তাকার কার্নিস রয়েছে। এগুলির মধ্যে তারকাকৃতির ষোল কোণ বিশিষ্ট একটি স্থাপত্য সর্বাধিক আকর্ষণীয়। মন্দিরগুলির চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত। এর উত্তর দিকে একটি বড় পাতকূয়া আছে। এর অভ্যন্তরীণ ব্যাস ২.৫ মিটার। রন্ধনশালা ও বৃহৎ ভোজনশালাও বিহারের এ অংশে অবস্থিত। ভোজনশালা ও রন্ধনশালার মধ্যে উত্তরদিকে প্রসারিত ৪৬ মিটার দীর্ঘ একটি পাকা নর্দমা আছে এবং এর পশ্চিমে এক সারিতে তিনটি কূপ আছে। এগুলি সম্ভবত উভয় গৃহের প্রয়োজনে ব্যবহূত হতো। অঙ্গনের উত্তর-পশ্চিম অংশে কক্ষ নং ১৬২ থেকে ১৭৪ এর সম্মুখস্থ বারান্দা এলাকা থেকে ইটের দেয়াল পরিবেষ্টিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে। বেষ্টনীর ভিতর থেকে পানি নির্গমের জন্য নির্দিষ্ট ব্যবধানে বেষ্টনী দেয়ালে বেশ কিছু আয়তাকার নালা রয়েছে। এ অঞ্চলের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাটি হলো একটি বর্গাকার ইটের কাঠামো যার নিম্নভাগে পানি নিষ্কাশনের জন্য তিনটি খাত রয়েছে। খাতগুলি দেয়াল দ্বারা বিভক্ত এবং উপরিভাগ ক্রমপূরণ (করবেল) পদ্ধতির মাধ্যমে ইট দ্বারা বন্ধ। এরূপ কাঠামো নির্মাণের উদ্দেশ্য সঠিকভাবে জানা সম্ভব হয় নি। এখান থেকে আরও পশ্চিমে অপেক্ষাকৃত উত্তম অবস্থায় বিদ্যমান একটি পাতকুয়া আছে।
কেন্দ্রীয় মন্দির পাহাড়পুর মহাবিহারের বিশাল উন্মুক্ত অঙ্গনের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে একটি সুউচ্চ কেন্দ্রীয় মন্দির। ২৭ বর্গমিটার স্থান জুড়ে বিস্তৃত এ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ এখনও ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ২১ মিটার উঁচু। মন্দিরটি ক্রুশাকৃতির ভূমি পরিকল্পনায় এবং ক্রমহ্রাসমান ঊর্ধ্বগামী তিনটি ধাপে নির্মিত হয়েছে। সর্বোচ্চ কাঠামোর আকার আকৃতি সম্পর্কে আজও জানা যায় নি। ধাপের উপরিস্থিত ঊর্ধ্বমুখী শূন্যগর্ভ বর্গাকার কক্ষটিকে কেন্দ্র করেই বিশাল মন্দিরটি তার আকর্ষণীয় স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে গড়ে উঠেছে। এ কেন্দ্রীয় কক্ষটির চর্তুদিকের দেয়ালের গায়ে (কক্ষের চার কোণের কিছু অংশ বাদ দিয়ে) আড়াআড়ি ভাবে নতুন দেয়াল যুক্ত করে দ্বিতীয় ও প্রথম ধাপের চারদিকে চারটি কক্ষ ও মন্ডপ নির্মাণ করা হয়েছে। এ মন্দির পরিকল্পনার সমান্তরালে চারদিকে দেয়াল বেষ্টিত প্রদক্ষিণ পথ নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে মন্দিরটি ক্রুশের আকার ধারণ করে এবং ক্রুশের প্রতি দুই বাহুর মধ্যবর্তী স্থানে অতিরিক্ত উদ্গত কোণসমূহের সৃষ্টি হয়। ভিত্তি পরিকল্পনার সাথে সঙ্গতি রেখে মন্দিরের চতুর্দিকে একটি বেষ্টনী দেয়াল আছে। এ দেয়াল কেবল উত্তর দিকের সিঁড়ির কাছে ভিন্নরূপ ধারণ করেছে। মন্দিরের ভিত্তিভূমি থেকে শীর্ষদেশ পর্যন্ত সমস্ত পরিকল্পনাটি অন্যান্য উপাদানসহ একই নির্মাণযুগে বাস্তবে রূপ পায় এবং পরবর্তী যুগের ইতস্তত সংস্কার, সংযোগ বা পরিবর্তনের কাজগুলি মন্দিরের মৌলিক পরিকল্পনাকে তেমন ব্যাহত করে নি।
