এদেদেশে অভিভাবকদের উপর খুবই চাপ দেয়া হয় যে, তারা যেন বাড়িতে শিক্ষার্থীদের পড়ান। এমনিতেই আমাদের পরিবারগুলো পশ্চাৎপদ এবং এসব পরিবার থেকে শিশুদের মধ্যে পশ্চাৎপদ ও নেতিবাচক বিভিন্ন ভাবাদর্শ গড়ে দেয়া হয়। পরিবার থেকে তারা রাজনৈতিক দলের প্রতি অন্ধ আনুগত্য, ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস ও প্রতিবেশিদের বা আত্মীয়দের প্রতি বিরূপ ধারণা অর্জন করে। প্রায় সকল মা-বাবাই আধুনিক শিক্ষা সম্পর্কে ধারণা রাখেন না। এছাড়া তারা বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি, রাজনীতি, ইতিহাস, সংস্কৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে অস্বচ্ছ ধারণা পোষণ করে। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বচ্ছ ও সঠিক ধারণা প্রবেশ করে না। হাজারটা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও স্কুলের শিক্ষকরাই অধিকতর সঠিক ধারণা প্রদান করেন। যদিও আমাদের স্কুলগুলোর পাঠ্যসূচিতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের তৈরি মিথ্যা ইতিহাসই শিক্ষা দিয়ে থাকে। তারা শিক্ষকদের বাধ্য করে পাঠক্রমের বাইরের বিভিন্ন দলীয় বিষয় পড়াতে। এমনকি রাজনৈতিক নেতারাও শিশুদের বাধ্য করে তাদের দলীয় বক্তব্য শুনতে। এগুলোও শিক্ষার্থীদের ক্ষতি করে। তবুও বলবো এগুলো বাড়ির শিক্ষার চেয়ে কম ক্ষতিকর।
ফ্রান্সে একজন শিক্ষককে হত্যার পরে পিতা-মাতা যাতে পরিবারে শিশুদের শিক্ষা দিতে না পারে সে বিষয়ে তারা আইন করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। বিশেষ করে দরিদ্র দেশ থেকে মাইগ্রেট করা পিতা-মাতা শিশুদের তাদের ধর্মীয় উগ্রতা শিক্ষা দেয় এবং অন্য ধর্মের প্রতি বা মানুষের প্রতি ঘৃণা করতে শেখায়। ফ্রান্সসহ উন্নত দেশে স্কুল ও কলেজে ‘পরিবার বা ব্যক্তির ধর্ম, রাজনীতি ও ব্যক্তিগত মতামতের বিষয়’ আলোচনা করা হয় না। শ্রেণিকক্ষে কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপদেশ দেওয়া বা শিক্ষা দেয়াও নিষিদ্ধ। এমন কি কোন পার্টি বা সংগঠনের সদস্যতা নেওয়া বা সমর্থন করাও নিষিদ্ধ। পাকিস্তান আমলে সাধারণ ছাত্রদের দমিয়ে রাখার জন্য এনএসএফ গঠন করেছিল পাকিস্তান সরকার। এনএসএফ শুধু শিক্ষা কার্যক্রমেই বিঘ্নতা ঘটায়নি, শিক্ষার পরিবেশও নষ্ট করে। স্বাধীনতার পরে আমরা ছাত্র সংগঠনগুলোকে দেখি রাজনৈতিক দলগুলোর লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে। তারা রাজনৈতিক দলগুলোর এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য তাদের নির্দেশ পালন করে। তাদের অধিকাংশ লেখাপড়ার সাথে সম্পর্কহীন হয়ে পড়ে। বিভিন্ন চাঁদাবাজি, ছিনতাই, নিপীড়ন, সন্ত্রাসের সাথে নিজেদের জড়িয়ে নেয়। এরা সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন করে শিক্ষার্থীদেরই। শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতের যেতে এরা বাধ্য করে। টাকার বিনিময়ে হলে ওঠায়। বাংলাদেশের ইডেন কলেজের নেত্রীদের বিরুদ্ধে সুন্দরী ছাত্রীদের নেতাদের যৌন সেবা দিতে বাধ্য করার অভিযোগ করে একই ছাত্র সংগঠনের নেতাদের একাংশ। এখন কোনভাবেই ছাত্র সংগঠনের নেতাদের ছাত্রনেতা বলা যায় না তাদের নিয়োগ দেয় রাজনৈতিক দলের নেতারা। ছাত্ররা যদি নেতা না বানায় তাহলে সে কি করে ছাত্র নেতা হবে? আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে জরিপ করে দেখেছি সেখানে যারা ছাত্র সংগঠনের নেতা তাদের প্রায় সকলেই খুবই দুর্বল ছাত্র। তারা রাজনীতি করে ক্ষমতা প্রদর্শন, বিভিন্নভাবে বাড়তি আয় করা ও শেষমেষ বিশ্ববিদ্যালয় বা রাজনৈতিক সুবিধায় একটি চাকরি বাগিয়ে নেয়ার জন্য। এদের বহুজনকেই দেখেছি অযোগ্যতা ও অদক্ষতার প্রমাণ দিতে। এরা কথায় কথায় শুধু বলে, ‘জানেন আমি কোন পর্যায়ের নেতা ছিলাম?’ কিন্তু একটা যুক্তি বা কাজ বুঝে করার সামর্থ্য এদের নেই। এসব কথিত নেতারা পরিবার যে রাজনৈতিক দল করে এরাও তাই করে। অনেকটা ধর্মের মতো। জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্ম নিয়েই মানুষ মৌলবাদী হয়ে ওঠে যেমন করে।
আমাদের দেশে প্রতি বছর অর্ধ লক্ষাধীক মানুষ আত্মহত্যা করে। এর অধিকাংশই পারিবারিক টানাপোড়েনে। শিক্ষার্থীদের মধ্যেও হাজার হাজার আত্মহত্যা করে। ২০২১ সালের একটি জরিপ রয়েছে, যেখানে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর। আমাদের এলাকাতেও বেশ কজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন সময়ে আত্মহত্যা করেছে। এর প্রায় সবগুলোই ঘটেছে পরিবারের সদস্যদের অবিবেচকের মতো আচরণের কারণে। স্কুলে যখন নিপীড়নের শিকার হয় তখনও তার দায় চাপিয়ে দেয়া হয় শিক্ষার্থীর উপর। পরিবার সবসময় তুলনা করে অমুকে অত ভাল করলো আর তুই কি করিস? এই চাপটা তাদের মধ্যে অসহনীয় হয়ে ওঠে। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকও একটি সমস্যা। এখানে কিছু লোক কেবল নিজেদের সাফল্যের সংবাদই দিতে থাকে। আমার শালীর ভাসুরের ছেলে গোল্ডেন এ+ পেয়েছে, আমার অমুক এভাবে সফল হয়েছে, ওখানে বাড়ি করেছে, উচ্চ শিক্ষায় বিদেশ যাত্রা.. .. এসব কথিত অর্জনের সাথে অনেক শিক্ষার্থী নিজেদের তুলনা করে হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে। মনে করে আমার জীবনে কখনোই সফলতা আসবে না। এ জীবন অর্থহীন! এসব কারণে একজন শিক্ষার্থী বিষন্নতার মধ্যে পড়ে গেলে তাকে সহজে বের করে আনা যায় না। পরিবারের প্রত্যাশার চাপ মারাত্মক হয়ে ওঠে। দরিদ্র পরিবারগুলো লেখাপড়ার খবরই রাখে না। একবার একজন দরিদ্র মা, তার সন্তানের একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়ার অনুরোধ করতে আসলো। খবর নিয়ে জানলাম, ছেলেটি তৃতীয় বিভাগে এসএসসি পাশ করেছে। অথচ মা মনে করছে, ছেলেকে এতো পড়ালাম, এখন একটি চাকরি তো পাবে!
