মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম স্বাধীনতার পরে চূড়ান্তভাবেই ব্যর্থ হয়৷ স্বাধীন দেশে তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই নানা অভিযোগ উঠে৷ একনায়কতন্ত্র আসে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড আসে, জেলহত্যাকাণ্ড আসে, সামরিক শাসন চলতে থাকে৷ শিক্ষাঙ্গণে নকল আর সমাজ থাকে সন্ত্রাস নির্ভর৷ ৬৯-৭০-৭১ প্রজন্ম যাদের জন্ম ভাষা আন্দোলনের আগে পরে তারা স্বাধীন দেশে ব্যর্থ হয়৷ এই প্রজন্ম আদর্শ সমাজ গঠনে মনোযোগ দেয়নি, সংগ্রাম ভুলে গিয়েছিল৷ এদের কেউ কেউ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়, বৈষম্য বাড়িয়ে দেয় ও দুর্ভিক্ষ আনে৷ মুক্তিযোদ্ধারা সমাজকে ডমিনেট করতে পারেনি৷
এর পরের প্রজন্মই আমাদের যাদের জন্ম ৭১ এর আগে পরে৷ এ প্রজন্মটা এরশাদের স্বৈরশাসনের মধ্যে বেড়ে উঠেছে৷ শিক্ষাঙ্গণে নকল আর দেশে সন্ত্রাস চলতে থাকে৷ তবুও এরশাদ বিরোধী একটা আন্দোলন হয়৷ কিন্তু এই প্রজন্ম দলকেন্দ্রিক দালালীতে আচ্ছন্ন হয়ে যায়৷ তারাও রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে নষ্ট হতে থাকে৷ সন্ত্রাসের পরিবর্তে শুরু হয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতি৷ বৈদেশিক ঋণে ও টাকা পাচারের সংস্কৃতি আসে৷ নীল ছবির জোয়ার আসে৷ মৌলবাদেরও উত্থান ঘটে৷
এরশাদ আমলে জন্ম নেয়া পরের প্রজন্ম কিছুটা গণতন্ত্রের স্বাদ পায়৷ এরশাদ বিরোধি আন্দোলন সংগ্রামে তারা অংশ নেয়নি, সুফল নিয়েছে৷ এ সময় দেশে মধ্যবিত্তের উত্থান ঘটে৷ গণতান্ত্রিক সরকারগুলো জনবান্ধব কর্মসূচি নিতে বাধ্য হয়৷ কিছুটা টেকসই উন্নয়ন ঘটে৷ কথা বলার সুযোগ তৈরি হয়৷ মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণের হার বেড়ে যায়৷ ধর্মান্ধতা থেকে বের হওয়ার প্রচেষ্টা ছিল আবার জঙ্গিবাদেরও বিস্ফোরণ ঘটে৷ প্রবাসী রেমিট্যান্স ও গার্মেন্টের সুফল আসে৷ আন্দোলন ও প্রতিবাদও ছিল৷ ইতিহাসের চারটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়৷ তবে নকলের পরিবর্তে আসে মানহীন শিক্ষা৷
গত শতাব্দীর শেষ দশকে জন্ম নেয়ারাই আজকের তরুণ ও যুবা প্রজন্ম৷ এই প্রজন্মকে বলা যায় ফেসবুক- ইউটিউব -টিকটক প্রজন্ম৷ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তারা সক্রিয় নয়৷ আন্দোলন বিমুখতা ও নির্জীবতা তাদের বৈশিষ্ট্য৷ এ সময়ে দেশে বহুমাত্রিক মাদকের বিস্তার ঘটে৷ অব্যাহত থাকে মানহীন শিক্ষা এবং সংস্কৃতি-বিমুখতা চলতে থাকে৷ সমাজ থেকে কথা বলার সুযোগ উঠে যায়৷ ভোটহীন সংস্কৃতি চালু হয়৷ আইনের ব্যাপক অপপ্রয়োগ ঘটে৷ সরকার বিরোধী রাজনীতি ধ্বংস হয়ে যায়৷
একেকটা প্রজন্ম একেক রকম৷ এই প্রজন্ম ক্রমাগত অর্থের জন্য পাগল কিন্তু নিজেকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে না পেরে হতাশায় নিমজ্জিত৷ তাদের এদিকে শান্ত করে অন্য দিকে অশান্ত করতে হবে। আমাদের গণতান্ত্রিক অচলাবস্থা, জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকার সমস্যা এবং আর্থ-সামাজিক সমস্যা নিয়ে এই প্রজন্মের ভিতরে ক্ষোভ ও রাগ তৈরি করতে হবে৷। তবে কোন শিশুসুলভ ক্রোধ নয়, প্রজন্মের ভবিষ্যৎটাই নির্ধারিত হবে সেই ক্রোধে৷ গণতান্ত্রিক অচলাবস্থার মধ্যে আমাদের দেশ আরও এক দশক টিকে থাকতে পারবে কিনা তা নিয়ে উদ্বেগের কারণ তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রকে বাঁচিয়ে রাখার প্রকৃত উদ্বেগ এটা।
আমদের প্রজন্ম বুঝতে শিখেছে স্বাধীন দেশে কিন্তু স্বাধীনতা বুঝতে পারেনি৷ আমাদের প্রজন্ম স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করেছে আবার এটি প্রথম প্রজন্ম যারা প্রথম প্রযুক্তির সংস্পর্শে এসে সক্রিয় থেকেছে৷ কিন্তু তারা দেশকে উন্নত করার দৃঢ় ইচ্ছা প্রকাশে ব্যর্থ হয়েছে। ভার্চুয়াল এবং সংগ্রামের অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে একটি প্রজন্ম হিসেবে, সত্যের সন্ধান করতে পারেনি। ইতিবাচক খবর নেই৷ প্রতিটি খবর আমাদের ব্যথিত করে। তা সত্ত্বেও, একটি সুষ্ঠু ধারার গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য আমাদের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে৷ আমরা এখন সংসারের হাল টানছি এবং বর্তমান প্রজন্মকে আশা দিচ্ছি৷ আমাদের উদ্বেগগুলো ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আমাদের আশঙ্কা থেকে আসে৷ আমরা চাই না— একই অভিজ্ঞতা এ প্রজন্মও অর্জন করুক। আমাদের ব্যর্থতাগুলো স্বীকার করেই এই প্রজন্মের প্রতি আশা ও ভরসা রাখছি৷