মন্দিরের ভিত্তিভূমির দেয়াল ৬৩টি প্রস্তর ভাস্কর্য দ্বারা সুশোভিত। মূর্তিগুলি উদ্গত অংশের কোণে এবং এর মধ্যবর্তী অংশে বিশেষভাবে নির্মিত কুলুঙ্গিসমূহে সংসহাপিত। মন্দিরের দেয়াল ইট ও কাদার সমন্বয়ে গঠিত। দেয়ালগাত্রের বহির্ভাগ অলঙ্কৃত ইটের (পাকানো দড়ি, দাবা খেলার বোর্ড, ধাপকৃত পিরামিড,পদ্ম পাপড়ি ইত্যাদি নকশাযুক্ত) উদ্গত কার্নিস এবং পোড়ামাটির ফলক সারি দ্বারা অলঙ্কৃত। ভিত্তিভূমির চতুর্দিকে এক সারি এবং উপরের দুই ধাপের প্রদক্ষিণ পথের দেয়ালের চতুর্দিকে দুই সারি করে পোড়ামাটির ফলক মন্দিরকে সুশোভিত করেছে।
পাহাড়পুরের মন্দিরের ধরনকে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত বলে প্রায়শই বর্ণনা করা হয়। কিন্তু ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বে ‘সর্বোতভদ্র’ হিসেবে অভিহিত এক ধরনের মন্দিরের উল্লেখ দেখা যায়। চতুর্দিকে চারটি প্রবেশপথসহ প্রতিদিকে একটি করে মন্ডপ বিশিষ্ট একটি বর্গাকৃতির মন্দির ‘সর্বোতভদ্র’ মন্দির নামে পরিচিত। পাহাড়পুর খননে আবিষ্কৃত মন্দিরটি তাই সার্বিক ভাবে সর্বোতভদ্র শ্রেণিরই অন্তর্ভুক্ত।
তীর-ধনুক, পোড়ামাটির ফলক, পাহাড়পুর
বিহারের বহির্ভাগের সহাপনাসমূহ বিহারের দক্ষিণ দেয়াল থেকে ২৭মি. দূরে ৩২ মি দ্ধ ৮ মি পরিমাপের একটি উন্মুক্ত মঞ্চ অবস্থিত। মঞ্চটি বিহারের বহির্দেয়ালের সমান্তরালে প্রসারিত। এটি সংলগ্ন ভূমি হতে প্রায় ৩.৫ মিটার উঁচু এবং বিহারের ১০২ নং কক্ষ থেকে একটি উঁচু বাঁধানো পথ দিয়ে এতে যাওয়া যায়। এই উঁচু পথটি ৫মি প্রশস্ত। এই উঁচু পথ ও বিহার দেয়ালের মাঝখানে দেয়াল সমান্তরালে একটি ধনুকাকৃতির খিলান পথ আছে। সম্ভবত বিহারের বর্হিভাগে অবাধে যাতায়াতের জন্য এ পথ ব্যবহার করা হতো। এ যুগে ধনুক আকৃতির খিলান নির্মাণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি বাংলার প্রাচীনতম ধনুক আকৃতির খিলান নির্মাণের একটি দুর্লভ উদাহরণ। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, মুসলমানদের আগমনের পূর্বেই প্রাচীন ভারতে খিলান নির্মাণ কৌশল জানা ছিল। মঞ্চের দক্ষিণ দিকে ১.২ মি. ব্যবধানে সারিবদ্ধভাবে ৩০ সেমি চওড়া ও ১.৩০ মিটার লম্বা অনেকগুলো পানি নিষ্কাশনী রয়েছে। মঞ্চটি সম্ভবত শৌচাগার ও স্নানাগার উভয় রূপেই ব্যবহূত হতো।
স্নানঘাট বিহারের দেয়াল হতে প্রায় ৪৮ মিটার দূরে দক্ষিণ পূর্ব কোণে একটি স্নানঘাট আছে। এ ঘাট বিহারের দক্ষিণ দেয়ালের হুবহু সমান্তরাল নয়, কিছুটা উত্তরমুখী। ঘাটের দুই পাশের সমান্তরাল দুটি দেয়ালে খাড়া ইট ব্যবহার করা হয়েছে এবং তা কংক্রিট দিয়ে মজবুত করা হয়েছে। ঘাটটি ৩.৫ মি. প্রশস্ত এবং সর্বোচ্চ ধাপে ইটের গাঁথুনীর সাথে বৃহৎ প্রস্তরখন্ডও ব্যবহার করা হয়েছে। ঘাট ক্রমে ঢালু হয়ে প্রায় ১২.৫ মি. নিচে নেমে গেছে এবং সর্বশেষ স্তর চুনাপাথর দিয়ে বাঁধানো হয়েছে। ঘাটে বালির এক পুরু স্তর দেখা যায়। বালির এই স্তর অতীতে এখানে কোন নদীর অস্তিত্ব নির্দেশ করে। স্থানীয় প্রবাদ এই যে, রাজা মহিদলনের কন্যা সন্ধ্যাবতী প্রতিদিন এই ঘাটে স্নান করতেন। তিনি এই ঘাটে ঐশ্বরিক উপায়ে বিখ্যাত সত্যপীরকে গর্ভে ধারণ করেন। সে অনুযায়ী ঘাটটি সন্ধ্যাবতীর ঘাট নামে পরিচিত।
