জীবনের গল্প
-ডা. মোজাহিদুল হক
পর্ব-৫৯
আকাশ আজ তারায় তারায় ঝকঝক । পূর্ণিমা কাছেই বোধ হয় । ফিনফিনে মসলিনের মতো চাঁদের কিরণ ছড়িয়ে আছে আমার গায়ে , মুখে । পাশের বাড়ীর ছাদ বাগানের গাছেদের মাথায় রুপোলি সরের মতো জ্যোৎস্নার ঢেউ । সব দুঃখ ছাপিয়ে একটা ভালো লাগা । সমস্ত পার্থিব অস্তিত্ব যেন মুছে যাচ্ছে , তুচ্ছে হয়ে যাচ্ছে এই ভালোলাগার কাছে । বর্ষা শেষ হয়ে এলো । অতিথি শিল্পীর ভূমিকায় ঢাকা শহরের কোন কোন এলাকায় একবার করে আসে কয়েক মিনিটের জন্য তারপর উধাও । আমাদের এ দিকে বোধহয় তার রোল পড়েনি তাই আসছে না । গরমে হা হয়ে যাচ্ছে মানুষ । দিনে চার পাঁচবার করে লোডশেডিং হচ্ছে । টুক করে দরজা খুলে আবার ব্যলকনিতে এসে দাঁড়ালাম , দরজাটা বন্ধ করে সিগারেট ধরালাম । ইদানিং কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না । সবার একই আলোচনা ঘুরে ফিরে রাশিয়া – ইউক্রেন যুদ্ধ । যুদ্ধ বা মৃত্যুর আলোচনা আমাকে একটুও টানে না । আমি দেখি রাস্তায় হেঁটে যাওয়া মানুষ । মানুষের হাঁটাচলা অন্যরকম যেন । অশান্ত । যেন চাপা উত্তেজনায় টান টান । আবার এরাই বন্ধের দিন বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে রাস্তার ধারে চটপটি খেতে খেতে হি- হি করে প্রাণ খুলে হাসে । আমার কাছে এদের রোবট মনে হয় ।যেন এক একটা দম দেয়া পুতুল। জিনিসের দামে মানুষ নাকাল।
সকালে বেরিয়েছি বাসা থেকে, যাব হাইকোর্ট। বন্ধু সাধনের সাথে দেখা করা দরকার। গেটে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে, হয়তো প্রতিক্ষা করছে কারো। লোকটাকে দেখে আমার হাসি পেয়ে গেল। কি বিদঘুটে চুলের ছাঁট! জুলপি চাঁছা, ব্যাক ব্রাশ করা চুল ঘাড় অবধি লতানো, রাস্তায় সস্তা সিনেমার পোস্টারের নায়কদের মতো। মাথায় তেল ও মেখেছে অঢেল। তেলের উগ্র গন্ধে বাতাস ম ম করছে। প্রচুর গরম পড়েছে আজ। মোটরসাইকেলটা পার্ক করেছি অম্নি রাজ্যের সব মেঘ ভিড় করেছে আকাশে। শুরু হলো বাতাস, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল রোদে পোড়া শহরের বুকে। দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে ওঠলাম। বৃষ্টি বেড়েই চলল। অগত্যা সেখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকা ছাড়া কোন গত্যান্তর রইলো না! সাধন হাত নেড়ে ওর মক্কেলদের কি যেন বোঝাচ্ছে। আমি বৃষ্টির ছাট গায়ে মেখে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে মানুষ দেখি। কে যে ধান্ধাবাজ আর কে যে সত্যিকারের ভিকটিম মুখাবয়ব দেখে বুঝতে চেষ্টা করছি। গলা শুকিয়ে আছে তেষ্টায়, জল খাওয়া দরকার। দোকান আছে বটে একটা। জলের বোতল পাওয়া যাবে কিনা কে জানে! না, পাওয়া গেল। ঢকঢক করে গলায় ঢালতেই শরীর চাঙ্গা হয়ে ওঠলো। মানুষের মধ্যে একটা অজানা অস্থিরতা।
