সম্রাট আকবরের নবরত্নের একরত্ন আবুল ফজল ১৫৭৯ সালে লিখেছেন বঙ্গদেশ হচ্ছে বিদ্রোহ এবং অশান্তির দেশ। সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে বঙ্গদেশে ধর্মপ্রচারের জন্য এসেছিলেন শাহ নিয়ামত উল্লাহ ফিরোজপুরী। এই পীর মালদায় বসতি স্থাপন করেন। তিনি কবিতার ভাষায় লিখেছেন, বঙ্গের কোথাও শান্তি নেই, হয় তুমি বাঘের মুখে নয়তো কুমিরের পেটে। পীরদের অনেকেই বঙ্গদেশকে ‘দার-উল হাবর’ বা ‘বাসের অযোগ্য অশান্তির এলাকা’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। আর্যরা বঙ্গদেশকে ব্রাত্যদের দেশ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। ভুসুকুপাদ চর্যাপদে আক্ষেপ করে লিখেছেন, তার বউকে চণ্ডালে ভাগিয়ে নিয়েছে, তাই তিনি বাঙাল হয়েছেন৷ তার মানে হল, যার বউ চণ্ডালে ভাগিয়ে নিয়েছে সে আবার মানুষ কিসের? সে বাঙাল হতে পারে! গোলাম হোসেন সালিম ১৭৮৬ সালে রিয়াজ-উস-সালাতীন গ্রন্থে লিখেছেন, এ দেশের লোকদের রুচি নিম্নমানের, রীতিনীতি নিম্নমানের, পোষাক-আশাকও নিম্নমানের। অর্থাৎ বঙ্গে কখনোই শান্তি ছিল না, তাই অদূর ভবিষ্যতে শান্তির প্রত্যাশা করা বাতুলতা মাত্র। কখনো মনে হবে আইয়ুব খান গেছে এবার শান্তি, বঙ্গবন্ধু গেছে এবার শান্তি, খুনি মুশতাক গেছে এবার শান্তি, জিয়া গেছে এবার শান্তি, স্বৈরাচার এরশাদ গেছে এবার শান্তি, খালেদা গেছে এবার শান্তি, হাসিনা গেছে এবার শান্তি। এই রাজাদের চলে যাওয়া মানে বাংলার অশান্তি-অরাজকতা চলে যাওয়া নয়। তারা চলে যান এগুলো রেখেই৷ তাই আমাদের প্রিয় দেশ এখনো ব্রাত্যদের, এখনো দার-উল-হাবর। কিছু লোক এদেশে আছে যারা সুইস ব্যাংকে জমিয়েছেন টাকার পাহাড়। আমেরিকা-কানাডা-দুবাইতে বানিয়েছেন বেগম পাড়া আর দেশে মানি-মাগি-মদে নিজেদের নিমজ্জিত রেখেছেন৷ তাদের হিসাবে আনা হয়নি, তারা দার-উল-হারবের বাসিন্দা নন। নিজেরা রাজা বাদশা হয়ে আমাদের প্রজা বানিয়েছেন৷
দেশে ধনীর সাথে পাল্লা দিয়ে গরীব বাড়ছে৷ শোষকের বিপরীতে বাড়ছে নিপীড়িত মানুষ৷ বৈষম্য ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছে সামন্ত যুগে৷ এর চেয়ে ভয়ানক সংবাদ হল বিপুল টাকা পাচারের সংবাদ৷ গত সপ্তাহে ওয়াসার সাবেক এমডির আমেরিকায় ১৪টি বাড়ি কেনার সংবাদ এসেছে৷ এ সপ্তাহে একজন রাজনৈতিক নেতার আমেরিকায় বহু সংখ্যক বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে৷ এর মানে হল, কর্মকর্তা আর রাজনৈতিক নেতারা মিলেমিশেই আমাদের সম্পদ পাচার করছে৷ রাষ্ট্র এখনও এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি৷ লুটেরা সম্রাটরাও দেশে রাজার হালে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ দলান্ধ ও ধর্মান্ধ মূর্খ সাধারণ মানুষ এদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হচ্ছে৷ কেন এখনো দেশ আমাদের জন্য ‘দার-উল-হাবর’ আর লুটেরাদের জন্য স্বর্গভূমি?
একমাত্র সুষ্ঠু ধারার গণতন্ত্রই আমাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারে৷ আমাদের শান্তি ও সমৃদ্ধি এনে দিতে পারে৷ মৌলবাদ থেকে মুক্তি দিয়ে সুশিক্ষার পথ দেখাতে পারে৷ কাল্পনিক অলৌকিকতার পরিবর্তে আমাদের বাস্তবতার মুখোমুখি করতে পারে৷ কিন্তু সুষ্ঠু গণতন্ত্র কি এমনিতেই আসবে? একদমই না৷ গণতন্ত্রের জন্য আমরা লড়াই করিনি৷ আমরা লড়াই করি দলের জন্য৷ ধর্মান্ধতা ও দলান্ধতা আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখছে৷ ধর্মান্ধতা ও দলান্ধতা থেকে মুক্তিই আমাদের মুক্তির পথ দেখাতে পারে৷ সুষ্ঠু গণতন্ত্রই আমাদের প্রকৃত শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ দেখাতে পারে৷