গন্ধেশ্বরী মন্দির স্নানঘাট থেকে প্রায় ১২.২ মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত স্থাপত্য নিদর্শনটিকে স্থানীয়ভাবে গন্ধেশ্বরীর মন্দির বলা হয়। মন্দিরের সম্মুখ দেয়ালে ব্যবহূত ইটে পদ্ম ও অন্যান্য ফুলের প্রতিকৃতি এবং গাঁথুনীতে ব্যবহূত উপাদান থেকে মনে হয় মুসলমান যুগের প্রথমদিকে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরটি ৬.৭ মি. দীর্ঘ ও ৩.৫ মি. প্রস্থ বিশিষ্ট একটি চতুষ্কোণ হলঘর। মন্দিরের প্রায় মধ্যস্থলে ইট নির্মিত অষ্টকোণাকার একটি স্তম্ভের নিম্নাংশ রয়েছে। মন্দিরের পশ্চিম দেয়াল থেকে বাইরের দিকে উদগত ১.৫ মি. বর্গাকৃতির ছোট কক্ষটি পূজার স্থান ছিল। তাছাড়া হলঘরের চারটি কুলুঙ্গিতেও মূর্তি স্থাপনের ব্যবস্থা আছে। মন্দিরের সামনে ৭.৩ মিটার ব্যাস বিশিষ্ট একটি চত্বর আছে। এই চত্বরের মেঝের ইট খাড়া ভাবে গাঁথা।
স্বাধীনতোত্তরকালের খনন বিহারের কক্ষে দীক্ষিতের আবিষ্কৃত মেঝে ছাড়াও স্বাধীনতোত্তর কালের খননে দুটি নতুন এবং অপ্রত্যাশিত নিদর্শন উন্মোচিত হয়েছে। প্রথমত দীক্ষিতের মূল (?) বিহারের নিচে অপর এক যুগের বিহারের ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়েছে, যা সম্ভবত বিহারের প্রথম যুগের সাথে সম্পৃক্ত। উন্মোচিত নতুন নিদর্শন থেকে ধারণা করা যায় যে, প্রথম যুগে বিহারের আয়তন একই ছিল এবং বহির্দেয়াল ও সম্মুখ দেয়াল একই সারিতে ছিল। প্রথম যুগের নির্মাতারা বেশ কিছু সময় এ বিহার ব্যবহার করেছিল এবং পরবর্তী সময়ে প্রথম যুগের মেঝে অপসারণ করে ও কক্ষ বিভাজিকা দেয়াল নষ্ট করে নুতন দেওয়াল নির্মাণ এবং ভিক্ষু কক্ষসমূহের বিন্যাসে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। এ পুনর্নির্মাণকালে তারা পূর্ববর্তী বিভাজিকা (পার্টিশন) দেয়াল সম্পূর্ণ ধ্বংস করে নতুন দেয়াল নির্মাণ করে। আবার পুরাতন দেয়ালের উপরের অংশ অপসারণ করে নিম্নাংশের উপর নতুন দেয়াল নির্মাণ করে। পূর্ববর্তী যুগের কক্ষগুলির অভ্যন্তরীণ পরিমাপ ছিল ৪.৮৭ মি দ্ধ ৩.৯৬ মি। অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে প্রতিভাত হয় যে মূল বিহারের কক্ষগুলি আয়তনে পরবর্তী কালের বিহার বা দীক্ষিতের প্রথম (?) যুগের বিহারের কক্ষগুলির চেয়ে বড় ছিল। ফলে পরবর্তীকালে বিহারে কক্ষ সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
বুদ্ধ, ব্রোঞ্জমূর্তি, পাহাড়পুর