কিছু কিছু মানুষের কন্ঠস্বরে এত স্নেহ মাখানো থাকে! স্নেহের যাদু সহজেই বশ করে ফেলতে পারে অন্যকে। আমার বন্ধু এডভোকেট সাধন তাদের মধ্যে একজন। ওর সাথে কিছুক্ষন আড্ডা দিলে এমনিতে মন ভাল হয়ে যায়। টানা দেড় ঘন্টা পরে বৃষ্টি থামল। সাধনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় জল জমেছে হাঁটু অব্দি। কি যে ছাই উন্নয়ন হচ্ছে! এই বৃষ্টিতে যদি রাস্তায় জল জমে তবে সিটি কর্পোরেশন করছে টা কি? বাচ্চাদের স্কুল ছুটি হয়েছে, সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হয়েছে ওরাই। নোংরা জলে হাঁটু অব্দি ভিজিয়ে ঘরে ফিরছে। কি এক অদ্ভুত দেশে বসবাস আমাদের। কেউ কোন প্রতিবাদ করছে না। ইদানিং বন্ধুদের অনেককেই এভোয়েড করছি। অনেকেই সাময়িক সঙ্গি হতে পারে ; বন্ধু নয়। প্রায় সকলেরই কোন না কোন হ্যাংলামি আছেই। এরা ইনিয়ে বিনিয়ে সমাজের অসংগতি মেনে নিয়ে শুধুমাত্র নাটবল্টু হবার পরামর্শ দেয়। এদের এসব স্লেভ মেন্টালিটি দেখলেই কেমন মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কিছু কিছু মানুষের জন্য পৃথিবীটাই আর বাসযোগ্য থাকবে না। সমাজে ইদানিং কিছু মানুষের দেখা পাচ্ছি এরা সারাক্ষণ মানুষকে ধর্মের নামে উল্টা পুল্টা বয়ান দেয়, পরক্ষনে জানা যায় এরাই নানা রকম আকাম কুকাম করে বেড়াচ্ছে। গত কয়েকদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম এক লোক প্ল্যাকার্ড লিখে দাঁড়িয়ে আছে, ছোট পোশাক পরা মহিলাদের দেখলে নাকি ওর প্যান্ট ভিজে যায়! তিন চার বছরের বাচ্ছা মেয়েকে দেখলেও এদের এমনই হয়। যাদের এত দ্রুত প্যান্ট ভিজে তাদের মন ও মগজ দুটোরই চিকিৎসা জরুরী। এরা তো সমাজের জন্য রীতিমতো হুমকি।
শাসক গোষ্ঠী যাচ্ছে তাই করে যাচ্ছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে জন জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। নিত্যপন্যের দাম মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। যারা শাসন করে তারা যে কখন শাসিতের বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দেয়, নিজেরা জানতেও পারে না। শ্রীলঙ্কার চেহারা এখন কি? রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যা সত্যি সমাজের ক্ষেত্রে ও তাই। সমাজে কিংবা ব্যক্তি পর্যায়ে যে পরিবর্তন বা বদল এটা তো বদল নয়, ভাঙন। পাহাড়ের ধসের মতো। পাহাড়ের ধস তো আকস্মিক ভাবে হয়না, ভূমি ক্ষয় শুরু হয় অনেক আগে থেকেই। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন রাস্তার নিরীহ মানুষের পকেটে মাদক ঢুকিয়ে দিনে দুপুরে তুলে নিয়ে মামলা দিচ্ছে এত বড় অনিয়ম নিশ্চয়ই একদিনে হয়নি। ভূমিক্ষয়ের মতো ভিত নড়ছে শাসকদের, তারা টের পাচ্ছে না। শাসকদের অনিয়ম দূর্নীতি এবং দুঃশাসনের ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ধ্বংসের বীজ বুনে চলেছে। যে দুঃশাসন থেকে এই বীজের আবির্ভাব, সেই দুঃশাসনের ছায়া তো বীজের ওপর পড়বেই। এইযে মানুষের মধ্যে যে অসন্তোষ সেটা শাসকরা টের পাচ্ছে না । তারা মনে করছে মানুষ কিছু বলছে না। নীরবতাও কখনো কখনো শব্দের চেয়ে বেশি মুখর হয়ে ওঠে। টিভিতে নিউজ দেখছিলাম, আকাশ অন্ধকার হয়ে আচম্বিতে দমকা হাওয়া উঠলো। সোঁ সোঁ আওয়াজের সাথে ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করলো। তালবেতাল বাতাসে সারাদিনের গুমোট ভাব কেটে গেছে পুরোপুরি। আকাশচেরা আলোয় ঝলসে যাচ্ছে আশপাশ। মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। আকাশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে বিদ্যুৎ শিকড় ছড়িয়ে দিচ্ছে। মুহুর্তের জন্য সব আলোকিত আবার পর মুহুর্তেই সন্ধ্যার মতো অন্ধকার।
ঝুপ করে আলো নিভে গেল। লোডশেডিং। খাঁচার টিয়াটাকে বুলি শেখানোর চেষ্টা করছি। রোজই চালাই। পাখি কথা বলবেনা, আমি বলাবই, আমাদের এ এক নিভৃত খেলা। কোরবানির ঈদের সময় অহনাদের গ্রামের বাড়ি থেকে এই টিয়াটাকে নিয়ে এসেছিলাম। পাখিটা খুব বাচ্চা নয়, পাকা সবুজ রঙ, পরিণত ডানা। তখন থেকে আজ অব্দি পাখিটা কোন কথাই বলছেনা। মাঝে মাঝে কেবল একটা কর্কশ ডাক ছাড়া কোন কিছু বলে না। পোষও মানেনি, খাঁচা খুলে খাবার দিতে গেলে ক্যাঁ ক্যাঁ করতে থাকে। অহনার সামনে আমার বেইজ্জতির একশেষ। হয়তো ওর মনে এখনো ফেলে আসা নদী জঙ্গল কিংবা আকাশের ছবি। কুৎসিত আওয়াজ করে মেঝেতে বসল টিয়া। ঝটপট করছে। একবার ঘাড় বেঁকিয়ে দেখল আমাকে, আবার সরে ঝুলছে খাঁচার গায়ে। ঘনঘন চোখ টিপছে। বন্ধের দিনে অহনা অন্যমনস্ক হয়ে সোফা ঝাড়ে, ঘরের কোণের ঝুল ঝাড়ে। বুয়া যত্নকরেই ঘর ঝাড়ে, তবু যেন অহনার ঠিক তৃপ্তি হয় না। ক্যাবিনেটের গায়ে, সেন্টার টেবিলে সর্বত্রই যেন অদৃশ্য ধুলোর কণা দেখতে পায় অহনা। এগুলোই কি সংসারের মায়া? অহনা রাতে শোয়ার আগে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে এ্যালার্জীর ক্রিম মাখছে। এমনিতে খুব একটা প্রসাধন সে কোনদিনই করে না। বাইরে বেরুলে মুখে একটু হালকা ক্রিম কিংবা ফেসপাউডার, ছোট টিপ, আলতো লিপস্টিক, কিছু ছোটখাটো গহনা এতটুকুই ওর সাজগোজ।
