মজিব রহমান
আমরা জানি সাপ ভয় পেয়ে মানুষকে কামড়ায়। সে যে ফোঁস ফোঁস করে তা ওই ভয়ের কারণেই। আমরা মনে করি সাপ খুব হিংস্র, সাপ খুব প্রতিশোধ পরায়ণ। বাস্তবিক সাপ প্রতিশোধ পরায়ণও নয়, হিংস্রও নয়। তার ওই আক্রমণ ভাবটা আসে ভীতি থেকে। অনেক গিরগিটিও শরীর ফুলিয়ে অন্যকে ভয় দেখায়। মনে হয় তারা আক্রমণ করবে। আসলে তারা আক্রমণকারীকেই ভয় পেয়ে বসেছে। অমন ভাব নেয় আর মনে মনে বলে, ‘সরে যা, সরে যা; তাহলেই বাঁচি! সক্রেটিসকে কেন শ পাচেক বিচারক মিলে মৃত্যুদণ্ড দিল। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে, তিনি কারো ক্ষতি করতেন না, কাউকে মারতে যেতেন না, ভয় দেখাতেন না। তিনি কেবল জ্ঞানের কথা বলতেন। তাঁর প্রশ্ন করে করে অন্যকে পরাস্ত করার কৌশল দেখে অন্যরা ভয় পেতো। কাকে কখন ধরে জ্ঞানবানে জর্জরিত করে ভুয়া প্রমাণ করে ছাড়েন সেই ভয়ে অন্যরা ভীত হয়ে পড়েছিল। সেই ভীতি এথেন্সের বহু মানুষকে আক্রমণাত্মক করে তুলেছিল সক্রেটিসের প্রতি। তারা বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করেই তাকে হত্যা করে। কথাকে ভয় পেতে আমরা আরো বহু দেখেছি। ব্রুনোকেও খ্রিস্টান ফান্ডামেন্টালিস্টরা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তারা প্রথমে ভয় দেখায়। ব্রুনোতো মারামারি করার লোক নন। তিনি জ্ঞান চর্চা করেন। তিনি বলতে চান, ‘দেখো পৃথিবী সূর্যের চারদিকে না ঘুরলে হিসাব মিলে না। সূর্যও স্থির নয় এবং মহাবিশ্বের কেন্দ্রও নয়। হিসাব দেখো।’ তার হিসাবেতো অনেকের মধ্যে মারাত্মক ভীতি তৈরি করে দিয়েছিল। অনেকের রুটি-রোজগারই শেষ হয়ে যেতো। তারা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। ব্রুনোকে পুড়িয়ে হত্যা করে।
অনেক নেতাকেই আমরা ভয় পেতে দেখেছি। হিটলার কি ইহুদীদের ভয় পেতো? হিটলারও দেখেছে, ইতালির ব্রুনো বা এথেন্সের সক্রেটিসের মতোই জার্মানির ইহুদিদের মধ্যে জ্ঞানের বিস্ময়কর বিকাশ ঘটেছে। তিনি জার্মান জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলে দেখাতে চেয়েছিলেন, জার্মানরাই বিশ্বসেরা। জার্মানিতে তখন জনগোষ্ঠীর মাত্র ১+% ইহুদি। কিন্তু ইহুদীরা তার এই ভাবনার অন্তরায়। তিনি ঘৃণা যতই ছড়ান কিন্তু বাস্তবতা হল, কার্ল মার্ক্স থেকে আইনস্টাইন পর্যন্ত ব্যক্তিত্বদের দিকে তাকালে তিনি ভীতই হতেন। নোবেল ঘোষণা দেয়ার পরে জার্মান ইহুদিদের বেশ কয়েকজনই নোবেল পান। এডলফ ফন বাইয়ার, অটো ওয়ালাচ, রিচার্ড উইলস্টেটার, ফ্রিটজ হ্যাবারসহ ইহুদিদের তিনি নোবেল পেতে দেখেছেন। ভয় পাওয়ার আরেকটি কারণও ছিল। তিনি মনে করতেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের কারণ ছিল ইহুদিরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও ইহুদিদের কারণে তিনি হেরে যেতে পারেন। মানে হল তিনি ইহুদীদের ভয় পেতেন আর তাতেই তিনি ইহুদিদের উপর হিংস্র আচরণ করেন। আমার এই ধারণা ভুলও হতে পারে কারণ এখনো নিশ্চিত করে বলা যায় না কেন হিটলার ইহুদিদের এভাবে হত্যা করেন।