দ্বিতীয়ত, কিছু এলাকায় বিহার এবং মন্দিরের নিচে স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ (ইটের দেয়াল, মেঝে, পোড়ামাটির কুয়া) এবং সাংষ্কৃতিক দ্রব্যাদি (প্রচুর পরিমাণ মৃৎপাত্রের টুকরা) উন্মোচিত হয়েছে। দেয়ালগুলির সাথে মন্দির বা বিহারের স্থাপত্যিক কাঠামোর কোন সম্পর্ক নেই। খুবই সীমিত পরিসরে দেয়ালগুলি উন্মোচিত হওয়ায় এদের প্রকৃতি সম্পর্কে কোন ধারণা করা যায় না। উল্লেখ্য যে, দীক্ষিত বিহারের ভিক্ষু কক্ষগুলিতে তিনটি এবং কেন্দ্রীয় মন্দিরে চারটি বসতি যুগের নিদর্শন আবিষ্কার করেছিলেন। সাম্প্রতিক খননে বিহারে আরও একটি যুগের নিদর্শন আবিষ্কৃত হওয়ায় বিহারের ৪ যুগের সাথে মন্দিরের ৪ যুগের সামঞ্জস্য পাওয়া যায়। এখন প্রশ্ন হলো সাম্প্রতিক আবিষ্কৃত প্রথম যুগের বিহার এবং দীক্ষিতের আবিষ্কৃত বিহারের মধ্যে কোনটি ধর্মপাল নির্মাণ করেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা খুবই প্রয়োজন যে, দীক্ষিত মনে করতেন মূলত পাহাড়পুরে একটি জৈন বিহার ছিল যার কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না। এই জৈন প্রতিষ্ঠানটির উপর পরবর্তীকালে ধর্মপাল কর্তৃক সোমপুর মহাবিহার প্রতিষ্ঠিত হয়। দীক্ষিতের এই মত পরবর্তী অনেক গবেষক সমর্থন করেছেন। তবে দীক্ষিতের আবিষ্কৃত বিহারের নিচে সম্প্রতি উন্মোচিত ধ্বংসাবশেষ জৈন বিহারের অংশ কিনা তা বিহারের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক খননের পরই নিশ্চিত করে বলা যেতে পারে।
অস্থাবর প্রত্নবস্ত্ত পাহাড়পুর বিহার থেকে আবিষ্কৃত অস্থাবর প্রত্নবস্ত্তসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরত্বপূর্ণ হল প্রস্তর ভাস্কর্য, পোড়ামাটির ফলকচিত্র, তাম্রশাসন, উৎকীর্ণ লিপিসহ প্রস্তরখন্ড, মুদ্রা, চূনাপাথরের মূর্তি, ধাতব মূর্তি, মৃৎপাত্রের টুকরা ইত্যাদি। মন্দিরের চতুর্দিকে বেষ্টন করে ৬৩টি প্রস্তর মূর্তি আছে। বৌদ্ধ দেবতা পদ্মপাণির মূর্তি ছাড়া আবিষ্কৃত অন্য সব মূর্তিগুলি হিন্দু দেবদেবীর। এই বিরাট বৌদ্ধ বিহারে এতগুলি ব্রাক্ষ্মণ্য দেব-দেবীর মূতির্র উপস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে। মনে হয় এ স্থানের পূর্বের কোন বা পার্শ্ববর্তী কোন স্থাপনা থেকে মূর্তিগুলি সংগ্রহ করে প্রধান মন্দিরের ভিত্তিভূমিতে স্থাপন করা হয়েছিল।
প্রস্তর মূর্তিগুলো বিভিন্ন সময়ের এবং গঠনশৈলী ও শৈল্পিক উৎকর্ষতার ভিত্তিতে এগুলিকে মোটামোটি তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মূর্তিতে কৃষ্ণের জীবনের বিভিন্ন দৃশ্য স্থান পেয়েছে। তাছাড়া রামায়ণ ও মহাভারত-এর অতীব জনপ্রিয় উপাখ্যান এবং জনজীবনের বিভিন্ন ঘটনাবলি চিত্রিত হয়েছে। এ সমস্ত প্রস্তর ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য এবং বাহ্যিক রূপ স্থূল এবং কখনও কখনও বেশ অপরিণত এবং এগুলির নির্মাণের আনুপাতিক সামঞ্জস্যের অভাব রয়েছে। এ সব ভাস্কর্য নির্মাণ কৌশলের দিক দিয়ে স্থূল ও অপরিপক্ক হলেও