ঢাকাসহ বাংলাদেশের নগর এলাকায় শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় স্কুল, খেলার মাঠ, হাঁটার জায়গা, সবুজ এলাকাসহ প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধাদি অত্যন্ত অপ্রতুল। শিশুদের বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় এই সকল অবকাঠামোসমূহ নগরে না থাকার কারণে শিশুদের সামাজিকীকরণ ব্যাহত হচ্ছে। ফলে শিশুরা মাদকাসক্তি, মোবাইল ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসে আসক্তি, কিশোর গ্যাং-এ জড়িয়ে পড়াসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। যে শিশুরা হতে পারত আমাদের দেশ গড়ার কারিগর, তারাই এখন জাতির বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অবকাঠামো ও ইমারতকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে শিশুদের বেড়ে ওঠার মৌলিক অনুষংগগুলোকে পেছনে ঠেলে দেওয়ার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। ঢাকা মহানগরীর জন্য প্রস্তাবিত বিদ্যালয়কেন্দ্রিক মহল্লা পরিকল্পনা, ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন, এলাকাভিত্তিক পার্ক-খেলার মাঠ তৈরি ইত্যাদি প্রস্তাবনার কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিশুদের জন্য বাসযোগ্য ঢাকা গড়ে তোলা সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন স্থানীয় সরকার, সিটি কর্পোরেশন, রাজউকসহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাসমূহের কার্যকর উদ্যোগ, সঠিক প্রকল্প গ্রহণ, প্রয়োজনীয় অর্থায়ন ও কার্যকর বাস্তবায়নের রুপরেখা প্রণয়ন। একইসাথে নগর পরিকল্পনা প্রণয়নের বিভিন্ন পর্যায়ের শিশুদের চাহিদা ও মতামতকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা।
এসব মতামত উঠে আসে সিরডাপ মিলনায়তনে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) এবং সেভ দ্য চিলড্রেন আয়োজিত ‘অন্তর্ভূক্তিমূলক ও শিশুবান্ধব ঢাকা : বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রেক্ষিত’ শীর্ষক ‘আইপিডি-সেভ দ্য চিলড্রেন নগর সংলাপে।
সংলাপে আলোচক হিসেবে অংশ নিয়ে ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, সাভার, খিলগাঁও, যাত্রাবাড়ি এলাকার শিশু-কিশোররা জানায়, তাদের খেলার কোনো জায়গা নেই, দৌঁড়ানোর জায়গা নেই। ফুটপাতে হকারদের কারণে স্কুলে যাওয়ার জন্য হাঁটতে কষ্ট হয়। সবুজ এলাকা বা খোলা জায়গার বড্ড অভাব। শিশুরা আরো অভিযোগ করেন, ঠাসাঠাসি করে বানানো ভবনগুলোতে বসবাস করার কারণে রুমের ভেতর সূর্যের আলো-বাতাস ঢুকতে পারে না, ফরে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। শিশুরা আকাশ দেখতে চায়, যে উন্নয়ন আকাশ ঢেকে দেয় সেই উন্নয়ন তারা চায় না। শিশুরা কমিউনিটির বন্ধুদের সাথে খেলাধূলা করে নির্মল আনন্দে বেড়ে উঠতে চায়। শিশুরা আরো চায় শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ ও পানি দূষণ বন্ধ করে নির্মল ও দূষণমুক্ত পরিবেশ।
শিশুদের এই সকল দাবীসমূহকে অত্যন্ত যৌক্তিক ও শিশুদের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে মূল প্রবন্ধে আইপিডি’র নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, এটা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক যে, এবারের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রণয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে শিশুদের সম্পৃক্ত করে তাদের মতামত অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। অনুরূপভাবে শিশুদের জন্য অন্তর্ভূক্তমূলক ও বাসযোগ্য ঢাকা শহর গড়তে আইনি কাঠামো তৈরি এবং পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের কর্মকৌশল নির্ধারণ করা দরকার। পাশাপাশি শিশুদের অধিকার সম্পর্কে শিশুদের সচেতন করা এবং কমিউনিটি ও জাতীয় পর্যায়ে শিশুদের অধিকার নিয়ে ‘গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা ও করণীয়সমূহ নির্ধারণ’ করার সহায়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য আমাদের কাজ করা উচিত।
পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ঢাকা শহরের প্রতিটি ওয়ার্ড কাউন্সিলর যদি তার মেয়াদকালীন সময়ে অন্তত একটি খেলার মাঠ বা পার্ক করার উদ্যোগ নিতে পারে তাহলেও ঢাকার উলেস্নখযোগ্য উন্নতি সম্ভব। একইসাথে আমাদের উন্মুক্ত স্থান ও গণপরিসরের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারের ব্যাকরণ শেখার ব্যাপারে আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন এবং এলাকাভিত্তিক সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
ড্যাপ প্রকল্প পরিচালক নগর পরিকল্পনাবিদ মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেন, এবারের ড্যাপে প্রস্তাবিত স্কুল জোনিংয়ের সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিশুদের হাঁটা দূরত্বে স্কুলের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে। এ লক্ষ্যে রাজউক পিপিপিসহ বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে মানসম্মত স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করবে। ড্যাপের সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের লোকদের জন্য লক্ষাধিক আবাসন ইউনিট তৈরির উদ্যোগ নেয়া হবে যার মাধ্যমে আবাসন সংকট মোকাবেলা করা সহজ হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মাকসুদ হাসেম বলেন, ড্যাপের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনার কারণেই মিরপুরের প্যারিস রোডের মাঠ রক্ষা করা সম্ভবপর হয়েছে।
স্থপতি রোকসানা রশিদ অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা শহরের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, ক্যানবেরাতে শহরের জনসংখ্যা নির্ধারণ করেই পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। বিপরীতে বাংলাদেশের নগর এলাকার পরিকল্পনায় ‘ডিজাইন পপুলেশন’ সুনির্দিষ্ট না করাতেই পরিকল্পনাসমূহ অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে।
সংলাপে আরো অংশ নেন ড্যাপ-এর ডেপুটি টিম লিডার খন্দকার নিয়াজ রহমান, আইপিডি পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফরহাদুর রেজা প্রমুখ।
তারা ভবনে প্রাকৃতিক আলো-বাতাস প্রবেশ নিশ্চিত করবার মাধ্যমে শিশুদের শারিরীক মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করা ও শিশুর চোখে নগর দেখবার তাগিদ দেন।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট