ইয়স্তেন গার্ডারের সোফির জগৎ বইটি পড়ে খুবই মুগ্ধ হয়ে বইটি হাতে নিয়েই হাঁটছিলাম। একজন মাদকসেবী শিক্ষকের সাথে দেখা। তিনি জানতে চাইলেন, ‘কি বই?’
বললাম, ‘দর্শন নিয়ে লেখা একটি বই।’
তিনি বললেন, ‘বই পড়ে কখনো জ্ঞানার্জন হয় না। জ্ঞানার্জনের জন্য তোমাকে যেতে হবে ধ্যানে। তুমি নদীর পাড়ে গিয়ে একমনে দাঁড়িয়ে থাকলেই তোমার মধ্যে জ্ঞান প্রবেশ করবে।’
মনে হল তিনি নদীর তীরে বসে গঞ্জিকা টেনে বিস্তর জ্ঞানার্জন করে ফিরেছেন মাত্র। তবু বললাম, ‘জ্ঞান কি?’
তিনি বললেন, ‘জ্ঞানের কোন সংজ্ঞা হয় না। কেবল উপলব্ধি হয়।’
ওনার সাথে ধৈর্য ধরেই কথা বলি। তাই বললাম, কোন বিষয়ে জানতে বা বুঝতে হলে আপনাকে তো তথ্য লাগবে। অনুসন্ধান ও শিক্ষাগ্রহণ ছাড়া কিভাবে সেই তথ্য পাবেন? আপনাকে পড়তে হবে নইলে যারা জানে তাদের কাছ থেকে জানতে হবে। নদীর পাড়ে দশ বছর চক্ষু বন্ধ করে বসে থাকলে কি জ্ঞান আসবে? কিভাবে বুঝতে পারার ক্ষমতা অর্জিত হবে? সত্যকে কিভাবে খুঁজবেন?’
ভারতীয় সভ্যতায় ধ্যানকেই জ্ঞানার্জনের পথ হিসেবে দেখা হয়েছে। গৌতম বুদ্ধ এক অশ্বত্থ গাছের নিচে বসে ধ্যান করে বুদ্ধত্ব লাভ করেন? বুদ্ধত্ব লাভ কি জিনিস? একটি বিশেষ জ্ঞান লাভকেই আমরা মনে করি বুদ্ধত্ব লাভ। ওই অশ্বত্থ গাছটিকে বলা হয় বোধিবৃক্ষ—বোধি মানে জ্ঞান। আবার বুদ্ধত্বকে বলা হয় বোধিসত্ত্ব মানে যিনি জ্ঞান লাভ করেছেন। গৌতম ধ্যান করেই জ্ঞান লাভ করেছেন। সেই জ্ঞান হল নির্বাণ লাভের জ্ঞান মানে দুঃখ থেকে চিরমুক্তি মানে পৃথিবী থেকে চির বিদায় লাভের জ্ঞান। তিনি বুঝলেন মানুষের আত্মা ২২টি স্তরে ঘুরতে থাকে। তারপর পুণ্যাত্মা লাভ করলেই নির্বাণ লাভ করবে। যেমন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নির্বাণ লাভ করবে। তারা আর অন্যকোন দেহে প্রবেশ করবেন না। কিন্তু জ্ঞানেরতো কিছু বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে— সমর্থনযোগ্য, সত্য ও বিশ্বাসযোগ্য। গৌতমের এই জ্ঞান কি আজকের বিজ্ঞান দ্বারা সমর্থনযোগ্য, সত্য ও বিশ্বাসযোগ্য? বসে বসে ভাবলেই জ্ঞান চলে আসবে এমন ভাবনার পরিণতি কি? আলস্য? সন্ন্যাস? গৃহত্যাগ? অজ্ঞতা?
