‘এমন কোনো চাপ নেই, যেটা শেখ হাসিনাকে দিতে পারে। এটা মাথায় রাখতে হবে। কে কী চাপ দিল, তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না।’ প্রধানমন্ত্রী গতকাল বিকেলে গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্য করেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ প্রসঙ্গে তিনি একথা বলেন।
কাতারে অনুষ্ঠিত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পঞ্চম জাতিসংঘ সম্মেলনে যোগদানের বিষয়ে নানা তথ্য তুলে ধরতে সংবাদ সম্মেলনটি ডাকেন প্রধানমন্ত্রী। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ বিন খলিফা আল থানি এবং জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের আমন্ত্রণে গত ৪ থেকে ৮ মার্চ এই সফর করেন প্রধানমন্ত্রী। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর লিখিত বক্তব্য পাঠের পরে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা। প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী আগামী জাতীয় নির্বাচন, নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস, বিএনপির সঙ্গে সংলাপসহ নানা প্রসঙ্গ উঠে আসে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে যে উন্নয়ন হয়, সেটা আমরা প্রমাণ করেছি। অনেক ধৈর্যের দরকার। অনেক গালমন্দ, অনেক কিছুই তো শুনতে হয়। প্রতিনিয়ত সমালোচনা শুনেই যাচ্ছি। আমরাই সুযোগ করে দিয়েছি। এর আগে তো এত টেলিভিশন ছিল না, এত রেডিও ছিল না। আমরাই সব উন্মুক্ত করে দিয়েছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ। দেশ-বিদেশ থেকে বসে বসে আমাদের সমালোচনা করে। শুনতে হয়, কিছুই করি নাই।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যে যেটাই বলুক, দেশের মানুষের প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধ আছে কি না, এটা দেখতে হবে। পরিকল্পিত উন্নয়ন করতে পেরেছি কি না, সেটা আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে আমি এটুকু দাবি করতে পারি, সেটা আমরা করতে পেরেছি।’
আগামী নির্বাচন ঘিরে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি বিভিন্ন সময়ে খালেদা জিয়াকে টেলিফোনে সংলাপের আহ্বান, আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর সহানুভূতি জানাতে গিয়ে বাসার দরজা বন্ধ রাখার কথা তুলে ধরেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার পরিষ্কার কথা, যারা এইটুকু ভদ্রতা জানে না তাদের সঙ্গে বৈঠকের কী আছে। কেউ পারবেন মা-বাবার হত্যাকারীদের সঙ্গে এইভাবে বসে বৈঠক করতে। যেটুকু সহ্য করেছি, দেশের স্বার্থে জনগণের স্বার্থে, নিজের স্বার্থে নয়।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘খালেদা জিয়ার ভাই এসে, বোন এসে আমার কাছে আকুতি করল। এরপর আমি তাঁর সাজাটা স্থগিত করে তাঁর বাসায় থাকা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এটুকু যে করেছি সেটাই যথেষ্ট। যারা বারবার আমাদের হত্যা করে, আমাদের অপমান করে, তার পরও এটুকু সহানুভূতি পেয়েছে শুধু আমার কারণে। তাদের সঙ্গে আবার কিসের বৈঠক, কিসের কী? আর কী ক্ষমতা তাদের আছে? সন্ত্রাস করা ছাড়া তো আর কোনো ক্ষমতা তাদের নেই।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সামনে নির্বাচন। এখন ছবিসহ ভোটার তালিকা, আইডি কার্ড হয়ে গেছে। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স আছে, সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলার সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইভিএম করতে চেয়েছিলাম। কারণ সবাই ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভোট দেবে, সঙ্গে সঙ্গে ফলাফল পাবে। একটা আধুনিক পদ্ধতি মানুষ ব্যবহার করতে পারত। সেটা নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা, আমরা এই বিষয় নির্বাচন কমিশনের ওপর ছেড়ে দিয়েছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ অবাধ, নিরপেক্ষ করে গড়ে দিয়েছি, যাতে জনগণের ভোটের অধিকার জনগণ প্রয়োগ করবে। জনগণ যাকে খুশি ভোট দেবে—এটা আমাদেরই স্লোগান। আমি কখনো হতাশায় ভুগি না।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন, রাষ্ট্র পরিচালনায় যে যে কথা আমরা দিয়েছি, তা রেখেছি। মাঝখানে করোনাভাইরাস আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যদি না হতো আমাদের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের ওপরে ছিল, আমরা এগিয়ে যেতে পারতাম। দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশে নামিয়ে এনেছিলাম। আরো ২ থেকে ২ শতাংশ নামিয়ে আনতে পারতাম। তবে হতাশাগ্রস্ত হলে হবে না। আমি কখনো হতাশায় ভুগি না, একটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলি, আমার তো হারানোর কিছু নেই।’
সম্প্রতি বিদেশের একটি পত্রিকায় নোবেল বিজয়ী মুহম্মদ ইউনূসের পক্ষে ৪০ জন বিশ্বনেতার দেওয়া একটি বিবৃতি বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হয় প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি বলেন, ‘যে ৪০ জনের নাম ব্যবহার করা হয়েছে এবং সেটা আমাদের বিশেষ একজন ব্যক্তির পক্ষে, এর উত্তর কী দেব জানি না, তবে আমার একটা প্রশ্ন আছে, যিনি এত নামিদামি, নোবেলপ্রাইজপ্রাপ্ত, তাঁর জন্য এই ৪০ জনের নাম খয়রাত করে এনে বিজ্ঞাপন (অ্যাডভার্টাইজমেন্ট) দিতে হবে কেন? তা-ও আবার বিদেশি পত্রিকায়।’
মুহম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে রাখতে প্রভাবশালী একটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সে দেশের রাষ্ট্রদূতের চাপ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এমডি পদে কী মধু, তা আমি জানি না। আইন অনুযায়ী তাঁর বয়স ৬০ পেরিয়ে ৭০ হয়ে যাওয়ার পরও এমডি পদে থাকতে হবে। এমডি পদে থাকলে হয়তো মানি লন্ডারিং করা যায়, পয়সা বানানো যায়, পয়সা মারা যায়, গরিবের রক্ত চুষে খাওয়া যায়। সেই চাপও শেখ হাসিনা সহ্য করে চলে এসেছেন। নিজের টাকায় পদ্মা সেতু বানিয়ে দেখালাম সেই চাপে আমাদের কিছু আসে যায় না।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি যে-ই হোন, আমার দেশে কতগুলো আইন আছে, সেই আইন অনুযায়ী সব চলবে এবং সেটা চলে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতিসংঘের এলডিসি সম্মেলনে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে এটাই সম্ভবত বাংলাদেশের শেষ অংশগ্রহণ। কারণ ২০২৬ সালে আমরা এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাব, আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হব। এই সম্মেলনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে আমি বাংলাদেশের অভাবনীয় উন্নয়ন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরেছি। একই সঙ্গে আমি ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে মসৃণ ও টেকসই উত্তরণ নিশ্চিত করতে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে বিভিন্ন দাবি ও প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশগুলো করুণা বা দাক্ষিণ্য চায় না বরং আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের ন্যায্য পাওনা চায়। এই কথা আমি স্পষ্টভাবে বলেছি। এ ছাড়া বাংলাদেশসহ উত্তরণের পথে থাকা দেশগুলোর উন্নয়ন অর্জনকে গতিশীল রাখতে বর্ধিত সময়ের জন্য এলডিসি দেশগুলোর জন্য অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছি।’
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট