পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, ‘প্রকল্পে কাজের গতি ভালো। মাওয়া-ভাঙ্গার তুলনায় ঢাকা-মাওয়া পিছিয়ে থাকলেও এখন এই অংশে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। আশা করি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হবে। সেতুতে আর ৩০০ মিটার রেললাইন বসানোর কাজ বাকি। কাজের গতি অনুযায়ী সব ঠিক থাকলে ২১ মার্চ সেতুতে রেললাইন বসানোর কাজ শেষ হবে।’
রেলওয়ের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলা দিয়ে যশোরের সঙ্গে রেল নেটওয়ার্ক যুক্ত হবে। একই সঙ্গে ভাঙ্গা থেকে পাচুরিয়া-রাজবাড়ী সেকশনটি পদ্মা সেতু হয়ে সরাসরি ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হবে।বর্তমানে রেলপথে ঢাকার সঙ্গে খুলনার দূরত্ব ৪৬০ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু দিয়ে নতুন রেলপথটি চালু হলে দূরত্ব কমবে ২১২ কিলোমিটার।
বর্তমানে খুলনা, দর্শনা, বেনাপোল ও রাজশাহীর সঙ্গে ঢাকার সরাসরি রেল যোগাযোগ রয়েছে। পদ্মা সেতু ব্যবহার করে এসব অঞ্চলে নতুন ট্রেন গেলে বিদ্যমান পথে মাঝের স্টেশনগুলোর যাত্রীরা রেলের সেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। এমন একটি আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
এ ব্যাপারে রেলের পরিচালন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বিষয়টা আমাদের নজরেও রয়েছে। তাই হুট করে সব ট্রেন সরিয়ে দেওয়া হবে না। প্রথম দিকে বিদ্যমান রুটেও ট্রেন চলবে। হয়তো সংখ্যা কমিয়ে নিয়ে নতুন রুটে যুক্ত করা হবে। কিংবা নতুন রুটে পুরোপুরি নতুন ট্রেনও দেওয়া হতে পারে। এতে বিদ্যমান রুটে ট্রেনের সংখ্যা কমবে। চাপ কমায় ট্রেনের সময়সূচি ঠিক রাখতে সুবিধা হবে। নতুন পথে নতুন রেলযাত্রী তৈরি হবে। দূরত্ব ও ভোগান্তি কমবে।’
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে প্রকল্পের ঢাকা থেকে ভাঙ্গা অংশ চালু করার লক্ষ্যে কাজ চলছে। এই রুট ব্যবহার করে কোথায় কোথায় ট্রেন যাবে, সে বিষয়ে আলোচনা চলছে।
ঢাকা-ভাঙ্গা কাজের অগ্রগতি ৮০ শতাংশ : প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১ মার্চ পর্যন্ত সার্বিক অগ্রগতি ৭২ শতাংশ। প্রকল্পের নির্মাণকাজ তিন ভাগে বিভক্ত। এতে ঢাকা-মাওয়া অংশে ৭১ শতাংশ, মাওয়া-ভাঙ্গা অংশে ৮৯ শতাংশ, ভাঙ্গা-যশোর অংশে ৬৪ শতাংশ কাজ হয়েছে।
ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেলপথের গড় অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। মাওয়া-ভাঙ্গা অংশে কাজ আগে শুরু হওয়ায় এই অংশের অগ্রগতিও বেশি। এই অংশের ১২টি বড় সেতুর সব কটির নির্মাণকাজ শেষ। শেষ হয়েছে ২৬.৯৭ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ। ৬৯টি কালভার্ট ও আন্ডারপাস, এক হাজার ৭১০টি ওয়ার্কিং পাইল, দুই হাজার ৫৮টি বক্স গার্ডার, ভায়াডাক্ট-২-এর ৬৮টি পিয়ার এবং বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। ৬৭টি স্প্যান স্থাপন করা হয়েছে। ভায়াডাক্ট-৩-এর ১০৮টি পিয়ার ও বাঁধ নির্মাণ এবং ১০৭টি স্প্যান স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে।
আগস্টে পরীক্ষামূলক ট্রেন, সেপ্টেম্বরে যাত্রী পরিবহন : রেলের পরিকল্পনায় প্রথমে প্রকল্পের দ্বিতীয় অংশে মাওয়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চালানোর কথা ছিল। এরপর ঢাকা-মাওয়া অংশকে যুক্ত করা হতো। সব শেষে যুক্ত হতো ভাঙ্গা-যশোর অংশ। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারা এবং সময়মতো সেতু বুঝে না পাওয়ায় পরিকল্পনায় বদল আনে রেল কর্তৃপক্ষ।
বর্তমানে পুরো প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত রেলপথ চালু করতে চান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে প্রথম ধাপে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চালানো হবে।
চলতি বছরের ডিসেম্বরে ঢাকা-ভাঙ্গা অংশে ট্রেন চলার কথা ছিল। তবে সে সময় এখন এগিয়ে আনা হয়েছে। রেলের নতুন কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী আগস্টে এই পথে পরীক্ষামূলক ট্রেন চলবে। আর সেপ্টেম্বরে যাত্রী পরিবহন করা হবে।
প্রকল্পে কত খরচ : ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মীয়মাণ পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ১৮ হাজার ২১০ কোটি ১১ লাখ টাকা দিচ্ছে সরকার। বাকি ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে চায়না এক্সিম ব্যাংক। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল প্রকল্পটি সরকারের ফার্স্ট ট্র্যাক প্রকল্পের তালিকাভুক্ত করা হয়।
রাজধানীর কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, কেরানীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর, লৌহজং, পদ্মা সেতু, শরীয়তপুরের জাজিরা, মাদারীপুরের শিবচর, ফরিদপুরের ভাঙ্গা, নড়াইল, মাগুরা হয়ে যশোর পর্যন্ত এই রেলপথে ২০টি স্টেশন থাকবে। প্রকল্পের অধীনে মূল পথ ১৬৯ কিলোমিটার। সেখানে লুপ ও সাইডিং ৪২.২২ কিলোমিটার এবং তিন কিলোমিটার ডাবল লাইনসহ মোট ২১৫.২২ কিলোমিটার রেলওয়ে ট্র্যাক নির্মাণ করা হচ্ছে।