গৃহকর্মীদের অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষা এবং বাংলাদেশ শ্রম আইনে তাদের অন্তর্ভুক্তির দাবী নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় গৃহকর্মী সম্মেলন ২০২২। গণসাক্ষরতা অভিযানের আয়োজনে এবং সুনীতি প্রকল্পের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অক্সফ্যাম ইন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিল্স, দুস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্র, হ্যালোটাস্ক, কর্মজীবী নারী, নারী মৈত্রী, রেড অরেঞ্জ ও ইউসেপ বাংলাদেশ এর সহযোগিতায় এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী বিশেষ করে সাত শতাধিক গৃহশ্রমিক, মানবাধিকার সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিগণ এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।
বক্তারা গৃহকর্মীদের প্রতি মানবিক আচরণ এবং তাদের ন্যায্য দাবির প্রতি সহমত পোষণ করে তাদের শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্তিকরণ, সরকারী ব্যবস্থাপনায় আবাসস্থল নির্মাণ, গৃহকর্মী নির্যাতনের প্রতিবাদ, আইনী সহায়তা ও ন্যায়বিচারসহ শোভন কাজ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এম. এ. মান্নান, এমপি।
বিশেষ অতিথি ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মোঃ মুজিবুল হক, এমপি এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ এহছানে এলাহী। সভাপতিত্ব করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী। অন্যান্যের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী, গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়কারী আবুল হোসাইন, অক্সফ্যাম ইন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর আশীষ দামলে সহ সরকারী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, ট্রেড ইউনিয়ন ও নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ, নিয়োগকারী ও গৃহশ্রমিক প্রতিনিধিবৃন্দ।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, আইনের চোখে সবাই সমান, তবে তা প্রতিষ্ঠা করতে হলে আইনী সহায়তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। গৃহকর্মীদের বঞ্চণা, শোষণ, নির্যাতন প্রতিরোধে সকলকে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, আইনজীবী, আইনপ্রণেতা সকলকেই সতর্ক থাকতে হবে এবং সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে। গৃহশ্রমিকদের কল্যাণে শ্রম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি বৃহৎ প্রকল্পের প্রস্তাবনা তৈরী করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করলে তা সরকার বিবেচনা করতে পারে বলে তিনি আশ^াস দেন।
আইন প্রণয়ন ছাড়া আইনী সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে মোঃ মুজিবুল হক, এমপি বলেন, শ্রম আইন সংশোধনীর যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে গৃহশ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তিনি সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা গেলে গৃহকর্মীদের বাসস্থান সমস্যার সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হতে পারে।
শ্রমসচিব মোঃ এহছানে এলাহী বলেন, গৃহশ্রমিকদের জন্য নীতি প্রণীত হলেও তার পুর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এখনও সম্ভব হয় নি। তবে এ ক্ষেত্রে সকল পক্ষকে সম্মিলিত সহায়তা অব্যাহত থাকলে কাজটি এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে। এ ক্ষেত্রে তিনি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মনিটরিং সেলের সভা দ্রুততম সময়ের মধ্যে আহ্বান করে সম্ভাব্য সকল উদ্যোগ বাস্তবায়নে সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ভূমিহীন গৃহশ্রমিকদের তালিকা প্রণয়ন করে শ্রম অধিদপ্তরে প্রেরণ করলে তা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে প্রেরণ করা হবে, যাতে তারা সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের শর্তের আওতায় সহায়তা পেতে পারেন।
শ্রমিক নেতা আবুল হোসাইন গৃহশ্রমিকদের অধিকার বাস্তবায়নে তাদের সংঘবদ্ধ হওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, দেশ উন্নত হওয়ার সাথে সাথে গৃহশ্রমিকদের জীবন মানেরও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
রাশেদা কে চৌধুরী সকল পক্ষকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, সকল পক্ষের সম্মিলিত সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে গৃহশ্রমিকদের অধিকার বাস্তবায়ন সহ তাদের জীবন মান উন্নয়ন করা সম্ভব। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলে তিনি চা শ্রমিকদের মতো গৃহশ্রমিকদের বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে পারেন। তিনি এ ক্ষেত্রে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ এবং এ ক্ষেত্রে দাতা সংস্থাসমুহকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য, ২০১৫-২০১৬ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ১৭ লক্ষ, যার মধ্যে শতকরা ৮০% নারী। এদের মধ্যে অধিকাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। কিন্তু অনেকে মনে করেন, এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি। কেবলমাত্র ঢাকা শহরে প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছে। এসব নারী গৃহকর্মীদের বেশিরভাগই নিরক্ষর বা স্বল্পসাক্ষর, তাদের অনেকেরই পেশাগত কোনো প্রশিক্ষণ নেই, অনেকেই নিজেদের অধিকার ও দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন নয়। দৈনিক সংবাদপত্র পর্যালোচনার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিল্স পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, ২০২০ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) মোট ৪৪ জন গৃহকর্মী নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৮ এবং ২০২২ সালে (জানুয়ারি-জুন) ১৬ জন।
আশার কথা ইতোমধ্যেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়নে শোভন কাজ সংক্রান্ত আইএলও কনভেনশন ১৮৯ স্বাক্ষর, ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫’ প্রণয়ন, শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল গঠন, বিভাগ ও জেলায় পর্যায়ে কমিটি গঠন ইত্যাদি নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তবে, প্রয়োজনীয় আইনী কাঠামোর অভাবে এসকল নীতিমালা ও অপরাপর নির্দেশনাসমূহ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। উপরন্তু, গৃহকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এ অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় গৃহকর্মীরা শ্রমিকের অধিকার, সুযোগ ও সুবিধা পাচ্ছে না।
এই প্রেক্ষাপটে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে পেছনে পড়ে থাকা এ বিশাল জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং তাদের অধিকার, মর্যাদা ও সুরক্ষার জন্য অক্সফ্যাম ইন বাংলাদেশ এবং গ্লোবাল এফেয়ার্স কানাডা-এর সহযোগিতায় ৮টি সংগঠন ২০১৯ সাল থেকে ‘সিকিউরিং রাইটস অব উইমেন ডোমেস্টিক ওয়ার্কার্স ইন বাংলাদেশ (ঝবপঁৎরহম জরমযঃং/সুনীতি)’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। দঝবপঁৎরহম জরমযঃং/সুনীতি’ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে ১৬,০০০ গৃহকর্মীকে সংগঠিত করে তাদের অধিকার, র্মযাদা ও সুরক্ষা সম্পর্কে সচেতন করা এবং পেশাগত ও জীবন দক্ষতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সার্বিক জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করা। এই কর্মসূচির আওতায় জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনএসডিএ)-এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ‘গৃহকর্মীদের জন্য পেশাগত দক্ষতামান’ এবং ‘কম্পিটেন্সি বেজড কারিকুলাম’ উন্নয়ন করার পাশাপাশি পেশাগত ও জীবন দক্ষতা উন্নয়ন ও নেতৃত্ব বিকাশে প্রশিক্ষণ কোর্স প্রণীত হয়েছে এবং ইতোমধ্যে ৬,৫৩১ জীবন দক্ষতা ও পেশাগত প্রশিক্ষণ পেয়েছে।