পর্তুগালের প্রেসিডেন্ট মারসোলো রেবেলো ডি সুজার সঙ্গে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের এক বিশেষ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘সাসটেইন্যাবিলিটি অ্যান্ড সোসাইটি ফোরাম’- এ বিশ্বনেতারা টেকসই ও অন্তর্ভূক্তিমূলক ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে বিভিন্ন আইডিয়া নিয়ে আলোচনা করেন মূল বক্তা ড. ইউনূস৷ সভায় তিনি পুরো বিশ্ব থেকে দারিদ্র্য চিরতরে নির্মূল করতে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের ওপর জোর দেন ।
শান্তিতে নোবেলজয়ী বাংলাদেশি এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিজেই দারিদ্র্য সৃষ্টি করে এবং এই ব্যবস্থার অধীনে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব নয়। মানুষ এককভাবে দারিদ্র্য তৈরি করে না, আমদের অর্থনেতিক কাঠামোর ভেতরেই তৈরি হয় দারিদ্র্য।”
“সাসটেইন্যাবিলিটি অ্যান্ড সোসাইটি ফোরামে” টেকসই ও অন্তর্ভূক্তিমূলক ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন আইডিয়া নিয়ে আলোচনা করতে বিশ্বনেতারা জড়ো হয়েছেন। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যাগুলোর সমাধানে সম্পদ সমাবেশ ও এই উদ্দেশ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপযুক্ত নীতি-কাঠামো প্রণয়ন করার বিষয়ে আলোচনা করেন তারা।
ইউনূস মানবীয় মূল্যবোধ-কেন্দ্রিক একটি নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সেখানে তিনি “তিন শূন্য” তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মোকাবিলা, দারিদ্র্য দূরীকরণ করতে সম্পদ-কেন্দ্রীকরণ ও মানুষের উদ্যোক্তা-শক্তিকে বিকশিত করে বেকারত্ব দূর করার মিশন এই তিন শূন্য। ইউনূস বলেন, “মুনাফা ও লোভের ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা আমাদের এই সভ্যতা একটি নিশ্চিত আত্মহননের পথে এগিয়ে চলেছে। সভ্যতার এই জাহাজ দ্রুত ডুবে যাচ্ছে। এই পৃথিবীতে মানব জাতি তার অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে তাকে দ্রুত এই ‘তিন শূন্য-ভিত্তিক’ একটি নতুন সভ্যতার জাহাজ নির্মাণ করে তাতে উঠে পড়তে হবে।” তিনি সাবধান করেন, “সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, টিকের থাকার এই পরিবর্তনের জন্য আমাদের সামনে বড়জোর কয়েকটি দশক সময় আছে, কয়েকশ বছর নয়।”
বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মানেতো পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা৷ দারিদ্র্য সৃষ্টিকারী এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তে কার্ল মার্ক্স ভেবেছিলেন সমাজতন্ত্রের কথা৷ সমাজতন্ত্রের শুদ্ধ ও সফল প্রয়োগ আমরা দেখিনি৷ রাশিয়ায় বলশেভিক পার্টির মাধ্যমে লেনিন চেষ্টা করেছিলেন৷ কিন্তু সেখানে আদর্শিক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল না৷ সেখানে কোনরূপ গণতন্ত্রই ছিল না৷ কিউবার বিপ্লব সমাজতান্ত্রিক ছিল না৷ ফিদেল ক্যাস্ত্রো বিপ্লবের সময়ও কমিউনিস্ট ছিলেন না৷ উত্তর কোরিয়াতে স্রেফ স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রই বিদ্যমান৷ চীন ও ভিয়েৎনামে মিশ্র অর্থনীতি৷ ব্রাজিলসহ ল্যাতিন দেশগুলোতে সমাজতান্ত্রিক দল দরিদ্রবান্ধব হয়ে পুঁজিবাদী সিস্টেমেই দেশ চালায়৷ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ও ত্রিপুরার কমিউনিস্টদের সুযোগই ছিল না পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বাইরে যেতে৷
বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিজেই দারিদ্র্য সৃষ্টি করে— এর সাথে দ্বিমত করার জায়গা নেই৷ আমিও মনে করি তীব্র নীতিহীন প্রতিযোগিতামূলক এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে বিনির্মাণ করতেই হবে৷ সেটা দ্রুতই হোক৷ সমাজতন্ত্র বা আরো কোন উন্নত ব্যবস্থা দিয়ে এই দারিদ্র্য সৃষ্টিকারী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিস্থাপিত হোক৷