ভারতে মুসলিমরা থেকে গেল কেন? এ নিয়ে গবেষণা অনেক হয়েছে এবং সেসব কারণও সত্য। ছোট বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে এতো মুসলিমের সংকুলানও হতো না। ধর্মীয় বিভেদ ও অসহনশীলতা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠদের সম্পত্তির লোভ দুই দেশেই তো ছিল। কলকাতা কেন্দ্রিক বাণিজ্য ও চাকরিও ছিল। তাতেও এতোটা বিপর্যয় হওয়ার কথা নয়। অল্প কিছু হিন্দু কমতে পারতো। তাই বলে ৭৫% হিন্দুই দেশ ছাড়বে? বিপরীতে ভারত থেকে খুব কম মুসলিমই বাংলাদেশে এসেছেন। যারা এসেছেন তাদের অধিকাংশ আবার জমি বদল করে এসেছেন। কিন্তু বহু হিন্দুই জমি-জমা ও বাড়িঘর ফেলে রেখেই চলে গিয়েছে। বাংলাদেশে ১৯০১ সালে এক তৃতীয়াংশ হিন্দু ছিল এখন সাড়ে ১২ ভাগের এক ভাগ!
এর আর একটি কারণ হল হিন্দু ধর্মের আভ্যন্তরীণ সংকট! হিন্দু ধর্মে চতুবর্ণ প্রকৃতপ্রস্তাবে পঞ্চবর্ণ প্রথাও এর অন্যতম কারণ। আবার বর্ণের ভিতরেও আছে নানারকম ঝামেলা। একেক জন একেক দেবতাকে প্রধান ধরে পূজা-আরাধনা করে। বৈষ্ণবদের মধ্যেও আবার রয়েছে বহুবিভক্তি। শাক্তরাও বহু ধারায় বিভক্ত। শক্তির দেবি হিসেবে কেউ দুর্গা, কেউ কালী, কেউ ছিন্নমস্তা, কেউ চণ্ডির আরাধনা করেন। আবার এক দুর্গাদেবীরই একেকজন একেকভাবে পূজা করে। কেউ কাত্য়ায়নী, কেউ অষ্টভূজা, কেউ চতুর্ভূজা, কেউ দুর্গতিনাশিনী ইত্যাদি পূজা করে। দুর্গার নাম পার্বতী। পার্বতীর আবার নয়টি ভিন্নরূপ রয়েছে- শৈলকন্যা, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রী, মহাগৌরী এবং সিদ্ধিদাত্রী ৷ এতো বিভক্তি হিন্দুদের মধ্যে জন্ম দিয়ে রেখেছিল অনৈক্য। সর্বভারতে মুসলিমদের আরাধনার সিস্টেম একই রকম। নামাজ একভাবেই পড়তে হয়, রোজাও একইভাবে পালন করতে হয়। ফলে তাদের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজনটা প্রকট নয়। একজনের বিপদে আরেকজন পাশে দাঁড়িয়েছে। একই মসজিদে সমবেত হয়ে নিরাপত্তা বা অন্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পেরেছে। কিন্তু হিন্দুদের সে সুযোগ ছিল না। কালীর আরাধনা করা মরা-গরু ছিলা ঋষিদের সাথে শ্রীকৃষ্ণ সাধক বৈশ্য বৈষ্ণবদেরও ব্যাপক দূরত্ব। অস্পর্শ ডোমের ছায়া পড়লে শূদ্রের খাদ্যও অভক্ষ হয়ে যায়। ব্রাহ্মণদের সাথে নিচু বর্ণের হিন্দুদের আত্মিক সম্পর্ক ছিল না। ফলে বাংলাদেশে একদা ৩৩% হিন্দু থাকলেও বাস্তবে তাদের মধ্যে ৩৩% এর ঐক্যটা ছিল না। ফলে একজন ব্রাহ্মণ বৈশ্য-শূদ্র-অস্পর্শদের উপর ভরসা করতে পারেনি।
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, মালদহ ও উত্তর দিনাজপুরে এখনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম ছিল ২৬% আর এখন হয়েছে ২৭%! মুসলিমদের জন্মহার বেশি ফলে আরো বেশি হয়ে এটা ৩৩+% হতে পারতো। দেশভাগের পরে বাংলাদেশে কিছু মুসলিম চলে আসায় এবং বাংলাদেশ থেকে অনেক হিন্দু ভারতে যাওয়ায় মুসলিমদের হার একই রকম রয়েছে। এতো ঝড়ঝঞ্ঝা, দাঙ্গা, হামলা ও দারিদ্রতার মধ্যেও তারা দেশ ছাড়েনি। কেন? কারণ মুসলিমদের ২৬% মানে ওই ২৬%ই। এখনো আমরা পশ্চিমবঙ্গে দেখি মুসলিমদের প্রতিবাদী মিছিলে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়। এসব মিছিল ও ঐক্য দেখে তাদের উপর হামলা চালানোর সাহস সঞ্চয় করা সহজ হয়ে উঠে না। সম্প্রতি আমাদের বিক্রমপুরে হিন্দু শিক্ষকদের উপর হামলার প্রতিবাদে সংখ্যালঘুদের সংগঠন যুব-ঐক্য পরিষদ একটি প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধনের আয়োজন করেন। আমরাও কয়েকজন সেখানে যাই। বিস্মিত হই যে সেখানে মাত্র ১০/১২ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক সমবেত হয়েছেন। কারণ অনুসন্ধান করতেই জানতে পারি সেখানে ধর্মীয় দ্বন্দ্বর কারণেই অন্যরা আসেনি। এমন ধর্মীয় দ্বন্দ্বের কারণে কয়েকবার মারামারিও হয়েছে। ফলে অন্য অনেক কারণ নিয়ে আমরা কথা বললেও আমার কাছে মনে হয়েছে হিন্দুদের বর্ণপ্রথাও বাংলাদেশ থেকে হিন্দু কমে যাওয়ার একটি কারণ।
নিজ ধর্মের মধ্যেকার এমন দ্বন্দ্ব মুসলিমদেরও ভুগাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে। সেখানে শিয়া-সুন্নির সংঘাত দীর্ঘকাল ধরেই মুসলিমদের ঐক্যে ফাঁটল ধরিয়ে রেখেছে। সে সুযোগে সমৃদ্ধ ইরাক ধ্বংস হয়েছে। এখন ইরান ও সৌদী আরব ওই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট ও ই শিয়া ও সুন্নির সংঘাতেই। সেই সুযোগে ইসরাইলও ফিলিস্তিনিদের উপর নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে শিয়া খুব নগণ্য বলেই সংঘাত ও সংকটও কম। ফলে ধর্মীয় সংঘাতে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলেও শুধু সুদৃঢ় ঐক্যের কারণেই হয়তো মুসলিমরা ভারত ছাড়েনি।