আমাদের নারী জাগরণের অগ্রদূত বলা হয় বেগম রোকেয়াকে। শত বছর আগের তার কর্মকাণ্ড ওই সময়ের নারীরা খুব কমই জানতে পেরেছিল। আজকাল নারীরা আর বেগম রোকেয়ার খোঁজও রাখেন না। আমি অনেক নারীর কাছেই জানতে চাইতাম প্রিয় লেখক কে? তসলিমার বই নিষিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত অধিকাংশই তসলিমার নামই বলতেন। তসলিমার নির্বাচিত কলাম নারীরা নিজেদের বাইবেল মনে করে কিনেছে। তসলিমার কলামগুলো খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তা ছিল জীবন ঘণিষ্ঠ কথায় ভরপুর। এখন তসলিমা আর দেশে নেই, বাংলার জীবন ঘণিষ্ঠতারও সুযোগ নেই। তাঁর অকপট আত্মজীবনীগুলোও একেরপর এক নিষিদ্ধ হওয়ায় পড়ার সুযোগ নেই। ফলে তসলিমা যে সম্ভাবনা তৈরি করেছিলেন, তা আর থাকেনি।
বাংলার নারীদের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস কম নয়। ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা শাসক হিসেবে আমরা দেখি সম্রাজ্ঞী সুলতানা রাজিয়াকে। প্রায় ৮শত বছর আগে, সুলতান ইলতুতমিশ তার কন্যাকে দিল্লীর শাসক হিসেবে মনোনীত করে গিয়েছিলেন। তিনি একজন ভাল প্রসাশক, দক্ষ সেনাপতি ও তুখোড় সৈন্য ছিলেন। সম্রাজ্যে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। শাসনকার্য দৃঃঢ়ভাবে পরিচালনা করার জন্য তিনি নারীত্বের আবরণ পরিত্যাগ করে, পুরুষের পোশাক গ্রহণ করেণ। নারী হওয়ার কারণে ও প্রকাশ্যে পর্দাপ্রথার বিরোধী হয়ে শাসনকাজ পরিচালনা করার জন্যে উলেমা ও প্রভাবশালী শ্রেণির বিরাগভাজন হয়েছিলেন। সুলতানা রাজিয়ার দুইশ বছর পরে ফ্রান্সে এসেছিলেন জোয়ান অব আর্ক। জোয়ান ফ্রান্সকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে দেন। জোয়ানের মাধ্যমে ফ্রান্স ইংল্যান্ডের মধ্যকার শতবর্ষ ব্যাপী যুদ্ধ অবসান ঘটে। একইরকম বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগে ইংরেজরা তাকে আটক করতে সমর্থ হয়। পাদ্রির অধীনে বিচারে তার কার্যকলাপকে প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী আখ্যা দিয়ে তাকে ‘ডাইনি’ সাব্যস্ত করা হয়। আইনে এর শাস্তির বিধান অনুযায়ী তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়।
ভারতে আমরা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে এলিট শ্রেণির হিন্দু নারীদের অংশগ্রহণ করতে দেখি। তবে অসহযোগ আন্দোলনের সময়েই নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ দেখা গিয়েছিল। বিক্রমপুরের কৃতীকন্যা সরোজিনী নাইডু কংগ্রেসের সভাপতির আসন গ্রহণ করেছিলেন। কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়, বিজয়লক্ষ্মীসহ অনেক নারী নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। মুসলিম নারীদের মধ্যে মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীর মা আবিদা বানু বেগমও নারীদের নিয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সরোজিনী নাইডু ১৯৩০ সালে ২ হাজার নারীকে নিয়ে মিছিল করে দর্শনা লবন উৎপাদন কেন্দ্রে আক্রমণ করতে গিয়ে গ্রেফতার হন।মাস্টারদা সূর্যসেনের সাথে সংগ্রাম করেছেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্ত। প্রীতিলতা ইংরেজ ক্লাবে হামলা চালিয়ে ধরা পড়ে গেলে সায়ানাইড খেয়ে আত্মহুতি দেন আর কল্পনা দত্ত সংগ্রাম চালিয়ে যান। রবীন্দ্রনাথ কল্পনা দত্তকে অগ্নিকন্যা উপাধী দিয়েছিলেন।বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল বিপুল ও ভূমিকা ছিল ব্যাপক। ভারতের আরো বিভিন্ন আন্দোলনেও নারীদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধেও আমাদের নারীরা আন্দোলন করেছেন। মতিয়া চৌধুরীও অগ্নিকন্যা খেতাব পান। গণজাগরণ মঞ্চে ভূমিকা রেখে লাকি আক্তারও অগ্নিকন্যার খেতাব পেয়েছিলেন। মতিয়া চৌধুরীর সমসাময়িক আরেকজন নারী নেত্রীকে দেখেছি- সাজেদা চৌধুরী। আরো অনেক নেত্রীই উঠে এসেছেন তবে অধিকাংশই পারিবারিক সূত্রে। পারিবারিক সূত্রে উঠে আসা নারী নেত্রীদের মধ্যে একটা পার্থক্য থাকেই। ভারতেও বিজেপি নেত্রী উমা ভারতী, সুষমা স্বরাজ ও স্মৃতি ইরানীকে দেখেছি যারা নারীদের অগ্রগতির চেয়ে হিন্দুত্ববাদী চেতনাকে নিয়েই বেশি কাজ করেছেন।
নারী নেতৃত্বের দীর্ঘ ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও সাধারণ পরিবারের নারী নেতৃত্বের সেই উত্থানটা যেনো থেমে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে পারিবারিক কারণে রাজনীতিতে আসা নারীদের বাইরে খুব কমই নেতৃত্বের বিকাশ দেখছি। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক রাজনীতি বন্ধ থাকায় অথবা সুষ্ঠু ধারার রাজনীতি না থাকায় নারী নেতৃত্ব বিকশিত হয়নি।একই কারণে রাজনীতিতে পুরুষ নেতৃত্বরও ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। বহু বছর পরে একটি মাত্র নির্বাচন হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে আমরা কজনকে নেতা হয়ে উঠতেনেতা হয়ে উঠতে— যার মধ্যে নুরুল হক নুর বেশ পরিচিতিও পেয়েছেন। এই ধারা বন্ধ হয়ে গেলে শূন্যতা থেকেই যাবে। সবচেয়ে ক্ষতি হবে নারী নেতৃত্ব বিকাশের। স্থানীয়ভাবে সাধারণত প্রভাবশালী নেতাদের স্ত্রী-কন্যারাই বড় পদগুলো দখল করে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই এর অন্যথা হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুধু গণজাগরণ মঞ্চে নেতৃত্ব দেয়ার কারণেই উত্থান ঘটেছিল লাকি আক্তারের। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে দিপালী সাহার মৃত্যু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ওই সময়ে নেতৃত্ব দিয়ে আলোচিত হন হেলেন জেরিন খান, মোশারেফা মিশু, শিরিন সুলতানাসহ আরো অনেকে।
চাকরি ক্ষেত্রে অনেক নারী ভূমিকা রাখতে পারলেও ব্যাপকহারে ব্যবসা ও রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারছেন না। সুলতানা কামালসহ কয়েকজন এনজিও নেত্রী আলোচিত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে এনজিওর ভূমিকা হ্রাস পাওয়াতে তাদের ভূমিকাও কমে এসেছে। ব্যবাসয়ীদের মধ্যে গীতিআরা সাফিয়া, রুবানা হক এবং আরো কয়েকজন উদ্যোক্তা ভূমিকা রাখছেন যাদের অধিকাংশই পারিবারিকভাবেই এ জগতে এসেছেন। সাহিত্য জগতে কবিতায় এখন তেমন কেউ প্রভাব বিস্তার না করলেও কয়েকজন লেখক ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন- তসলিমা নাসরিন, রাবেয়া খাতুন, সেলিনা হোসেন, নাসরিন জাহান, সালমা বাণী তাদের অন্যতম। শিল্পকলায় নভেরা আহমেদ ও শামীম শিকদার প্রভাব বিস্তার করেছেন৷ চিত্র নায়িকারা কেউ তেমন প্রভাব বিস্তার করতে না পারলেও কয়েকজন টিভি নায়িকা ভূমিকা রাখছেন- যেমন শমি কায়সার।