আমরা দক্ষিণ ভারতের সিনেমা ‘বাহুবলী’ অনেকেই দেখেছি। প্রকৃতপক্ষে বাহুবলী ও ভরত ছিলেন প্রথম জৈন তীর্থঙ্কর ঋষভের পুত্র। ঋষভ সন্ন্যাস গ্রহণ করার জন্য বড় পুত্র ভরতকে রাজ্য দান এবং ছোট পুত্র বাহুবলীকে উত্তরাধিকার নির্বাচন করলেন। দুই ভাইর মধ্যে শুরু হল ঝামেলা। তারাতো অবতার তাই একজন আরেকজনকে হত্যা করতে পারবেন না। সিদ্ধান্ত হল, হবে চক্ষুযুদ্ধ, জলযুদ্ধ ও মল্লযুদ্ধ। তিন যুদ্ধেই বাহুবলী বিজয়ী হলেন। কিন্তু বড়ভাইকে পরাস্ত করে তিনি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হলেন। তিনি জ্ঞানার্জনের জন্য ধ্যান শুরু করলেন। লতাপাতা, কীটপতঙ্গ ও ধুলায় দেহ ঢাকা পড়ে। বাহুবলীর পিতা তার দুই কন্যার কাছ থেকে জেনে বললেন, ‘বাহুবলী জ্ঞানের খুব কাছে দাঁড়িয়েও জ্ঞানার্জন করতে পারছে না— হস্তী ত্যাগ করতে না পারার কারণে।’ বাহুবলী বুঝতে পারলেন তিনি গর্ব ও অহংকারের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। এবার ধ্যানে বসার সাথে সাথেই তাঁর মধ্যে জ্ঞান ঢুকে গেলে।
আমরা ভারতীয় পুরাণে বিস্তর ধ্যান করে দিব্যজ্ঞান লাভ করতে দেখি। দিব্যজ্ঞান থাকলে ধ্যান ছাড়াও উপলব্ধি করা যায়। উদাহরণ হিসেবে ইদ্র ও অহল্যার ঘটনা আমরা বলতে পারি। ব্রহ্মার তৈরি পরমাসুন্দরী নারী অহল্যাকে বিয়ে করতে ব্যর্থ হয়ে তাকে ভোগ করার বাসনা জেগেছিল ইন্দ্রের মনে। ইন্দ্রের ষড়যন্ত্রে রাত দুটোকেই ভোর ভেবে অহল্যার বৃদ্ধ স্বামী গৌতম মুণি গেলেন স্নান ও প্রার্থনা করতে। এই সুযোগে দেবরাজ ইন্দ্র গৌতমের রূপ ধরে অহল্যার ঘরে ঢুকলেন। অহল্যা দিব্যদৃষ্টি দিয়ে ইন্দ্রকে চিনে ফেললেন। একজন ক্ষমতাবান যোগীর সঙ্গিনী হলে কিছু দিব্যজ্ঞানতো থাকবেই। অহল্যা সুমিষ্ট মুচকি হাসি দিয়ে ইন্দ্রের আহবানকে প্রত্যাখ্যান করলেন। ইন্দ্র অহল্যার সৌন্দর্য নিয়ে সুন্দর সুন্দর কাব্য করে বিমোহিত করে সেক্স করে ফেললেন। ইন্দ্রের চলে যাওয়াটা দেখেই গৌতম মুণি দিব্যজ্ঞানে বুঝে গেলেন কাম সারা! গৌতম আর কি করবেন? অভিশাপই দিলেন যে, যুদ্ধে তাঁকেও ধর্ষিত হতে হবে এবং ইন্দ্র যে ধর্ষণ প্রথার সূচনা জগতে করলেন তার অর্ধেক পাপ তাকেই বহন করতে হবে। দুই গৌতম কিন্তু এক নয়।
মুসলিমরা এখন ধ্যান করেন না। তবে মোরাকাবা অনেকটাই ধ্যানের মতো। মুসলিমদের নবী মুহাম্মদ সা. কিন্তু ধ্যান করতেন। মক্কা থেকে মাইল দুয়েক দূরে হেরা গুহার ভিতরে তিনি ধ্যান করতেন। আমরা জানি সেখানে খাদিজা রা. খাবার নিয়ে যেতেন। নবীজি ৩৫ বছর বয়স থেকে ধ্যান করা শুরু করেন এবং ৪০ বছরে এসে নবুয়ত্ব লাভ করেন অর্থাৎ অহি পাওয়া শুরু করেন। তিনি সম্ভবত ১৫ বছর ধ্যান করেছেন। বলা হয় মোরাকাবা করলে ক্বলবের চোখ খুলে যায়। দিব্যজ্ঞানের সাথে এর আক্ষরিক মিল রয়েছে। আমরা আবুল মনসুর আহমেদের হুজুরে কেবলা গল্পে পীর সাহেবকে মোরাকাবায় বসতে দেখি। গল্পে পীরের কাছে হযরত মুহাম্মদ সা. চলে আসেন। নবিজি পীরকে তিরস্কার করেন আরেকটি বিয়ে না করায়। তিনি নির্দিষ্ট এক নারীকে বিয়ে করার নির্দেশ দেন। গল্পে আমরা বুঝতে পারি পুরোটাই ওই ভণ্ড পীরের প্রতারণা ছিল।