আমাদের দেশে অধিকাংশ পরিবারই দরিদ্র এবং মা-বাবা উচ্চ শিক্ষিত নন। পরিবারের দায়িত্ব বাড়িতে শিক্ষার্থীর জন্য পড়ার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা। বাড়িতে শিশু নিজে স্কুলের পড়া তৈরি করবে। এতে তার মেধার বিকাশ ঘটবে এবং নিজে একটি কাজ করতে পেরে আত্মবিশ্বাসী হবে। নিজে কিছু করতে পেরে উৎসাহিত হবে এবং নিজের কাজটি নিজে অনবরত করতে থাকবে। যদি পিতা-মাতা বা পরিবারের কেউ তার কাজটি করে দেয় বা প্রাইভেট টিউটর তার সমস্যার সমাধান করে দেয় তবে তার পক্ষে সমস্যার সমাধান করা শেখা হয় না। একসময় যখন সমস্যায় পড়ে তখন আর তা সমাধান করতে পারে না। আমাদের পরিবারগুলো মানবিক আচরণ করা জানে না, সদাচার ও সুদ্ধাচার সম্পর্কেও ভাল ধারণা রাখে না। ফলে পরিবারের উপর নির্ভরশীল শিশুরা এসব বিষয়ে ভুল শিক্ষা অর্জন করে। শিশুর বিকাশে এগুলো খুবই প্রতিবন্ধক। ঢাকার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন প্রতিষ্ঠাতার সাথে কথা হয়েছিল। তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের চেয়ারম্যান তখন। বাড়িতে অভিভাবকদের পড়ানোর ক্ষতিকর দিক নিয়ে কথা বলার সময় জানালেন, তারা তাদের প্রতিষ্ঠানে নিয়ম চালু করেছেন যে, ‘অভিভাবকগণ শিশুদের বাড়িতে পড়াতে পারবেন না।’ তারাও মনে করতেন বাড়িতে পড়ালে একটা কন্ট্রাডিক্টরি তৈরি হয়। অভিভাবক সর্বোচ্চ এক বিষয়ে অভিজ্ঞ হতে পারেন৷ সব বিষয়ে তার জ্ঞান দান প্রায়শই ভুল হয়৷ একজন সরকারি কর্মকর্তা এমন শর্ত দেখে খুব ক্ষেপে গেলেন এবং তার সন্তানকে স্কুল থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা সাম্প্রতিক সময়েও একজন বিচারক ও একজন ডিসি (ডেপুটি কমিশনার) এর আচরণ দেখলাম। এদের কাছ থেকে সন্তানরা যে ভাল কিছু শিখবে না তার প্রমাণ ওই বিচারকের কন্যাটি। কন্যাটি অহংকার করতে শিখেছে কিন্তু তার মানবিক বিকাশ ঘটেনি, সামাজিকতা শিখেনি।
শিশুদের মেধার বিকাশ করতে হলে তিনটি কাজ করতেই হবে- ১) প্রাইভেট টিউশন নিষিদ্ধ করা, ২) গাইড বই নিষিদ্ধ করা ও ৩) বাড়িতে অভিভাবকদের পড়ানো নিষিদ্ধ করা। প্রাইভেট টিউটর ও গাইড বইর চেয়েও পরিবার শিক্ষার্থীর জন্য আরো বেশি ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। যারা মৌলবাদী বা জঙ্গি হয়েছে তাদের অর্ধেকের বেশি এসেছে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। তবে অধিকাংশ জঙ্গিই বহন করে পরিবারের ভাবাদর্শ। পারিবারিক শিক্ষাই তার মধ্যে জঙ্গিবাদের বীজ বপন করে দিয়েছে। জরিপ বলছে খুব কম সংখ্যক জঙ্গিই অনলাইনের কারণে জঙ্গি হয়েছে৷ স্ত্রীরা সাধারণত স্বামীর কাছ থেকে, সন্তানরা পরিবার থেকে এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রাইভেট টিউটরের কাছ থেকে জঙ্গিবাদে উৎসাহিত হয়েছে৷ নারায়ণগঞ্জের এক মা তার সন্তানকে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিতে পাহাড়ে পাঠিয়েছেন। যদি স্কুলের শিক্ষা ও পারিবারিক শিক্ষা ভিন্ন হয় তবে শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রকৃত শিক্ষা অর্জিত হয় না।