এর সামাজিক বিষয়বস্ত্ত প্রগাঢ়ভাবে মানবতাবোধ ও ব্যাপক কর্মতৎপরতার পরিচায়ক এবং শৈল্পিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় শ্রেণির ভাস্কর্যগুলিতে সাধারণ নির্জীবতা বা কাঠিণ্য থাকা সত্ত্বেও কিছু মূর্তিতে সক্রিয়তা এবং গতিশীলতার ছাপ রয়েছে। সে হিসেবে এ জাতীয় মূর্তিগুলি প্রথম ও তৃতীয় শ্রেণির মূর্তিগুলির মধ্যে সমন্বয় রক্ষাকারী বলা যায়। এগুলি পূর্বাঞ্চলীয় গুপ্ত রীতির ঐতিহ্য বহন করে। তৃতীয় শ্রেণির ভাস্কর্যসমূহে ধ্রুপদী গুপ্ত রীতির বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন মূর্তি গঠনের স্বাভাবিক কমনীয়তা, সূক্ষতা ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়। এছাড়াও প্রথম শ্রেণি ও অপর দুই শ্রেণীর মূর্তিগুলির ভঙ্গি, বিষয়বস্ত্ত, প্রকৃতি বা ধাঁচ ইত্যাদির মধ্যে প্রচুর পার্থক্য বিদ্যমান। অপর দুই শ্রেণীর ভাস্কর্যসমূহে সাধারণত ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্মের বিভিন্ন শ্রেণির দেব দেবীর মূর্তির প্রাধান্য দেখা যায়। এ সমস্ত ভাস্কর্য শিল্পে ধূসরাভ সাদা দাগ বিশিষ্ট বেলে পাথর এবং ব্যাসাল্ট ব্যবহার করা হয়েছে। দেয়ালে সংস্থাপিত মূর্তি ছাড়া খননে যেসব মূর্তি আগলাভাবে পাওয়া গেছে তম্মধ্যে ভগ্ন অবস্থায় প্রাপ্ত শক্তির সাথে দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ হেবজ্র মূর্তিটি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।
পোড়ামাটির ফলক মন্দিরের দেয়ালগাত্র অলঙ্করণে পোড়ামাটির ফলকচিত্রের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। এখনও ২০০০-এরও বেশি ফলকচিত্র মন্দির গাত্রে শোভা পাচ্ছে। এছাড়া খননে প্রায় ৮০০ ফলকচিত্র ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় প্রত্নস্থল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। অধিকাংশ ফলকচিত্র মন্দিরের সমসাময়িক। ফলকগুলি মন্দিরে স্থাপনের সময় কোন রকম পরম্পরা রক্ষা করা হয় নি। দেয়ালের বিভিন্ন অংশে সংস্থাপিত ফলকগুলি বিভিন্ন পরিমাপের। কোন কোনটি আকারে বেশ বড় (৪০দ্ধ৩০দ্ধ৬ সেমি), আবার কোন কোনটি মাত্র ১৮ সেমি বর্গাকারের। তবে অধিকাংশ ফলকেরই সাধারণ উচচতা ৩৬ সেমি এবং প্রশস্ততা ২০-২২ সেমি। ধর্মীয় তাৎপর্যপূর্ণ ফলকের সংখ্যা অত্যন্ত অল্প। তন্মধ্যে বৌদ্ধ ও ব্রাক্ষ্মণ দেবদেবীকে সমানভাবে প্রদর্শন করা হয়েছে। এগুলি হলো বিভিন্ন ধরনের শিব মূর্তি ছাড়া ব্রহ্মা, বিষ্ণু, গণেশ, সূর্য ইত্যাদি ব্রাহ্মণ্য দেবতার মূর্তি। বোধিসত্ত্ব, পদ্মপাণি,মঞ্জুশ্রী, তারা ইত্যাদি মহাযান মতবাদের বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তিও মন্দিরের গায়ে প্রচুর রয়েছে। বিখ্যাত সাহিত্য পঞ্চতন্ত্রের আখ্যান এই লোকশিল্পে অত্যন্ত সজীব হয়ে উঠেছে।