ধ্যান করেই জ্ঞান ও দিব্যজ্ঞান লাভ করার এমন অজস্র উদাহরণ এশিয়ায় বিশেষ করে আমাদের ভারতীয় সভ্যতায় রয়েছে। মানুষ ছাড়াও গরুড় পাখির ধ্যান করে দিব্যজ্ঞান লাভ তথা সত্য জানার কথাও হিন্দু ধর্মগ্রন্থে আছে। ধ্যান করে আসলে কি দিব্যজ্ঞানই লাভ হয়? এখান জ্ঞান ও দিব্যজ্ঞান একই ধরে নিন। একসময় জ্ঞানার্জনের জন্য শিষ্য গুরুর বাড়িতে গিয়ে তার কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করতো। এখন লেখাপড়া করে জ্ঞানার্জন হচ্ছে। তবে বই না পড়েও সম্ভব যদি সেটা ইউটিউবে ভিডিও দেখে শিখে জ্ঞানার্জন করা যায়। দিব্যজ্ঞান অর্জন করেছেন কিনা তা বুঝতে কাণ্ডজ্ঞান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নেশা করে নদীর পাড়ে গিয়ে বুম হয়ে না ঘুমিয়ে সারারাত বসে থাকতে পারবেন আর কেবল ভাবতেই পারবেন যে, আপনি দিব্যজ্ঞান লাভ করেছেন। কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই মানুষ বুঝে ফেলবে আপনার অবস্থা আর মুচকি হেসে আপনাকে পথ ছেড়ে দিবে। এ মুচকি হাসি অহল্যার মুচকি হাসি নয়, এটা তাচ্ছিল্যের হাসি। এখন আর ধ্যান করে জ্ঞানার্জনের সুযোগ নেই। আমাদের গানের জগতেও আত্মা, পরমাত্মা ও দিব্যজ্ঞানের ছড়াছড়ি রয়েছে। লালনের একটা গান আছে-
সহজ মানুষ ভজে দেখনারে মন দিব্যজ্ঞানে/ পাবিরে অমূল্য নিধি বর্তমানে।
ভজ মানুষের চরণ দুটি/নিত্য বস্তু হবে খাঁটি/ মরিলে সব হবে মাটি
ত্বরায় এই ভেদ লও জেনে।
শুনি মরলে পাবো বেহেস্তখানা/ তা শুনে তো মন মানে না।
বাকির লোভে নগদ পাওনা/ কে ছাড়ে এই ভুবনে।
আচ্ছালাতুল মিরাজুল মোমিনিনা/ জানতে হয় নামাজের বেনা
বিশ্বাসিদের দেখাশুনা/ লালন কয় এই ভুবনে৷৷
বাউলরা মানুষকে গুরুত্ব দেয়। মানুষ ভজে সোনার মানুষ হবি/ মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মুল হারাবি। সহজ মানুষকে ভজনা করতে বলেছেন। ভজনা করা মানে ভক্তি/শ্রদ্ধা করা। মরলেতো বেহেস্ত পাবে। এটা শুনে অনেকেই উতলা হয়ে উঠেন। তারা দিব্যজ্ঞানে উপলব্ধি করেন, হুরপরী বরণ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। এরা জঙ্গি হয়ে উঠে। বেহেস্ততো বাকির খাতা, জীবনটা হল নগদ পাওনা। কেউতো বাকির লোভে নগদ ছাড়তে চায় না। আধ্যাত্মিক সাধকরাও ধ্যানের মধ্যেই স্রষ্টাকে দেখতে চান। নামাজে মুমিনরা মেরাজের মতো আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের উপলব্ধি পান। যে নামাজে আল্লাহর উপলব্ধি আসে সেই নামাজের ভেদ জানতে বলেছেন লালন। কিন্তু বিশ্বাসীদের স্রষ্টার সাথে দেখাশুনা এই জগতে কিভাবে হবে? ধ্যানে? বোধিসত্ত্ব, জ্ঞান, দিব্যজ্ঞান লাভ হবে ধ্যানে? সমর্থনযোগ্য, সত্য ও বিশ্বাসযোগ্য জ্ঞান কি ধ্যান করলে লাভ হবে?