একটা সিগারেট ধরালাম। অহনা ফেরেনি এখনো। অহনা থাকলে একদফা চায়ের কথা বলা যেত। ওর ফেরার সময় হয়েছে। যতক্ষণ না ফেরে ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। অবশ্য ইচ্ছে করলে আমি নিজেও যে কিচেনে ঢুকে চা টা বানিয়ে নিতে পারি না তা নয় কিন্তু অহনার হাতের চা টা না খেয়ে বেরুলে সারাক্ষণ মনে হয় কি যেন খাইনি। বিয়ের পর কিছুদিন শখ করে কিংবা অহনাকে রিলিফ দেবার জন্য এটা ওটা করতাম। সেও হয়ে গেল অনেকদিন। ক্রমশ আলস্য এসে কব্জা করে নিয়েছে আমাকে। মাথাটা ভার হয়ে আছে। ফ্রিজের ঢালা খুলে বোতল থেকে জল ঢেলে পুরো এক গ্লাস জল খেলাম। আপাতত চায়ের ইচ্ছা বাদ দিলাম। টুক করে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল অহনা। মুখে হালকা হাসি। কাঁধের ব্যাগ রেখে চায়ের কেটলী চুলায় রেখে কাপ নামাল। কি যত্ন করে আমার জন্য চা ঢালছে। আমার বেরুতে হবে। চেম্বারে রোগীরা বসে আছে। কত কত শারীরিক কষ্ট মানুষের! নিমেষে রোগীদের সমস্ত কষ্ট দুর করার ক্ষমতা ডাক্তারদের হাতে নেই।নিয়মিত সঠিক চিকিৎসায় তাদের কষ্ট ধীরে ধীরে সেরে যায়। গ্রামের সহজ সরল মানুষ হার্টের সমস্যা নিয়ে আসেন, তারা ভাবেন কয়েক দিনেই বুঝি সেরে যাবে হৃদরোগ। ওদের বোঝানো মুশকিল। কত জনের কত রকম গল্প।
ভোলার মনপুরার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এক বৃদ্ধ কৃষক এসেছেন। ইসকেমিক হার্ট ডিজিজের রোগী। গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা মনে করে গ্রামের ফার্মেসী থেকে ঔষধ কিনে খাচ্ছিলেন। কিন্তু কোন প্রতিকার না পেয়ে ঢাকায় এসেছেন চিকিৎসা নিতে। একটু যেন আড়ষ্ট বোধ করছেন। স্বাভাবিক করার জন্য জিজ্ঞেস করলাম চাচা কি কি আবাদ করেন? এবার যেন মুখে একটু হাসি ফুটলো।আড়ষ্টতা ভেঙ্গেই বললেন, ধান সরিষা সবই আবাদ করি। কিন্তু এবার কম কম করেছি আবাদ। আমি কৌতূহল নিয়ে বললাম, কেন চাচা কম করলেন কেন? বৃদ্ধ ওমর আলী বলেন, সারের দাম, কীটনাশকের দাম আকাশ ছোঁয়া। বৃষ্টির অভাবে সেচ দিতে খরচ বেশী পড়ছে, ঠিকমত বিদ্যুৎ না থাকায় সময় মত সেচও দেয়া যাচ্ছেনা, তাই আবাদ করে কি করব? ফসলের ন্যায্য মুল্য তো পাওয়াও যাচ্ছে না। আমি বললাম, আপনারা আবাদ না করলে দেশে তো খাদ্য সংকট হবে চাচা। বৃদ্ধ মায়া ভরা চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। হাসতে হাসতে বললাম আপনার বাড়ীতে বেড়াতে যাব নেবেন তো? বৃদ্ধ হাত ধরে বললেন, আমার মতো গরীবের বাড়ীতে আপনি যাবেন? হ্যাঁ যাব আপনি নেবেন কিনা বলেন! উনার স্ত্রী এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন,মাথার ঘোমটাটা টেনে বলে উঠলেন, আপনার মতো মানুষ আমাদের বাড়ী যাবেন এতো আমাদের সৌভাগ্য। হায় রে বাংলার কৃষি, হায় রে বাংলার কৃষক। প্রেসক্রিপশন লিখে হাতে দিলাম উনার। বেরিয়ে যাচ্ছেন পঞ্চাশ বছর ধরে এদেশের মানুষের মুখে অন্ন যোগানো এক বীর। যাদের চাহিদা খুব সীমিত। আমি তাকিয়ে আছি উনাদের চলার পথে।