পাহাড়পুরের পোড়ামাটির শিল্পে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত নর-নারীর বিচিত্র কার্যকলাপ সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। শিল্পীরা তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রতি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন এবং সাধারণ মানব জীবনের প্রতিটি কল্পনাযোগ্য বিষয়বস্ত্তই এই শিল্পে স্থান পেয়েছে। অনুরূপভাবে প্রাণীজগৎ সাপ, হরিণ, সিংহ, বাঘ, হাতি, শূকর, বানর, শিয়াল, খরগোশ, মাছ, পাতিহাঁস, রাজহাঁস নিজস্ব ভঙ্গিমায় চিত্রিত হয়েছে। কিন্তু উদ্ভিদজগৎ তুলনামূলকভাবে কমই স্থান পেয়েছে। কেবল পদ্ম এবং কলাগাছই দেখা যায়। বাংলার অত্যন্ত জনপ্রিয় এ শিল্পের মাধ্যমে তদানীন্তন সমাজ জীবনের একটা চিত্র পাওয়া যায়।
উৎকীর্ণ লিপি পাহাড়পুরে আবিষ্কৃত একটি তাম্রশাসন এবং কিছু শিলালিপির আবিষ্কার এই বিহারের বিভিন্ন যুগের কাল নির্ণয়ে বিশেষ সহায়তা করেছে। বিহারের উত্তর-পূর্ব কোণে প্রাপ্ত তাম্রশাসনটি ১৫৯ গুপ্তাব্দের (৪৭৯ খ্রিস্টাব্দ)। এই তাম্রশাসনে উল্লেখ রয়েছে যে এক ব্রাহ্মণ দম্পতি বটগোহালীতে অবস্থিত বিহারে অইতের পূজা এবং বিশ্রামাগারের জন্য কিছু ভূমি ক্রয় ও দান করেন। এই বিহারের প্রধান ছিলেন বিখ্যাত জৈন গুরু গুহনন্দী। খ্রিস্টীয় ৫ম শতকের এই বিহার নিশ্চিতভাবে এ অঞ্চলের একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ছিল। উল্লেখ্য যে, বৈগ্রামে প্রাপ্ত ১২৮ গুপ্তাব্দের (৪৪৮ খ্রিস্টাব্দ) অপর একটি ভগ্ন তাম্রশাসনেও বটগোহালীর উল্লেখ আছে। পাহাড়পুর থেকে ৩০ কিমি উত্তরে অবস্থিত বৈগ্রামে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে বটগোহালীর উল্লেখ থেকে ধারণা করা যায় বটগোহালী এবং বৈগ্রাম এ দুটি স্থান একে অপর থেকে বেশি দূরে ছিল না। খ্রিস্টীয় সাত শতকে বাংলায় নৈরাজ্য চরমে পৌঁছলে বটগোহালীর গুহনন্দী বিহার পুন্ড্রবর্ধনের অন্যান্য জৈন প্রতিষ্ঠানের ন্যায় নিশ্চতভাবে একই পরিণতি ভোগ করে। অবশেষে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আট শতকে বাংলায় পাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলে ধর্মপাল কর্তৃক সোমপুরে বিরাট মন্দিরসহ বিশাল একটি বিহার নির্মিত হয়। দীক্ষিত মনে করেন যে, নব নির্মিত বৌদ্ধ বিহারের ভিক্ষুরা জৈন বিহারের অধীনস্থ জমি ভোগ করার এবং সেই সাথে মূল দলিলও কাছে রাখার রাজকীয় অনুমোদন পায়। তাঁর মতানুসারে, এই অনুসিদ্ধান্তই বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এ তাম্রশাসন পাওয়ার ব্যাখ্যার জন্য যথেষ্ট।
প্রাপ্ত স্তম্ভলিপিসমূহে বুদ্ধ অথবা ত্রিরত্নের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত দান সংক্রান্ত তথ্যের উল্লেখ রয়েছে। খ্রিস্টীয় দশ থেকে বারো শতকের মধ্যে শিলাস্তম্ভগুলি নির্মিত। প্রায় সকল দাতাদের নামের শেষে ‘গর্ভ’ উপাধি দেখা যায়, যেমন অজয়গর্ভ, শ্রীগর্ভ, দশবলগর্ভ। কেবল একটি ভগ্ন লিপিতে এক দাতার নাম এর উপাধি ‘নন্দী’ উল্লেখ রয়েছে। সম্ভবত পাহাড়পুর বিহারে ভিক্ষুদের ধারাবাহিক বা পর্যায়ক্রমিক বাস ছিল।
স্টাকো পাহাড়পুর থেকে চুন বালির সংমিশ্রণে নির্মিত কয়েকটি মাথা পাওয়া গেছে। কিন্তু এখানে এই শিল্প গান্ধার শিল্পের মত তত উন্নতি লাভ করে নি। পাহাড়পুরে প্রাপ্ত সকল বুদ্ধের মাথার সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো চোখের প্রসারিত পাতা এবং কোন কোনটির মাথায় কোকড়ানো চুলের থোকা।
ধাতব মূর্তি পাহাড়পুরে কয়েকটি মাত্র ধাতব মূর্তি পাওয়া গেছে। প্রাক বাংলাদেশ খননে পাহাড়পুরে প্রাপ্ত মূর্তির মধ্যে অলঙ্কৃত হরগৌরী, দন্ডায়মান একটি নগ্ন জৈন মূর্তি, ব্রোঞ্জের বুদ্ধের আবক্ষমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। ধারণা করা হয় বুদ্ধমূর্তিটি দন্ডায়মান বুদ্ধের, তবে অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় বর্তমানে কেবল উরুদেশ থেকে উর্ধ্বাংশ বর্তমানে সুরক্ষিত রয়েছে। বিদ্যমান অংশের পরিমাপ (১.২৭ মিটার) থেকে এও ধারণা করা যায় যে, সমগ্র মূর্তিটি ২.৪০ মিটার উঁচু ছিল। নির্মাণশৈলী এবং প্রাপ্তিস্থানের স্তরগত পর্যালোচনা থেকে মূর্তিটি আনুমানিক নয়-দশ শতকের বলে অনুমাণ করা যায়। বার্মিংহাম জাদুঘরের আর্টগ্যালারিতে প্রদর্শিত বিহারের সুলতানগঞ্জের ব্রোঞ্জের বুদ্ধ মূর্তিটি আলোচ্য মূর্তির মোটামুটি প্রায় সমসাময়িক এবং একই পরিমাপের।
মুদ্রা বিহারের প্রধান তোরণের নিকটবর্তী একটি কক্ষ থেকে ৫টি বৃত্তাকার তাম্র মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। তন্মধ্যে তিনটি মুদ্রা বিশেষ ধরনের। এগুলির উপরের পিঠে অত্যন্ত অনিপুণভাবে একটি ষাঁড় এবং নিচের পিঠে তিনটি মাছ চিত্রিত আছে। বাগদাদের খলিফা হারুন-অর রশিদের একটি রৌপ্য মুদ্রায় ১২৭ হিজরি সনের (৭৮৮ খ্রি.) উল্লেখ রয়েছে। অন্যান্য মুদ্রার মধ্যে ছয়টি শেরশাহ-এর (১৫৪০-৪৫ খ্রি.), ইসলাম শাহ (১৫৪৫-৫৩ খ্রি.)-এর দুইটি, বাহাদুর শাহ (১৬শ শতক)-এর তিনটি, দাউদ খান কররানীর দুইটি, আকবর-এর একটি এবং জৌনপুরের সুলতান হোসেন শাহ শর্কীর একটি মুদ্রা উল্লেখযোগ্য। শেষোক্তটি তাম্রমুদ্রা। অন্যান্য সব মুদ্রাই রৌপ্য। এসব মুদ্রা কিভাবে বিহারে স্থান পেল সে সম্পর্কে নিশ্চিত বলা দুষ্কর।
মুৎপাত্রের টুকরা পাহাড়পুর খননে প্রচুর পরিমাণ এবং বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্রের টুকরা সংগৃহীত হয়েছে। এদের অধিকাংশই আনুমানিক দশ শতকের শেষভাগ থেকে বারো শতকের মধ্যবর্তী সময়ের। পালযুগের সূচনা কালের (আনুমানিক নয় শতক) এক শ্রেণির কিছু মৃৎপাত্রের টুকরা পাওয়া গেছে। পাত্রগুলির নিম্নাংশ অথবা পাশেও আড়াআড়ি রেখার নকশা আছে। কিছু ভিক্ষু কক্ষ থেকে বসানো অবস্থায় কয়েকটি বড় সঞ্চয় পাত্র (একটির ভেতর অপর একটি স্থাপিত) পাওয়া গেছে। কক্ষের এক কোণে তৃতীয় যুগের (দীক্ষিতের দ্বিতীয় যুগ) মেঝে কেটে পাত্রগুলি বসানো হয়েছিল। এসব পাত্র মাটি দ্বারা পূর্ণ ছিল। প্রাকবিহার স্তর থেকে পর্যাপ্ত অখন্ড পিরিচ উদ্ধার করা হয়েছে। এ পাত্রগুলি প্রাক-পাল যুগের (আনুমানিক ছয় থেকে সাত শতক) বলে মনে হয়। সাধারণত মৃৎপাত্রগুলি উত্তমরূপে দগ্ধীভূত এবং রং লাল থেকে পীতাভ সবুজ। এসব মৃৎপাত্রে বন্ধনীয় ন্যায় বা পাত্রের নিম্নাংশ ছাড়া সকল অংশে লাল প্রলেপ রয়েছে। প্রায় সব পাত্রেরই তলদেশ প্রশস্ত এবং মধবর্তী অংশ স্ফীত। কিন্তু বড় সঞ্চয় পাত্রগুলির তলা সূচালো। আধুনিক হাড়ির মতো কিছু পাত্র এবং নলযুক্ত পাত্র বা লোটা ছাড়াও সরু গলা বিশিষ্ট পাত্র এবং মুখসহ চোঙার আকৃতির পাত্রও রয়েছে। এছাড়া প্রচুর ঢাকনা, বড় থালা, পিঁড়ি এবং প্রদীপ পাওয়া গিয়েছে। খননে আবিষ্কৃত অন্যান্য অসংখ্য সাধারণ প্রত্নবস্ত্তর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অনিপুণভাবে নির্মিত কিছু পোড়ামাটির নারীমূর্তি, জীবজন্তুর প্রতিকৃতি, মন্দির চূড়ার ভগ্নাংশ, অগ্রভাগ ছাটা মোচাকৃতি ড্যাগার, চ্যাপ্টা চাকতি, সিলমোহর ও নলাকার গুটিকা। এছাড়া ধাপকৃত পিরামিড, পদ্ম-পাপড়ি, দাবার ছক, অর্ধপ্রস্ফুটিতপদ্মসহ আয়তাকার পদকও সংগৃহীত হয়েছে।
সংরক্ষণ বিহার কাঠামোটি আবিষ্কারের সময় (১৯৩৪) এর অবস্থা খুব খারাপ ছিল না। কিন্তু বিগত অর্ধ শতকে জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার ফলে এর অবস্থার এতই অবনতি ঘটে যে, স্মৃতিচিহ্নের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়ে। জলাবদ্ধতা কেন্দ্রীয় মন্দিরের ভিত্তি, ভিত্তিগাত্রে সজ্জিত প্রস্তর মূর্তি এবং পোড়ামাটির ফলকের ক্ষয় ও বিকৃতি সাধন করতে থাকে। ফলে পাহারপুর বিহার ও মসজিদ নগরী বাগেরহাট সংরক্ষণের জন্য ১৯৭৩ সালে ইউনেস্কোর নিকট আবেদন জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৩ সালে প্রণীত আন্তর্জাতিক মিশন কর্তৃক গৃহীত মহাপরিকল্পনার অধীনে ১৯৮৫ সালে এ প্রত্নস্থল দুটি বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৮৭ সালে ইউনেস্কোর সহায়তায় শুরু হওয়া একটি প্রকল্প তিনপর্বে বাস্তবায়ন করে ২০০২ সলে সম্পন্ন করা হয়। প্রকল্পের আওতায় বিহারের স্থাপত্য কাঠামো সংরক্ষণ, পানি নিষ্কাশন, জাদুঘর ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ প্রভৃতি কাজ সম্পন্ন করা হয়। বর্তমানে (২০১১) অধিদপ্তর কর্তৃক পর্যটন ব্যবস্থার উন্নয়ন, ঐতিহ্য ব্যবস্থাপনা, প্রাচীন ভূমিরূপ সংরক্ষণ ইত্যাদিবিষয় সমাধানকল্পে সম্প্রতি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
(গ্রন্থপঞ্জি KN Dikshit, Memoirs of Archaeological Survey of India, Govt. of India; MS Alam, Paharpur and Bagerhat, Two World Cultural Heritage Sites of Bangladesh, Department of Archaeology, Dhaka. From Banglapidia)

সংবাদটি শেয়ার করুন

আরো সংবাদ পড়ুন

ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট

Theme Customized BY LatestNews