আমার এলাকার একটা ঘটনা। একজন নেতা সম্পূর্ণ বিনা কারণেই আমার উপর খগড়হস্ত। তো একদিন তার এক ক্যাডারের কাছে জানতে চাইলাম, ‘তোমরা আমার সাথে এতো ঝামেলা করছো কেন?’ সে বলল, ‘আমরা কতটা খারাপ কাজ করি তার সামান্যই আপনি জানেন। আমরা বসে যখন পরিকল্পনা করি তখন চিন্তা করি এই অপকর্ম করলে কে কে বাধা দিতে পারে। তখন সবার আগে আপনার নামটাই আসে। আপনি লেখাপড়া জানা মানুষ। বিভিন্ন সংগঠন করেন। বিভিন্ন লোকদের সাথে সম্পর্ক আছে। সেই ভয়ের কারণেই আপনার প্রতি আক্রমণাত্মক আচরণ করি।’ আমি বলি, ‘তাহলেতো আমার কোন দোষ নেই?’ সে মানতে রাজি নয়। সেটা নাকি আমার বিষয়। সে সত্যটা প্রকাশ করেছে। ফলে আপনি কাউকে ভয় পান এটার চেয়ে ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে, যদি আপনাকে কেউ ভয় পায়। যে আপনাকে ভয় পাবে সে আপনাকে হত্যাও করে ফেলতে পারে। সাদ্দাম ভয়ের কারণেই মিথ্যা তথ্য দিয়ে আভাস দিয়েছিল, তার কাছে পারমানবিক অস্ত্র আছে। কিন্তু তাতে যে, আমেরিকা ও ইসরাইলই ভয় পেয়ে বসে এবং ইরাকের উপর আক্রমণ করে বসে।
তাহলে হিরু আলমের প্রতি আমরা আক্রমণাত্মক কেন? হিরু আলমকেও কি আমরা ভয় পাই? হিরু আলম সব অযোগ্যতার আধার। কোন একটা কাজও ঠিকঠাক করতে পারেন না। না জানেন অভিনয়, না জানেন গান, না জানেন কথা, না জানেন রাজনীতি। এর মাঝেও তিনি ফাঁকতালে আখের গুছিয়ে নিয়ে হয়েছেন কোটিপতি! ফলে তাকে তো আর গরিব-গোবরা বলা যায় না। তাহলে ভয়টা কিসের? কাসেম বিন আবু বকর নাকি বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক। তাকে কেউ ভয় পায়নি। ফলে তার প্রতি কেউ আক্রমণাত্মকও ছিলেন না। তিনি অতি সরলভাবে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে নায়ক নায়িকাদের প্রেম করাতেন। তার উপন্যাস জুড়ে থাকতো সাধারণ ধর্মভীরু পরিবারের প্রেম-ভালবাসা, দুঃখ-যাতনার কথা। টুইন টাওয়ার হামলার পরে মুসলিমদের প্রতি একটা ভীতি তৈরি হয়। মানুষ ভয় পেতে থাকে এবং এজন্য বিভিন্ন স্থানে উল্টো মুসলিমরাই আক্রান্ত হয়েছেন। সেই ভীতি থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করেছে আফগানিস্তান। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের জঙ্গি বিরোধী যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার কারণ ওই ভীতিই৷ আমাদের মতো দেশে সরকারে গিয়েই বিভিন্ন নেতিবাচক কারণে জনপ্রিয়তা হারায় দলগুলো৷ তখন তারা বিরোধীদলের জনপ্রিয়তাকে ভয় পেতে শুরু করে৷ আর তা থেকে শুরু হয় বিরোধীদলের উপর আক্রমণ ও নির্যাতন৷
গরীবের সৌন্দর্যতা নিয়ে হুমায়ুন আজাদের একটি কবিতা আছে৷ কবিতাটিতে তিনি একটার পর একটা গরীবের অসৌন্দর্যতা তুলে ধরছেন৷ সবশেষে বলেছেন, গরীব যখন রুখে দাঁড়ায় তারচেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই৷ হিরু আলম আজ আর নিজে গরীব নেই কিন্তু গরীবদের প্রতিনিধি হয়ে আছেন৷ তিনি আপারক্লাসড হয়েছেন দরিদ্র থেকে ধনীতে কিন্তু অবয়ব ও ভাবে তিনি গরীব৷ তিনি বউ পিটাতে পারেন, জঘণ্য অভিনয়, বিরক্তিকর নাচ, ছ্যাবলামিপূর্ণ কথা প্রকাশ করেন৷ কিন্তু যখন তিনি বলেন, ‘মামুনুর রশীদ স্যার, আমাকে না মেরে ফেলা পর্যন্ত আমি থামবো না৷’ — তখন দরিদ্রসহ অনেকে তার মধ্যে সৌন্দর্যতাটা খুঁজে পান৷ অন্যদের কাছে এটাই ভয়ের হয়ে উঠে৷ মনে হয় ছন্দময় গান, ছন্দবদ্ধ কবিতা, নান্দনিক নৃত্য— সব তিনি নষ্ট করে ফেলবেন! এই ভয় থেকেই আক্রমণটা আসছে৷ সাপতো নিজে বাঁচার জন্যই আমাদের ছোবল দেয়, আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে৷ হিরু আলমেরও ভয় আছে, কারণ তার কোটি টাকার সম্পদ আছে৷ সেও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবে৷ হুমায়ুন আজাদই আরেকটি কবিতায় লিখেছেন, ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে৷’ এ কবিতায় ড. আজাদ নিজের ভয়ের কথাই প্রকাশ করেছেন৷ এটা এলিট শ্রেণিরও ভয়৷ তারা কি সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যেতে দিবে?