আমরা পাঁচ অন্ধের হাতি দর্শনের গল্পটি জানি৷ পাঁচ অন্ধকে হাতি দেখতে গেল৷ যার হাতে যা ঠেকলো সে সেটাকে ভালমতো উপলব্ধি করলো৷ সবাই নিশ্চিত হয়েই বলল আরে হাতি হল—
যে হাতির পা ধরেছিল সে বলল, ঠিক খাম্বার মতো৷ যে লেজ ধরেছিল সে বলল, ঠিক রশির মতো৷ যে শূঁড় ধরেছিল সে বলল, ঠিক সাপের মতো৷ যে পেট ধরেছিল সে বলল, ঠিক দেয়ালের মতো৷ যে কান ধরেছিল সে বলল, ঠিক কূলার মতো৷ সবাই নিজের দর্শনে অনড়৷ আলাদা অঙ্গ না ধরলে এই পাঁচটি উপাদান মিলালেও হাতি আসবে না৷
কমপক্ষে হাজার বছর আগের ধর্মগ্রন্থগুলোতে একেকটি বিষয়ের বর্ণনা অনেকটাই এরকমই৷ যখন পৃথিবী, আকাশ, মানুষ, আত্মা… ইত্যাদি বহু বিষয়ের ব্যাখ্যাগুলো অন্ধের হাতি দর্শনের মতোই৷ তখন বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডের মানুষও মনে করতো তারাই পৃথিবী, তারাই একমাত্র জনগোষ্ঠী৷ সে মোতাবেকই আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া এমনকি জাপানের আদি বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল৷ মানুষ ব্যাখ্যা তৈরি করতে নিয়ে এসেছে পেট-বানানো গল্প৷ সেই গল্পগুলোর বিবর্তনও ঘটেছে কালক্রমে৷
একটা বিষয় নিশ্চিত যে তারা মনে করতো প্রাণীর দুটো উপাদান৷ একটি নশ্বর শরীর আরেকটি অবিনশ্বর আত্মা৷ আত্মার বিশ্লেষণ করতে হলে শরীর কিভাবে সচল থাকে সেটা উপলব্ধির দরকার ছিল৷ কিন্তু ওই সময় এটা মানুষ বুঝতে শিখেনি৷ তাই আত্মা নিয়ে একেক গ্রন্থে একেক রকম ধারণা দেয়া হয়েছে৷ সেমিটিক ধর্মে বলা হয়, ‘স্রষ্টা আগেই আত্মা সৃষ্টি করে রাখে৷ জন্মের আগে ঢুকিয়ে গর্ভের শিশুর মধ্যে৷ স্রষ্টা আত্মা ছিনিয়ে নিলেই মৃত্যু৷ কবে কখন ও কিভাবে ছিনিয়ে নিবে সেটাও নির্ধারিত৷ পৃথিবী ধ্বংসের পরে পুনর্জিবীত আত্মার বিচার সভা বসবে’৷ বৈদিক তথা হিন্দু ধর্মে বলা হয়, ‘আত্মা ভাল মন্দের কর্মের জন্য পরের জন্মে কোথায় জন্ম নিবে তা কর্মের দ্বারা নির্ধারিত হয়৷ বৌদ্ধ ধর্মে আবার আত্মা ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন প্রাণির মধ্যেও৷ সৎ কর্ম করলে বা বৌদ্ধ ভিক্ষু হলে আত্মা মুক্তি পায় এবং বিলীন হয়ে যায় যাকে বলে নির্বাণ হওয়া৷ আর আজ বিজ্ঞান দেখাচ্ছে কিভাবে জীবন সচল থাকে এবং সেখানে আত্মা অপ্রয়োজনীয়৷
অন্তত এক হাজার বছর আগের মানুষ নিজেদের ভূখণ্ডগুলোকেই ভাবতো দুনিয়া৷ জাপানের দ্বীপগুলো যাকে তারা বলতো নিপ্পন বা সূর্যোদয়ের ভূখণ্ড৷ তারা খবর রাখতো না কোরিয়া বা চীনের৷ অথচ বহু বছর আছে তারাও ছিল একই ভূখণ্ডে৷ ফলে শিন্টো ধর্মের পৃথিবী হল ওই নিপ্পন দ্বীপমালা! দেবতারা থাকতো সমুদ্রে৷ তারা কাদাকেলি করতে করতে সমুদ্রে বিভিন্ন দ্বীপ তৈরি করে৷ সেটাই পৃথিবী৷ এমন একটা বিশ্বাসও দেখি না যেখানে বলা হয়েছে পৃথিবী গোলাকার এবং পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে৷
সেমিটিক গ্রন্থে স্রষ্টা ছয় দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করে৷ বাইবেলে একদিন বিশ্রামের কথা আছে৷ আমরা আজ সপ্তাহে যে একদিন ছুটি পাই সেটা ওখান থেকেই আসা৷ স্রষ্টা সমতল পৃথিবীকে শক্ত রাখার জন্য পেরেক মেরেছে পাহাড়গুলো দিয়ে৷ পৃথিবীর উপর সাতটি আসমান দিয়েছে দৃশ্যমান বা অদৃশ্যমান খুঁটি দিয়ে৷ দুনিয়া সৃষ্টির হাজারো রকমের ধর্মীয় ব্যাখ্যার একটিও মিলে না আজ৷
মানুষ সৃষ্টি নিয়েও হাজারো ব্যাখ্যা৷ হিন্দু ধর্মের সেই বিরাট পুরুষের কথা জানি যিনি খণ্ডবিখণ্ড হয়ে সব কিছু তৈরি করেছেন৷ তার মাথা থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, বুক থেকে বৈশ্য, পা থেকে শূদ্র তৈরি হয়েছে৷ নাড়িভূড়ি থেকে অন্যসব প্রাণি-উদ্ভিদ উৎপন্ন হয়৷ সেমিটিক ধর্ম বলে স্রষ্টা নিজে একজন পুরুষ ও একজন নারী সৃষ্টি করেন৷ স্রষ্টার কথা না শোনায় তিদের স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে পাঠায়৷ বাকি ধর্মগুলোতে একেকটায় একেক রকম বিশ্বাস৷ কোনটায় বলা হয়েছে এক দানবের বগলের দুই তলা থেকে একজন পুরুষ ও একজন নারী সৃষ্টি হয়৷ ওয়াক! কোথাও বলা হয়েছে, দেবতারা দাস তৈরি করতেই মানুষ তৈরি করেন৷ হাজারো ব্যাখ্যা৷ আবার মিলগুলোর মধ্যেও প্রভেদ অনেক৷ আদম-হাওয়া, এডাম-ইভ বা মনু-শতরূপা পুরোপুরি মিলবে না৷ অথচ বিজ্ঞান বলছে মানুষ এসেছে বিবর্তনের পথ ধরে৷
৪৩০০ টি ধর্ম বিশ্বাসের কোনটিতেই সঠিক ব্যাখ্যা মিলে না৷ আবার ব্যাখ্যাগুলোকে একত্রিত করলেও মিলে না৷ বিশ্বাসে পাওয়া তথ্যগুলো বিজ্ঞানের চোখে নিছকই গালগল্প!