জীবনের গল্প
-ডা. মোজাহিদুল হক
পর্ব-৬১
ছাড়া ছাড়া মেঘ করেছে, এলোমেলো হাওয়া। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, আকাশের দিকে তাকতেই মনে হলো আকাশে চৌরঙ্গির মতো চওড়া ছাইরঙা রাস্তা। আর সে রাস্তা দিয়ে টকটকে লাল রোদ্দুরের এক একটা লম্বা- লম্বা লাইন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে আলো গায়েব মেঘেরা জায়গা জুড়ল। ইদানিং কি যে ভালো লাগে তাই ই বুঝিনা। শাঁ – শাঁ দুপুর বেলায় হঠাৎ মাঝে মাঝে কী এক আশ্চর্য ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়ে। অহনা তখন লাঞ্চে বাসায় আসে। এসে কত রকম গল্প করে! আমি চুপচাপ শুনি। অহনা চলে যাবার পর তার সাথে সাথে সে ভালোলাগাও বিদেয় হয়। বাইরে বাসের শোর, বড় রাস্তায় গোলমালের আওয়াজ, রাস্তার ভিড়, রোদ্দুর, উঁচু উঁচু বাড়ি, মানুষের ছোটাছুটি সব ছাড়িয়ে আমি চুপচাপ শুয়ে থাকি, টিভির রিমোট হাতে নিয়ে এ চ্যানেল ও চ্যানেল ঘুরি। কিচ্ছু ভালো লাগে না। কেন মন খারাপ লাগে? কিসের দুঃখ আমার? কোনও দুঃখ তো নেই। তবে? আকাশে মেঘ করার মতো, ধোঁয়ারঙের – ছায়ারঙের, দুঃখ কেন ভিড় করে আমার মনে? জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাই আকাশে মেঘের ফাঁকে নীল, আর ব্যালকনির টবে লাগানো গাছেদের কচি -কচি পাতা ভরা সবুজ ডগা। আর সেই নীল আর সবুজের মাঝখানে আস্তে উড়ে যায় শান্ত নিশ্চিন্ত একটা চিল! ডানা মেলা। যেন হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে, একবারের জন্যও ডানা ঝাপটালো না। কী সুখী ওই চিল!
খুব একটা গোলমালে ঘুম ভেঙে গেল রাত্তিরে। ঘুম ভাঙতেই চারপাশ চুপচাপ। কোন গোলমাল নেই। ঘরের মধ্যে হাওয়ার হৈ চৈ। পাশ ফিরে ভালো করে চোখ মেলে তাকালাম। অহনা গলা অব্দি কাঁথা টেনে ঘুমিয়ে আছে। কি মনে করে আমার হাত খানা টেনে নিল। আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো। নিষ্পাপ ঘুম। আবছায়ার মধ্যে আমি জেগে থাকি। অহনা কে নিয়ে দুরে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে। সবুজ পৃথিবী, ঝকঝকে নরম রৌদ্দুরে অহনার হাত ধরে শিশিরে হেঁটে বেড়াতে ইচ্ছে করে। কুয়াশা ভেদ করে মোটর বাইকের পেছনে অহনাকে বসিয়ে ছুটে চলতে ইচ্ছা করে। ভালো লাগার জন্য মানুষ কোথায় না ছোটাছুটি করে, সিনেমা, থিয়েটার, কত জায়গায়। কোনও জায়গায় মেলা -টেলা কিছু হলে মেয়ে মানুষ আর পুরুষের থইথই, দোকানে দোকানে ভিড় ধরেনা। একেক জনের ভালো লাগা একেক রকম। একেক জনের চোখে ভালোলাগা একেক রকমের। পৃথিবীর কোটি মানুষের ভালো লাগা কে কার খোঁজ রাখে। কমরেড কাইয়ুম মরে গেল! মরে যাওয়া এতই সোজা? যে কেউ যে কোন ও দিন মরে যেতে পারে? আমিও ? পৃথিবীর কোটি মানুষের মধ্যে আমি না থাকলে কি হবে? কিছুই হবে না। যদি আমি না জন্মাতাম তাহলেই বা কি হতো? কিচ্ছু হতো না। তবে কি কারও জন্যই কিচ্ছু যায় আসে না কোথাও? পৃথিবীকে না হলে আমার চলবে না এক মুহূর্ত ও কিন্তু আমাকে না হলে পৃথিবী তো চলবে যেমনটা এখন চলছে। তবে কি আমি পৃথিবীর কেউ নই??
পরশু একজন খুব দুঃখ করলেন একা কোনও পুরুষ মানুষকে সহজে কেউ বাড়িভাড়া দিতেই চান না। বাড়ী ভাড়া নিতে হলে স্ত্রী অবশ্যই থাকা চাই না হয় অন্তত মা কিংবা বোন। আমি বললাম কোনও মেয়ে মানুষ না থাকলে বাড়ী তো আর বাড়ী মনে হয়না,মনে হয় বিরানভূমি তাই হয়তো বাড়ীওয়ালারা বাড়ী ভাড়া দিতে চান না। ভদ্রলোক হতাশ হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মাঝে মাঝে দেখি অনেক মেয়ে মানুষ খুব আপসোস করে বলেন, বাবার বাড়ীর পর শ্বশুর বাড়ী, আমার নিজের বাড়ী কোথায়? আমি তাদের বলি, বাবার বাড়ী কিংবা শ্বশুর বাড়ী আপনাদের ছাড়া সেখানে পূর্ণতা কোথায়? শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় ঘাস লতা পাতা আর শিউলি ফুলের একটা আবছা ঠান্ডা মিঠে মিঠে গন্ধ নাকে লাগে। কি যে ভালো লাগে। রাস্তার ওপাশে লাইনে বেশ কয়েকটি নার্সারি। তার ফাঁকে ফাঁকে ঝুপড়ি দোকান। ঝুপড়ির সামনে বেঞ্চ পাতা, সেখানে লোক বসে গল্প করে চা খায়। আজ সেখানে জটলা, রোগা মতো একটা লোক খুব হম্বিতম্বি করছে। একটা সিগারেট ধরালাম বললাম কি হয়েছে? ভেজা হাত লুঙ্গিতে মুছতে মুছতে বলল, পাওনাদারদের কী মুশকিল বলেন তো! ধারে দিতেও হয়, আবার পাওনা টাকা চাইতে গেলেও লোকে রাগ করে। রোগা মতো লোকটা চেঁচানো বন্ধ করে বেঞ্চিতে বসে হাঁপাচ্ছে। আরে! এঁকে তো চিনি, দেখেছি তো আগে! কে? কোথায় দেখেছি??
ক্যালেন্ডারের পাতা খসে পড়ে এলো অক্টোবরের পাতা। সাতাশ তারিখ বৃহস্পতিবার। অক্টোবর দু’ হাজার আঠারো আমার কত কান্নার কাঁপন। কত নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হয়েছে আমাকে, কিছু মানুষের লোভ, হিংসা, পথে নামিয়ে দিয়েছিল আমাকে। তার পর থেকে প্রতিবছর অক্টোবর এলেই লজ্জা করে, ভয় করে, বিশ্রী লাগে, কিছু অমানুষের চেহারা চোখে ভাসে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার যে শুধু আনন্দ। জীবনে এত আনন্দ আছে? কী ভাগ্য অহনা আমার জীবনে এসেছিল, নয়তো কোথায় পেতাম এতো আনন্দ? হালকা শীত পড়ছে শেষ রাতে। সবুজ মটরশুঁটি আর আপেলের মতো সবুজ টমেটো দিয়ে শোল মাছের ঝোল ধনে পাতা ছড়ানো আর বড় বড় টুকরো করে ফুলকপি দিয়ে চিংড়ী খেতে ইচ্ছে করছে খুব। হাসপাতালে আসা