সর্বক্ষেত্রেই নারীদের জাগরণ দরকার। একটি দেশ কতটা সভ্য তা বিবেচনা করা হয়, ওই দেশে নারীরা কতটা সক্রিয় তা দিয়ে। আমাদের সিংহভাগ নারী এখনো সংসার কর্মেই নিয়োজিত। তারা সমাজ ও রাষ্ট্রে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারেন না। নারীরা এখন শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবেই এগিয়ে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ছাত্র ও ছাত্রীর অনুপাত ৫৮:৪২। ২০১৬ সালে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ১৬ লাখ ৫২ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্র ও ছাত্রীর অনুপাত ছিল: ৫১:৪৯। আর ২০২০ সালে এসেই ২০ লক্ষ ২৯ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি ১২ হাজার অর্থাৎ অনুপাত উল্টে গেছে। নারীর শিক্ষার হার বাড়ার সাথে সাথে সমাজে ও রাষ্ট্রে তাদের ভূমিকা রাখার সুযোগও বাড়বে। উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়ে সমাজ উৎসাহ দেয় না এমনকি রাজনীতির ক্ষেত্রেও নারীদের ভূমিকা রাখা নিরুৎসাহিত করা হয়। পারিবারিক কারণ ছাড়া বেশি নারী এখানে জড়াতে চায় না। তারা একটি সরকারি/আধাসরকারি চাকরি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চায়। কিন্তু চাকরির সুযোগতো সীমিত। তাই বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত নারীকেই থাকতে হয় গৃহিনী হিসেবেই। নারীদের অধিকাংশই এখনো ধর্মীয় বিধিনিষেধে আবদ্ধ থাকছে৷
এতো প্রতিকূলতায় একটা জাগরণ দেখা যাচ্ছে৷ সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে নারীদের অংশগ্রহণ হঠাৎই চোখে পড়ার মতো বেড়েছে৷ এটা বিপুল হারে শিক্ষা গ্রহণেরই ফল৷ অনেক নারীকেই দেখছি চাকরিটাকে গুরুত্ব দিতে৷ এর পেছনে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার কিছুটা ভূমিকা রয়েছে৷ বিশেষ করে নারীদের উপবৃত্তি চালু হলে অবস্থাটা দ্রুত বদলাতে থাকে৷ শ্রেণিকক্ষে নারীর উপস্থিতি বৃদ্ধির ফলে আজ চাকরিতে নারীর সংখ্যাও বিপুলভাবে বেড়েছে৷ দ্বিতীয় বিপ্লবটা ঘটিয়েছে গার্মেন্টস কন্যারা৷ তারা সাবলম্বী হয়ে সংসার চালাচ্ছেন৷ এর সুফল দেখছি কাজী অফিসেও৷ স্বামীর নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে তারা ঝুকছে ডিভোর্সের দিকেও৷ আর বছর দশেক পরে সর্বত্রই নারীর অংশগ্রহণটা বেড়ে যাবে৷ কিন্তু নারী জাগরণের গতিটা বাড়াতে কিছু পদক্ষেপ দরকার—
১) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত নির্বাচন দেয়া৷
২) রাজনৈতিক দলে অর্ধেক নেতা নারী করার বাধ্যবাধকতা রাখা৷ নির্বাচনে এক তৃতীয়াংশ নারী প্রার্থীর বাধ্যবাধকতা রাখা৷ সংরক্ষিত নারী আসন তুলে দেয়া৷
৩) ছাত্রীরা নাইনে উঠলেই সরকার থেকে সাইকেল দেয়া৷
৪) বাল্য বিবাহ কঠোরভাবে বন্ধ করা৷
৫) নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করা৷
৬) নারী বিরোধী ওয়াজ নিষিদ্ধ করা ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা৷ নারীদের বিরুদ্ধে ফতুয়া জারি নিষিদ্ধ করা৷
৭) তসলিমা নাসরিনকে দেশে ফিরিয়ে আনা৷
শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে যে জাগরণটা দেখা যাচ্ছে তা অন্য ক্ষেত্রগুলোতে বেগবান করতে পারলে দেশের অর্থনীতিও দ্রুত বদলে যাবে৷ নারী জাগরণই হয়ে উঠুক আমাদের জাগরণের সোপান৷