যাওয়ার পথে মটরশুঁটি, সবুজ টমেটো আর ফুলকপি খুঁজছি কিন্তু পাচ্ছি না। হঠাৎ কেমন একটা ঘুম -ঘুম ঠান্ডা নেমেছে বাসা জুড়ে। যেন ঘরে- ঘরে হাতে ধরে এগিয়ে আনছে রাত্তিরটাকে। সন্ধ্যাটা যেন মন কেমন করা। যখন আলো নিভে যায়, আবার অন্ধকার ও ফোটে না, সেই ছাইরঙের ছায়া ঝরা সময়টাকে কে যেন কাকে ছেড়ে চলে যায় চিরকালের মতো। কী রকম চুপচাপ, আর ঝাপসা কুয়াশা। কেমন একটা ঠান্ডা রঙ ছাড়া মন মরা সন্ধ্যা, ঠিক যেন শীত চলে এলো। কয়েকদিন ধরে অহনার মন খুব খারাপ, ও গতকালই বলল বাপের বাড়ির জন্য ওর মন কেমন কেমন করছে। কী অদ্ভুত মেয়েদের এই দুই জীবন, তারা জন্ম নেয় বাপের বাড়ী ছেড়ে যাবার জন্য, আর ওই ছেড়ে যাওয়াটাই তাদের সব পাওয়া।
কী মন মরা সন্ধ্যা, আর বিকেলটা ছোট্ট একটুখানি, যেন রোগা পাতলা, সরু, একবার ঝিলিক দিয়েই ঝুপ করে পড়ে যায় অন্ধকারে। সন্ধ্যার সিঁদুর রঙ যেন ইঁদুর -রঙ, আকাশটা যেন বিধবার কপাল, সিঁদুর ছাড়া। ঝিরঝির শিরশির করে শীত আসছে। হঠাৎ খুব ক্লান্ত লাগছে, খুব ক্লান্ত, ফাঁকা ফাঁকা। সামনের ছাদে ছাদবাগানের গাছ গুলোর সাথে হেমন্ত বিকালের সোনারোদের একা একা খেলা। দুপুরে সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। জেগে উঠে দেখি ঘড়িতে চারটা বাজে, বাইরে নরম রোদ ঝলমলে, জানালা বন্ধ বসবার ঘরটায়, খুলে দিতেই হৈ হৈ হাওয়া পর্দা উড়িয়ে ঘরে ঢুকল। গত তিন চার বছরে নিজেকে ঘষে মেজে তৈরী করেছি। রিক্ত হস্তের মানুষ থেকে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করেছি, কিছু দৈব -প্রেরণা ছিল, বুকে স্বর্গীয় আগুন। ঘৃণা ছিল সেই জীবনের ওপর, যে জীবন নিজের দোষে পাওয়া। জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা কিছু মানুষ যারা স্বর্বশান্ত করে দিয়ে গেল। ঘেন্না হয় সে জীবনের, জীবনের সে অধ্যায়ের প্রতি। অনেকক্ষণ ধরে চেপে রাখা একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল। কয়েক রাত ঘুম হচ্ছে না, এক ফোঁটা ও না। রোজ রাতে একটা নির্দিষ্ট সময়ে শুয়ে পড়েতই হবে, ঘুমোতেই হবে প্রতি রাত্রে প্রত্যেকটি মানুষকে। জগতের এই নিয়মটার ওপর আমার খুব রাগ। এই নিয়ম না হলে কি হতো? আমার ঘুম নেই, তৃপ্তি নেই। কেন?
ওই জীবনের কাউকেই আর মনে পড়েনা, মনের মাকড়শা-বোনা কম আলোর কোণেও নেই কারো অস্তিত্ব। নিজের ঘরে, একলা বাড়িতে, স্তব্দ বিকেলে আমি মাঝে মাঝে আচ্ছন্ন হয়ে যাই। কিছুক্ষন পর চেতনা ফিরে এলে নিজের এই ঘরটা অচেনা অচেনা লাগে, এ্যানেসথেসিয়া থেকে জেগে উঠলে যেমন লাগে মানুষের তেমন। হঠাৎ হঠাৎ দূর্বল লাগে, ক্লান্ত, অবসন্ন, ভেতরে ভেতরে শীত লাগে। মনে হয় ভীষণ ভিড়ের মধ্যে সবাই আমাকে ফেলে চলে গেছে, আশে পাশে যারা আছে তাদের কাউকেই আমি চিনিনা। আচ্ছা জীবনের খারাপ সময় গুলো যদি বিরক্তিকর বইয়ের পাতার মতো তাড়াতাড়ি পাতা উল্টিয়ে শেষ করে দিতে পারতাম! মাঝে মাঝে মনখারাপ হয়। এই মন খারাপ আমার ছোটবেলা থেকেই। তবে দুঃখ আমার কমই হয়। দুঃখ বাইরে থেকে আসে, কিন্তু মনখরাপটাতো জন্মায় নিজের মধ্যেই, নিজের সবই তো আমরা ভালবাসি! তাহলে মন খারাপ তো একান্ত নিজেরই। অহনা অফিস চলে যাবার পর বড্ড একা লাগে। আমি উঠে গিয়ে বসার ঘরে চলে যাই। বসবার ঘরের একটা প্রভাব আছে মনের ওপর। ওখানেই আমরা বাইরের জগতকে বাড়ীতে ডাকি, বাইরের কেউ না থাকলেও, একা থাকলেও ওখানে নিজেকে অন্য অনেকের অংশ মনে হয়। ইদানিং হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় আমি অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছি অথচ কোথাও যাচ্ছি না, স্বপ্নের যেমন পথ আর ফুরোয় না, সেই রকম।
সকালে প্রথম পেয়ালা চায়ের পর এ পর্যন্ত কিছুই খাই নি কিন্তু আমার ক্ষুধা বোধও ছিল না। তার পর থেকেই অনেক অসংলগ্ন, অনুচিত, পরস্পর বিরোধী ভাবনা মনের ওপর দিয়ে ভেসে গেল। জীবনে বার বার ঠকে গিয়ে শিখেছি মানুষ কে ভালবাসতে সাবধান, জীবনের সব ভালোবাস কিন্তু জীবন্ত মানুষকে ভালোবাসতে খুব সাবধান। শাকসবজীর দাম এতো বেড়েছে! ব্যবসায়ীরা এখন আবার বাহানা পেয়েছে, ঘুর্ণিঝড়ে সব নষ্টের। পোয়াবারো তাদের। জনগনের জীবন ধারণ কষ্টকর হয়ে গেলো।রাশিয়া -ইউক্রেন যুদ্ধ দুনিয়া জুড়ে তার প্রভাব, তেলের দাম, গমের দাম সব দাম। অহনা গত পরশু বলল ডিমের ডজন নাকি একশত পঞ্চাশ। কি আজব কথা।অহনা বাসায় না থাকলে আমি অস্থির হয়ে পায়চারী করি। অস্থির পদচারণার একটা গুণ আছে। দেহের সঙ্গে সঙ্গে মনও শ্রান্ত হয়। শিরা উপশিরায় রক্তকণিকা দাপাদাপি করে। আজও ঘুম আসছিল না। আশ্চর্য, এতো ক্লান্তি শরীরে, তবু নিদ্রা কই! বিছানায় এপাশ ওপাশ করছি। একটু অস্থির হয়েই বিছানা ছাড়লাম, অহনা রুপোলী তন্দ্রায়।বসবার ঘরে আলো জ্বালিয়ে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জল ঢাললাম গলায়। আলো নিভিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। মেঘের গায়ে লালচে আভা। আধখানা চাঁদ মেঘের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে বার বার। হঠাৎ হঠাৎ জেগে উঠছে এক-আধটা নক্ষত্র। বিষন্ন স্মৃতির মতো।